পৃথিবীতে যখন সভ্য সমাজের গোড়াপত্তন হয়নি, প্রগতিশীল চিন্তাধারার যখন বালাই ছিল না, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাপূর্ণ পরিবেশে অসহায় হয়ে যাওয়া এসব মানুষগুলো স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকে পড়ত অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক সব বিশ্বাসে। প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতাভেদে এর হেরফের দেখা গেলেও মোটামুটি সবার বিশ্বাসের ভিত্তিমূল প্রায় একই ছিল। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় এমন চমকপ্রদ অথচ ভ্রান্ত কিছু বিশ্বাসের জন্য আজ পর্যন্ত বিখ্যাত হয়ে আছে। আগাগোড়া রহস্য আর রোমাঞ্চ দিয়ে ঠাসা এ সভ্যতা জ্ঞানপিপাসু ও অনুসন্ধিৎসুদের অনুসন্ধানের উপজীব্য হয়ে যুগ যুগ ধরে ভূমিকা পালন করে আসছে। পুরোদস্তুর চাকচিক্যময় প্রাচীন এ সভ্যতায় গোত্রভেদে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল। এমনকি তাদের আলাদা আলাদা ঈশ্বর-ঈশ্বরীও ছিল। এসব ঈশ্বর ঈশ্বরীরা আবার নানা দলে বিভক্ত ছিল। কেউ রাজা হিসেবে, কেউ মন্ত্রী হিসেবে পৃথিবীতে তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছে। কেউবা আবার ছিল ঈশ্বর দম্পতি। মিশরীয় পুরাণের এসব ঈশ্বর ঈশ্বরীর নিয়ে লেখা ধারাবাহিকে আজকে থাকছে শেষ পর্ব।
ঈশ্বরী ‘ন্যুট’
সূর্যদেবতা রা এর মাতা এবং কখনো কন্যা হিসেবে স্বীকৃত দেবী ন্যুট ছিল দেবতা শ্যু’র স্ত্রী। আকাশের দেবী ন্যুট তার বিশালদেহী শরীর নিয়ে আকাশের ভার বহন করত। ন্যুট এর অনেকগুলো সন্তান ছিল। দেবতা ওসিরিস, হোরাস, শেথ, আইসিস এবং নেফতিস ছিল তার সন্তান। ন্যুটকে কখনো চিহ্নিত করা হত পূর্ণবয়স্কা শূকরী হিসেবে। চিত্রে দেখা যেত দেবী ন্যুটের পেট শূকরছানা দ্বারা আবৃত। আবার ন্যুটের পেটকে মনে করা হত ঐশ্বরিক সমুদ্র,যেখানে আবার পাল তুলে চলত সৌরতরী।

দেবী ন্যুটের জরায়ূ থেকে সূর্য প্রতিদিন পুনর্জন্ম লাভ করত।
ঈশ্বর ওসিরিস
শস্য ও নীলনদের দেবতা ওসিরিস ছিলেন দেবী ন্যুটের সন্তান। ওসিরিসের আগমনের পূর্বে মিশরবাসী ফসল কিভাবে ফলাতে হয় তা জানত না। তার উপর প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল পুরো মিশর। সমাজে অন্যায় অনাচার বিশৃঙ্খলা ছিল নিত্যসঙ্গী। এমন পরিস্থিতিতে দেবতা ওসিরিস ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে পৃথিবীতে তার পবিত্র পা রাখেন। মিশরীয়দের জন্য তিনি এক নতুন ধরণের ফসল ফলানোর পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। তিনি তাদের শেখান কিভাবে ফসল ফলাতে হবে, কিভাবে নীলনদের পানি দিয়ে সেচ ব্যবস্থার সূচনা করতে হবে। ওসিরিসের এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপে জমিতে ফসল উৎপাদন বেড়ে গেল পুরোদমে, ধারাবাহিক খাদ্যের সংকটকে যেন মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দিলেন দেবতা ওসিরিস, মিশরীয়দের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল। ওসিরিস মিশরীয়দের নগর গোড়াপত্তনের শিক্ষাদানের পাশাপাশি সমাজের ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠা করেন আইনকানুনের। গির্জা ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মিশরীয়দের ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন, গড়ে তোলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

দেবতা ওসিরিসের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির কারনে আরেক দেবতা সেথ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়েন। তিনি ওসিরিসকে হত্যা করার ফন্দি আঁটেন। শেষপর্যন্ত সেথের হাতেই ওসিরিস নিহত হওয়ার মাধ্যমে মিশরীয় পুরাণের শক্তিশালী দেবতার অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।
দেবী আইসিস
দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুর পর স্ত্রী আইসিস তার স্থলাভিষিক্ত হয়। আইসিসকে বলা হত পশ্চিম বদ্বীপের প্রতিবেশী ঈশ্বরী। মিশরীয় ভাষায় আইসিস নামের অর্থ হচ্ছে আসন। ন্যুট ও গেবের প্রথম কন্যা এবং হোরাসের মা আইসিস ছিলেন মাতৃত্ব, যাদু ও উর্বরতার দেবী। সকল শ্রেণীপেশার মানুষের প্রার্থনা শুনতেন বলে তাকে বলা হত সর্বজনীন ঈশ্বরী। তিনি ছিলেন একাধারে মৃতদের রক্ষাকারিণী, সারল্য ও শিশুদের দেবী।

কথিত আছে, স্বামী ওসিরিসের মৃত্যুর শোকে আইসিসের ক্রন্দনের কারনে নীলনদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়।
প্রাচীন মিশরীয় দেবী হলেও আইসিসের অস্তিত্ব গ্রিক রোমান অঞ্চল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। সেখানেও দেবী আইসিস সমানভাবে পূজিত হতেন।
ঈশ্বর ‘সেথ’
মরুভূমি, ঝড় ও বিদেশীদের দেবতা সেথ তার ভাই ওসিরিসকে হত্যা করে প্রাচীন মিশরের নতুন ঈশ্বর হিসেবে জায়গা করে নেন। চিত্রকলায় সেথকে একটি কাল্পনিক জন্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ওসিরিসের অনুসারীরা সেথের জন্মলগ্ন থেকেই তার চরিত্র সম্বন্ধে বিরূপ প্রচার করে আসছিল। তারা দাবি করত, উপযুক্ত সময়ে জন্ম হয়নি সেথের। সে নিজে জরায়ূ ছিঁড়ে তার মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার চোখ ও চুল লাল বর্ণের হওয়ার কারনে ওসিরিসের অনুসারীরা তাকে মন্দের প্রতীক হিসেবে গণ্য করত। এসব বিবিধ কারনেই সেথের মনে প্রতিহিংসা দানা বাঁধতে শুরু করে যার ফলাফল তার ভাই দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
ঈশ্বরী নেফতিস
পঞ্চম অধিদিবসে ন্যুটের দ্বিতীয় কন্যা দেবী নেফতিসের জন্ম হয়। মিশরীয় ভাষায় নেফতিস নামের অর্থ হচ্ছে গৃহের সম্মানিত মহিলা। নেফতিস, দেবতা সেথের স্ত্রী হলেও সে ওসিরিসের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর সুবাদে একদিন নেফতিস, দেবী আইসিসের রূপ ধরে ওসিরিসের সাথে মিলিত হয় এবং তাদের মিলনের ফলে জন্ম নেয় আরেক দেবতা আনুবিস।

ঈশ্বর হোরাস
প্রাচীন মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হোরাসকে মিশরীয় পুরাণে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। কখনো তাকে কল্পনা করা হত আটুমের সন্তান হিসেবে, কখনো সূর্যদেবতা রা’র সন্তান হিসেবে আবার কখনো বা কল্পনা করা হত ন্যুটের সন্তান হিসেবে।

হোরাসের মাথা ছিল বাজপাখির মত এবং তার শরীর ছিল বলশালী পুরুষের মত। দেবতা হোরাস মিশর ছাড়াও গ্রিক রোমান অঞ্চলে গুরুত্বের সাথে পূজিত হতেন।
ঈশ্বর হ্যারোয়েরিস
দেবতা হোরাসের প্রাথমিক আকৃতির রূপ নিয়ে মিশরে আবির্ভাব ঘটে নতুন ঈশ্বর হ্যারোয়েরিসের। হ্যাথোরের পুত্র বা স্বামী হিসেবেও কল্পনা করা হত হ্যারোয়েরিসকে। দেবতা হ্যারোয়েরিস ছিলেন সেথ ও ওসিরিসের ভাই। যদিও সেথ ও ওসিরিসের দ্বন্ধে একাধিক হ্যারোয়েরিসের উল্লেখ পাওয়া যায়।
সূর্যদেবতা রা’র সাথে হ্যারোয়েরিসকে বাজপাখি-ঈশ্বররূপে কল্পনা করা হত।
ঈশ্বর হারাখতি
বাজপাখির মাথাযুক্ত মানুষের প্রতিকৃতিতে দেবতা হারাখতিকে বলা হত দুই দিগন্তের হোরাস। প্রথমদিকে তাকে আলোর ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা করা হত। সূর্যদেবতা রা’র সাথে সে প্রতিদিন আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাতায়াত করত।
ঈশ্বরী হ্যাথোর
গরুর আকৃতি ধারণ করে বিশ্বজনীন মাতা ঈশ্বরী হিসেবে দেবী হ্যাথারকে মিশরীয় পুরাণে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে ছিল আকাশের দেবী। হ্যাথোর নামের অর্থ হচ্ছে মুখমন্ডলের বসতবাড়ি। তাকে প্রায়ই পৃথিবীর স্রষ্টা হিসেবে ভাবা হত।

সূর্যদেবতা রা যখন বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্য হ্যাথোরকে সিংহীরূপে প্রেরণ করেন তখন হ্যাথোর চাইল তার শক্তিবলে পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু রা সেটা চাইলেন না। এভাবে হ্যাথোরকে দমাতে রা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। দেবী হ্যাথোরকে ভাবা হত হোরাসের স্ত্রী হিসেবে। তাকে মাঝে মাঝে আনন্দের দেবী নামেও সম্বোধন করা হত।
ঈশ্বর আনুবিস
সেথের স্ত্রী দেবী নেফতিস যখন আইসিসের ছদ্মবেশে ওসিরিসের সাথে মিলিত হোন তখন তাদের মিলনের ফলে জন্ম নেয় আরেক দেবতা আনুবিস। মিশরীয় পুরাণে আনুবিসকে মৃতের জগতের মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে যখন মর্ত্য থেকে পাতালে নিয়ে যাওয়া হত তখন মৃতের নিরাপত্তা দান করতেন দেবতা আনুবিস। এছাড়া মৃত ব্যক্তি আকাশের তারা হতে পারবে কি পারবে না তাও নির্ধারণ করে দিতেন ঈশ্বর আনুবিস!

মৃতদেহের মমির তদারকি ছাড়াও তিনি আত্মার ওজনের দায়িত্ব পালন করতেন।
তার মাথা ছিল শেয়ালাকৃতির এবং শরীর ছিল মানুষের মত।
দেবতা থোট
যাদুবিদ্যার দেবতা থোট মিশরের অন্যতম প্রাচীন ঈশ্বর হিসেবে স্বীকৃত। ওসিরিসের উজির হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে থোট আইসিসকে যাদু শিক্ষা দেয়। থোটের যাদুবিদ্যা দ্বারা আইসিস পরবর্তীতে ওসিরিসের জীবন সংরক্ষণ করেন।

থোটের সম্মানার্থে সূর্যদেবতা রা চাঁদ সৃষ্টি করে থোটকে চাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। থোট আবার ছিল নক্ষত্রের ঈশ্বরদের শাসক। এজন্য তাকে বলা হত নক্ষত্রের ষাঁড়।
ঈশ্বরী সেসহাত
লিখনরীতি ও পরিমাপের দেবী সেসহাত ছিল থোটের এর বোন। আবার কখনো থোটের স্ত্রী’ও বলা হত সেসহাতকে। সেসহাতের মাথায় থাকত নক্ষত্রখচিত প্রতীক চিহ্ন এবং শরীরে থাকত ইউরেইয়াস সাপ। লেডি অফ বুক নামে পরিচিত ছিল দেবী সেসহাত।
দেবী নেখবেত
উত্তর মিশরের শকুন ঈশ্বরী নেখবেত ছিল নেখেব শহরের অধিপতি। মিশরীয় পুরাণে দেবী নেখবেতকে সূর্যদেবতা রা এর ডান চোখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নারী শকুনের রূপ গ্রহণ করে উত্তর মিশরে সাদা মুকুট পরিধান করে থাকত নেখবেত। তার নির্দেশেই মৃতদেহকে মরুভূমিতে ফেলে রাখা হত যাতে করে শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্র : মিশরীয় পুরাণ, মোস্তফা মীর
উইকিপিডিয়া