“দ্যা গ্রেট ওয়াল” নামটির সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। শুধু কি গ্রেট ওয়াল! চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, নদী, সমুদ্রসহ আধুনিক নগরায়নের জন্য সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য চীন একটি পরিচিত দেশ। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য ইতিবৃত্তের আয়োজনে দ্যা গ্রেট ওয়ালের দেশ চীনের দর্শনীয় কিছু স্থান এর বিবরণ তুলে ধরা হলো। চীন ভ্রমণকারীরা যা কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবে না।
দ্যা গ্রেট ওয়াল (The Great Wall):
চীনের প্রতিমাসংক্রান্ত প্রতীকগুলির একটি, গ্রেট ওয়াল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রাচীর। প্রাচীন প্রতিরক্ষামূলক স্থাপত্যের বিখ্যাত কীর্তিসমূহের মধ্যে গ্রেট ওয়াল অন্যতম। গ্রেট ওয়ালের ঘূর্ণায়মান পথ, খাঁড়া পর্বতমালা দর্শনার্থীদের নজর কেঁড়ে থাকে। এই মহাপ্রাচীর চীনের পশ্চিম সীমানা থেকে শুরু করে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত, সবচেয়ে সমন্বিত এবং সংরক্ষিত বিভাগ চীন এর রাজধানী বেইজিং এর কাছাকাছি অবস্থিত। চীনের এই মহাপ্রাচীর পৃথিবীর সেরা সাতটি বিস্ময়কর দর্শনীয় স্থানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে এবং ইউনেস্কো তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর স্থাপত্যের মধ্যে চীনের মহাপ্রাচীর অন্যতম। কথিত রয়েছে, যে পর্যটক চীন ভ্রমণ করল অথচ গ্রেট ওয়ালের পিঠে আরোহণ করেনি, প্রকৃতপক্ষে সে চীন ভ্রমণ করেনি।
সাংহাই এর টেরাকোটা আর্মি:
চীনের সাংহাই প্রদেশের সিয়ান শহরে অবস্থিত চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং এর সমাধি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত “টেরাকোটা আর্মি” চীনের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম। আসলে টেরাকোটা আর্মি জীবন্ত কোন সেনাবাহিনী নয়। সম্রাট কিন শি হুয়াং এর মৃত্যুর পর স্থানীয় লিনথং জেলার কৃষকেরা সম্রাটের সম্মানার্থে পোড়ামাটি দ্বারা এই সৈন্যবাহিনী তৈরি করে।
পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি এই সৈন্যবাহিনীতে সামরিক পদমর্যাদার স্বরূপ বিভিন্ন আকারের মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও ঘোড়াসহ সাওয়ারকারীদের মূর্তি রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, প্রাচীন সামরিক বাহিনী যেভাবে সুসজ্জিত থাকতো, কৃষকদের তৈরি মূর্তিগুলোতে সেই রূপ দেয়া হয়েছে। তৎকালীন সময় বিশ্বাস করা হতো, সম্রাট কিন এর মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও এই সৈন্যবাহিনী সম্রাটকে নিরাপত্তা দিবে। প্রায় ২০০ বছর ভূগর্ভস্থ ছিল টেরাকোটা আর্মি। ১৯৭৪ সালের দিকে স্থানীয় একদল কৃষক কূপ খননের সময় এই স্থাপত্যের সন্ধান পায়, যা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিস্ময় ছিল। চীনের পর্যটকদের ততক্ষণ পর্যন্ত কৌতূহল শেষ হয়না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা “টেরাকোটা আর্মি” দর্শনে যায়।
বেইজিং এর নিষিদ্ধ নগরী:
(The Forbidden City in Beijing) বাংলায় বলা হয়ে থাকে বেইজিং এর নিষিদ্ধ নগরী। একসময় এই নগরীতে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। চীনের প্রাচীন স্থাপত্যবিদদের দ্বারা নির্মিত এই প্রাসাদে চার হাজারেরও বেশি সুসজ্জিত রুম রয়েছে, রুমগুলিতে লাল এবং হলুদ রঙয়ের কারুকার্য রয়েছে।
এই প্রাসাদের ছাদ সোনা দিয়ে তৈরি। ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় ৫৬০ বছর ধরে মিং রাজবংশ থেকে শুরু করে চিং রাজবংশের রাজপ্রাসাদ ছিল এটি। ২৪ জন সম্রাট বসবাস করেছিল এই প্রাসাদে। বর্তমানে এই প্রাসাদটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান হিসেবে ইউনেস্কো তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাসাদগুলির মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত। বেইজিং এর জাদুঘরের অধীনে বর্তমানে এটি সংরক্ষিত রয়েছে এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পর্যটকগণ তাদের ভ্রমণ আনন্দময় করে তুলতে পারে, এই রাজপ্রাসাদটি ভ্রমণ করে।
গুইলীং এর লি নদী:
বলা হয়ে থাকে, চীনের চিত্রশিল্পীগণ এবং কবিগণ তাদের শিল্পকর্মের প্রেরণা পেয়ে থাকেন এই “লি” নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে। মাওর পর্বতমালা থেকে নেমে আসা এই নদীটির দৈর্ঘ্য ৮৩ কিলোমিটার। ৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের লি নদীটির গুইলীং এবং ইয়াংসু এর মধ্যবর্তী স্থানটি সবচেয়ে বেশি সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত।
নদীটির দুপাশে চমকপ্রদ আড়াআড়ি পাহাড়, খাঁড়া খাঁজ এবং গ্রামগুলির সুসজ্জিত চাষাবাদ পর্যটকদের নজর কেঁড়ে থাকে। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে লি নদীর সৌন্দর্যও বদলাতে থাকে। মেঘলা এবং রৌদ্রজ্জ্বল দিনে লি নদীর অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের মন কেঁড়ে নেয়। লি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক সমাগম ঘটে থাকে এখানে। নদীটি ঘুরে বেড়ানোর জন্য পর্যটকদের সুবিধার্থে ছোট ছোট বাঁশের নৌকা এবং সুসজ্জিত জাহাজ রয়েছে। পর্যটকরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী নৌকা বা জাহাজে চড়ে নদী ভ্রমণ করে থাকে। বিশ্বের সেরা দশটি জলীয় বিস্ময়ের মধ্যে লি নদী অন্যতম। তাই যেসব পর্যটকগনের মন নদী বা পাহাড়ের টানে ছুটে যেতে মন চায়, তারা গুইলীং এর লি নদী থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
হুয়াংশান এর হলুদ পাহাড়:
পূর্ব চীন এর আনহুই প্রদেশে অবস্থিত (The Yellow Mountains in Huangshan) হুয়াংশান এর হলুদ পাহাড়। প্রধানত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কারণে এই পাহাড় পর্যটকদের নজর কেঁড়ে থাকে। সূর্যোদয়, মেঘের সমুদ্র, অদ্ভুত আকৃতির শিলা, বাঁকানো সারি সারি পাইন গাছ এবং হট স্প্রিং বা উষ্ণ বসন্ত।
এই পাহাড়ের উচ্চতা সর্বোচ্চ চূড়ায় ১,৭৩৪ মিটার(৫,৬৮৯ ফুট)। হুয়াংশান এর হলুদ পর্বতমালা চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্বতমালা। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় হুয়াংশান এর হলুদ পর্বতমালার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং চীনের তিনটি সেরা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এটি অন্যতম। অন্য দুটি হচ্ছে ঝংজিয়াজী ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক এবং জিউজাইগৌ ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক। এমনকি এই তিনটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে হলুদ পাহাড় সবচেয়ে বিখ্যাত। বলা হয়ে থাকে পর্যটকরা এই পর্বত ভ্রমণে গেলে পর্বত সমান প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে।
চেংদুর বৃহৎ পাণ্ডা:
পাণ্ডা বা বৃহৎ পাণ্ডা, ভালুকের মত দেখতে সাদাকালো রঙের এক প্রকার প্রাণী। চীন এর সিচুয়ান প্রদেশের চেংদুর ঘন বাঁশ বাগানে প্রচুর পরিমাণ বৃহৎ পাণ্ডার দেখা পাওয়া যায়। শুধুমাত্র চীনের জনগণ নয়, প্রচুর বিদেশীদের আগমন ঘটে চেংদুতে, এই বৃহৎ পাণ্ডা দেখার জন্য। যদিও বিভিন্ন চিড়িয়াখানাসহ অন্যান্য স্থানে বৃহৎ পাণ্ডা দেখতে পাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে বেশি বৃহৎ পাণ্ডার দেখা পাওয়া যায় চেংদুতে।
এছাড়াও চেংদুতে রয়েছে “চেংদু পাণ্ডা ব্রিডিং এন্ড রিসার্চ সেন্টার”। ১৯৮৭ সালে মাত্র ৬টি বৃহৎ পাণ্ডা নিয়ে এই রিসার্চ সেন্টার এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত এখানে ১২৪টি পাণ্ডার জন্ম হয়েছে। বর্তমানে এই সেন্টারে ৮৩টি বৃহৎ পাণ্ডা রয়েছে। পর্যটকরা চেংদুতে গেলে যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশের পাণ্ডাদের বসবাস দেখতে পারবে, তেমনি “চেংদু পাণ্ডা ব্রিডিং এন্ড রিসার্চ সেন্টার” এর পাণ্ডাদের দেখতে পারবে এবং এদের জীবনধারণ ও বংশবিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে। বলা হয়ে থাকে, বৃহৎ পাণ্ডার স্বদেশ চেংদু।
লাসায় অবস্থিত পোতালা প্রাসাদ:
পোতালা প্রাসাদ, এই প্রাসাদটিকে তিব্বতের প্রতীক হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বেইজিং এর লাসা শহরে অবস্থিত এই প্রাসাদটি একসময় তিব্বতি আধ্যাত্মিকগণ এবং তাদের অনুসারীদের প্রার্থনা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৫৯ সালে চীন কর্তৃক দখল হওয়ার পর তিব্বতি আধ্যাত্মিকগণ তাদের অনুসারীদের নিয়ে পোতালা প্রাসাদ ত্যাগ করে। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো পোতালা প্রাসাদকে ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে তালিকাভুক্ত করে। বর্তমানে এখানে প্রচুর পর্যটকদের আগমন ঘটে।
হংজ়ৌ এর ওয়েস্ট লেক:
চীন এর চেচিয়াং প্রদেশের হংজৌ শহরের এই হ্রদটিকে পৃথিবীর স্বর্গভুমি বলা হয়ে থাকে। চীনের মানুষ এই হ্রদকে প্রশান্তির স্থান হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। এই হ্রদ এর উত্তর এবং পূর্ব অংশ জুরে দিগন্ত, এবং কাছাকাছি পাহাড়ের সারিগুলি তিন দিকে বিস্তৃত হয়ে স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছে। এই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা হ্রদের চারিদিকে সাইকেল চালাতে পারে অথবা হেঁটেও এই মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে পারবে। ছোট ছোট নৌকা রয়েছে, যেন পর্যটকরা নৌকায় চড়ে হ্রদে ঘুরে বেড়াতে পারে।