গল্প শুনতে সবাই ভালোবাসে। সেই গল্প যদি হয় পুরাণ বা কল্পকাহিনী কে ঘিরে তাহলে তো আর কথাই নেই। আর সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা টা ঘটে তখন ই যখন সেই কল্পকাহিনী চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠে । মানব সভ্যতার শুরু থেকেই বিভিন্ন পৌরাণিক কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিলো এবং এখন পর্যন্ত ও লোকজন কল্পকথার ছলে নিজেদের সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করে । হারিয়ে যাওয়া শহর “দ্বারকা” তেমনি এক কল্পকথার আখ্যান যা কালের বিবর্তনে এখন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। হিন্দু পুরাণে বর্ণীত হারিয়ে যাওয়া শহর দ্বারকা নিয়ে প্রচলিত গল্প গুলো শত শত বছর ধরে চলে আসছে।গল্প গুলো কারো কাছে শুধুই পৌরাণিক কাহিনি আবার কেউ কেউ ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে এগুলো কে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে। দ্বারকা সম্পর্কে একটি মজার তথ্য হচ্ছে একই নামে সেই একই এলাকায় এখনো একটি শহর রয়েছে।এবং বলা হয়ে থাকে যে এখনকার আধুনিক দ্বারকা হচ্ছে সেই পৌরাণিক দ্বারকার ৭ম সংস্করণ।
আধুনিক ও পৌরাণিক দ্বারকা : দুই শহরের যুগলবন্দী
আধুনিক শহর দ্বারকা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গুজরাট প্রদেশের দেবভূমি তে অবস্থিত একটি শহর। এই শহরটিকে হিন্দু ধর্মানুযায়ী উল্লেখ্যযোগ্য চারধাম (হিন্দুধর্মের চারটি পবিত্র তীর্থযাত্রী স্থান) এর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং দেশের সাতটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম (অন্য ছয়টি অযোধ্য, মথুরা, হরিদ্বার, বানরস, কাঞ্চি ও উজেন)। দ্বারকার খ্যাতি মূলত পুরাণে উল্লেখিত পবিত্র শহরের সাথে আধুনিক শহরের সনাক্তকরণের কারণে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু পণ্ডিতেরা পৌরাণিক ‘হারিয়ে যাওয়া শহর দ্বারকা ‘র কাহিনী বর্ণনা করে আসছেন।দ্বারকা নিয়ে প্রচলিত কাহিনী গুলো মহাভারত, ভগবদ গীতা এবং ভগবদ পুরাণে বর্ণিত আছে। শত বছর ধরে চলে আসা কাহিনী গুলোকে অনেকে শুধু কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দিয়েছে কারন এসব কাহিনীর কোনো সত্যতা নেই। কিন্তু কে জানত যে সেই কল্পকাহিনী ই একদিন বাস্তবতায় রূপ নেবে।
ডুবো শহর দ্বারকা : শ্রী কৃষ্ণের আবাস
সংস্কৃত “দ্বারকা”(Dvaraka or Dwaraka) শব্দটির অর্থ প্রবেশদ্বার (gateway)। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী হারিয়ে যাওয়া শহর “দ্বারকা” হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের আবাসভূমি এবং স্বর্গের প্রবেশদ্বার।এই নামকরণ এর পেছনে যে কারন টি রয়েছে তা হলো এই শহরের প্রবেশদ্বার যা পুলের সাহায্যে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলো। শহর টি নিরাপত্তার স্বার্থে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। পুরাণে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী মথুরার অধিবাসীদের কে মগধ রাজ্যের শাসনকর্তা জরাসন্ধ এর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে শ্রী কৃষ্ণ ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় অঞলে একটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল ই হারানো শহর দ্বারকা।
দ্বারকার গোড়াপত্তনের পৌরাণিক ইতিহাস ও পরিণতি:
বলা হয়ে থাকে যে,ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরাতে শ্রী কৃষ্ণের জন্ম। তাঁর মামা কংস এই শহরের অত্যাচারী শাসক ছিলেন এবং অবশেষে কৃষ্ণের হাতে নিহত হন। কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ, যিনি মগধের রাজা ছিলেন, তিনি কংসের খুনের কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও মথুরা ১৭বার হামলার স্বীকার হয়েছিল, তবে জরাসন্ধ এটি দখল করতে পারেনি। তবুও দীর্ঘকালের সংগ্রামের ফলে তা লোকেরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর লোকজন জারাসন্ধের সাথে আবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরতে পারবেন না। তিনি তাই মথুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি নতুন শহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্মানের দেবতা বিশ্বকর্মার সহায়তা চান। কিন্তু বিশ্বকর্মা জানায় যে যদি সমুদ্র দেবতা কিছু জমি দেয় তাহলেই নতুন শহর নির্মাণ সম্ভব। কৃষ্ণ তখন সমুদ্র দেবতার উপাসনা শুরু করেন। সমুদ্র দেবতা খুশি হয়ে তাকে কিছু জমি দান করেন নতুন শহর স্থাপনের জন্য।তারপর বিশ্বকর্মার তত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা পায় দ্বারকা ।
দ্বারাকাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। বলা হয় যে এই শহরটি ছয়টি অংশে বিভক্ত ছিলো যা আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, বিস্তৃত রাস্তা, নগর চত্বর, প্রাসাদ সমুহ (৯০,০০০ যা স্বর্ণ, রৌপ্য এবং মূল্যবান পাথরের তৈরি) এবং পাশাপাশি সুন্দর বাগান ও হ্রদসহ অসংখ্য সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ছিলো। সুধামস্ত নামক একটি সভাকক্ষ(‘সত্য ধর্মের সভা’) ছিল যেখানে জনসভা অনুষ্ঠিত হতো। শহরটি জল দ্বারা বেষ্টিত ছিল, এটি সেতু এবং একটি প্রবেশ দ্বারের মাধ্যমে মূল ভূখন্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলো।
এই দ্বারকা শহরটিতেই কৃষ্ণ বাকি জীবন বসবাস করেছিলেন। ভালকা তীর্থের একটি বনে গাছের নিচে ধ্যান করার সময় ঘটনাক্রমে একটি তীর দ্বারা আক্রমনের পর কৃষ্ণ এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তিনি যে শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি ব্যাপক বন্যার দ্বারা গ্রাস হয়ে গিয়েছিল, আর এভাবেই এটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়।
আরেক টি প্রচলিত কাহিনী অনুসারে দ্বারাকা ছিলো কৃষ্ণ ও রাজা সালভা’র একটি সংঘর্ষ ক্ষেত্র। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী রাজা সালভা একটি উড়ন্ত মেশিনের সাহায্যে দ্বারকাকে আক্রমণ করেছিলেন। এই যুদ্ধের বর্ণনা প্রাচীন এলিয়েন তত্ত্ববিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, কারণ মনে করা হয় যে এই যুদ্ধে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত অস্ত্রের সাথে লড়াই করা হয়েছিল, এমনকি কক্ষপথ থেকে আক্রমণ করা যায় এমন অস্ত্র ও ব্যবহার করা হয়েছিলো।সেই উড়ন্ত মেশিন থেকে অস্ত্র ব্যবহার করে শহরের উপর আক্রমণ শুরুর পরে শহরের বেশিরভাগ অংশ ধংস হয়ে যায় অ সমুদ্রে ডুবে যায়।
কালের বিবর্তনে দ্বারকা বিলীন হয়ে গেলেও রয়ে গেছে এই শহর কে ঘিরে প্রচলিত সব কল্পকাহিনী। বলা হয় যে, শত শত বছর ধরে এই জায়গার আশেপাশেই অনেক জাতি গোষ্ঠী তাদের নগর সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিলো এবং বিশ্বাস করা হয় যে বর্তমান দ্বারকা শহর টি সেই শহরেই ৭ম সংস্করণ।
ইতিহাস এবং পুরাণ এর সম্মিলন :
অনেকে দ্বারকা এবং এর পরিণতি কে কেবল কল্পকথা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তবুও, এমন লোকও আছে যারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে এই গল্পের পেছনে একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে এবং কিছুদিন আগে ও তাদের এই বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি ছিলো না। তারপর একদিন হটাৎ আবিষ্কৃত হয় কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীত।
১২০ফূট পানির নিচে কিছু প্রাচীন ভগ্নাবশেষ এর সন্ধান পায়।মেরিন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রচুর সংখ্যক পাথের তৈরি কাঠামো দেখা যায়। সে গুলো অর্ধবৃত্তাকার, আয়তক্ষেত্রাকার এবং বর্গাকৃতির এবং এগুলো ১২০ ফুট পর্যন্ত পানির গভীরতার মধ্যে রয়েছে। কাঠামো গুলো এলোমেলোভাবে একটি বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই কাঠামোর পাশাপাশি পানির গভীরতার মধ্যে পাথরের বেশ কয়েক প্রজাতির নোঙর ও দেখা যায়। এই আবিস্কার নির্দেশ করে যে অতীতে এই স্থান টি সমুদ্র বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো এটি ছিলো পশ্চিম ভারতের ব্যস্ততম বন্দর গুলোর মধ্যে একটি। যে কাঠামোটি আবিস্কৃত হয়েছে তা বড় আকৃতির একটি শহরের সমান। তাহলে কি এই ধংসাবশেষ ই শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকা যা হারিয়ে গিয়েছিলো সমুদ্রের অতলে? যারা আগে দ্বারকা কে শুধু কল্পকাহিনী ভেবেছিলো তারা ও এখন ভাবতে শুরু করেছে যে দ্বারকা শুধু পূরাণ নয় বরং এটি বাস্তবতা এবং ইতিহাসের অংশ। বিজ্ঞানীরা ও সেই ইঙিত ই দিয়েছেন।
এই ধংসাবশেষ থেকে কিছু হস্ত নির্মিত জিনিস পত্র পাওয়া যায় য থেকে বিজ্ঞানীরা ধারনা করেছেন যে এগুলো কম করে হলেও ৯৫০০ বছর পুর্বের। এই ধারনা অনুযায়ী,বরফ যুগের শেষে যখন সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় তখন পৃথিবীর অনেক উপকূলীয় অঞ্চলের মত এই শহরটি ও ডুবে যায় এবং হারিয়ে যায় চিরতরে। অর্থাৎ মানব সভ্যতার ইতিহাস শুরুর পুর্বেই বিলীন হয়ে যায় দ্বারকা যা কয়েক বছর পুর্ব পর্যন্ত ও শুধু একটা পৌরাণিক কাহিনী হিসেবেই প্রচলিত ছিলো। প্রত্নতত্তবিদ ড.এস. আর.রাও (Dr.S.R.Rao) যিনি এই গবেষণা কার্য পরিচালনা করেছেন, অবশেষে প্রকাশ করেছেন যে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ গুলোতে বর্ণীত ঘটনা নিছক কল্পকাহিনী নয় বরং এর পেছনে সত্যতা রয়েছে।
হারিয়ে যাওয়া দ্বারকার আবিস্কার ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক। কারন এই আবিস্কার মহাভারত ও দ্বারকা সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছে। কারন এই পর্যন্ত পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় প্রাপ্ত যে কোনো সভ্যতার চেয়ে এটি অন্তত ৫০০০ বছর পুরনো। এই শহর সুমেরীয় বা হরপ্পান সভ্যতার চেয়ে ও পুরনো। অর্থাৎ এই শহর ইতিহাসের ও ইতিহাস।
তথ্য সুত্রঃ
www.ancientpages.com/…/dwarka-pre-harappan-city-that-could-rewrite-the-history-o…
https://www.ancientaliensmap.com/locations/lost-city-of-dwarka
https://www.gounesco.com/where-mythology-meets-reality-sunken-city-of-dwarka/
dutasteride medication tamsulosin 0.2mg generic order ondansetron 4mg generic
order levofloxacin 250mg pills buy levofloxacin generic