ক্রিসমাসঃ ইতিহাসের অভিজাত এক ধর্মীয় উৎসবের ইতিবৃত্ত(পর্ব ২)

0

প্রথম পর্বের পর – প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ঃ 

গতপর্বে জেনেছিলাম খ্রিষ্টের জন্ম ও বড়দিন উদযাপনের নানান খুঁটিনাটি। আজ আমরা জানবো পৌরণিক সব চরিত্রগুলো সম্পর্কে।

সান্তাক্লজের উপহার ও অদ্ভুত কিছু পৌরণিক চরিত্রঃ

বড়দিনের অন্যতম এক চরিত্র সান্তা ক্লজ। শিশুদের কাছে সান্তা ক্লজ দারুণ জনপ্রিয়। প্রচলিত ধারণা হলো সান্তা ক্লজ বড়দিনের আগের রাতে শিশুদের জন্য উপহারের ডালি নিয়ে আসেন। সান্তার প্রচলিত এসব কাহিনি অনুসারে সান্তা ক্লজ থাকেন উত্তর মেরুর কোন এক জায়গায়। সান্তা ক্লজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মিসেস ক্লজ, অনেক এলফ এবং আটটি উড়ন্ত বলগা হরিণও বসবাস করে। সান্তা ক্লজ সারা বিশ্বের শিশুদের পুরো বছরের আচরণ পর্যবেক্ষন করে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। যেখানে সকল শিশুদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়— দুষ্টু ও শান্ত। তারপর তিনি ক্রিসমাসে রাতে লক্ষ্মী শিশুদের খেলনা, চকলেট, ক্যান্ডি ও অন্যান্য উপহার দিয়ে যান। আর দুষ্টু বাচ্চাদের জন্য রেখে যান কয়লা। বড়দিনের সকালে শিশুরা ঘুম থেকে উঠে ঘরে (বেশীর ভাগ সময় ফায়ারপ্লেস বা চিমনির পাশে) রাখা ঝুড়িতে সান্তা ক্লজের রেখে যাওয়া উপহার নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে।

ক্রিসমাস বা বড় দিন
Source: Pinterest

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে শিশুরা ক্রিসমাসের আগের দিন দরজার বাইরে মোজা ঝুলিয়ে রাখে। ফ্রান্স, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের শিশুরা ক্রিসমাসের আগের দিন ঘরের বাইরে জুতো রেখে দেয়। সান্তা ক্লজ এগুলোতে উপহার রেখে যান। মূলত সান্তা ক্লজ হলো একটি মিথ বা পৌরাণিক চরিত্র। কালের পরিবর্তনে অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনির মতো সান্তা ক্লজও বর্তমানে এই রূপ পেয়েছে। বাস্তবতা হলো শিশুরা যখন ঘুমিয়ে থাকে মা-বাবা বা আত্মীয়-স্বজন তাদের রাখা মোজা বা ঝুঁড়িতে উপহার রেখে দেন। সকালে শিশুরা ঘুম থেকে উঠে সান্তা ক্লজ উপহার দিয়ে গেছে বলে খুশিতে মেতে ওঠে। সান্তা ক্লজকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে সান্তা ক্লজকে বলা হয় তোমতার, সুইজারল্যান্ডে সেন্ট লুসি, ইতালিতে লা বেফানা, গ্রিসে সেন্ট বার্সিল, পোল্যান্ডে ফাদার ফ্রস্ট ইত্যাদি। বর্তমানে আমরা যে সান্তাকে দেখি তিনি ছিলেন আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। তৃতীয় শতকে (২৭০ খ্রিষ্টাব্দ)রোমান সম্রাজ্যের পাতারা অঞ্চলে (বর্তমান তুরষ্ক) অত্যন্ত ধনী এক গ্রিক পরিবারে সেইন্ট নিকোলাস এর জন্ম হয়( সেইন্ট নিকোলাসের ডাচ উচ্চারনই মূলত সান্তাক্লজ)ছোট থেকেই নিকোলাস অত্যন্ত ধর্মানুরাগী ছিলেন, এবং পড়ালেখা ভালোবাসতেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মযাজক হিসেবে জীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন তখনকার অত্যন্ত সুপরিচিত ও প্রভাবশালী আর্চবিশপ। তাকে বিশপ অফ মায়রা বলেও ডাকা হতো। ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম নিসিয়া কাউন্সিল এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ষ্টকহোমের জাতীয় জাদুঘরে সেইন্ট নিকোলাস এর চিত্র মহানুভবতা ও পরোপকারীতা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সকল অর্থ-সম্পদ তিনি গরিব-দুস্থদের মাঝে দান করে দেন। অসহায় মানুষকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন শহরে ভ্রমন করেন। সেইন্ট নিকোলাস শিশুদের খুব পছন্দ করতেন। শিশুদেরকে কাছে পেলে আদর করতেন, খাবার ও উপহার-সামগ্রী দিতেন। তখনকার সময় অসহায় ব্যাক্তিরা নিকোলাসের মহানুভবতা সম্পর্কে জানতো, এবং সাহায্য পাওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে জুতা রেখে দিতো, আর সেইন্ট নিকোলাস সেই জুতোর ভেতর টাকা-পয়সা রেখে দিতেন।

ক্রিসমাস বা বড় দিন
Source: Christianity Today

কথিত আছে, একবার তিনি এক হত দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার তিন কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করেন এবং যাবতীয় খরচ প্রদান করেন। তখনকার সমাজে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে যৌতুক দিতে হতো, যা ঐ দরিদ্র পিতার সাধ্যে ছিলো না। আর একটা নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে গেলে অবিবাহিত মেয়েদেরকে তখনকার সমাজ স্বীকৃতি দিতো না, ফলে তাদের আশ্রয় হতো পতিতালয়ে। সেইন্ট নিকোলাস যখন দরিদ্র লোকটির দুরবস্থার কথা জানতে পারলেন, তিনি এই তিন মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করেন। কিন্তু প্রকাশ্যে সাহায্য না করে বরং পরিচয় গোপন রেখেই সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। যখনই কোন কন্যার বিয়ের কথা পাকা হতো, তিনি রাতের অন্ধকারে এক থলি ভর্তি স্বর্নমুদ্রা জানালা দিয়ে ছুড়ে দিতেন। এভাবে পরপর দুই মেয়ের বিয়েতে তিনি সাহায্য করেন, তৃতীয়বার কন্যাদের পিতা এই অজ্ঞাতনামা সাহায্যকারীর পরিচয় জানতে ঘরের বাইরে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, তখন সেইন্ট নিকোলাস চিমনি দিয়ে স্বর্ণমূদ্রা ভর্তি থলে ছুড়ে দেন। আরও কথিত আছে, একবার এক কসাই তিনটি শিশুকে ধরে নিয়ে যায়, তাদের হত্যা করে কেটে মাংস বিক্রি করার পরিকল্পনা করে। সেইন্ট নিকোলাস এই তিনটি শিশুকে উদ্ধার করেন। জেলে, নাবিক ও বণিকদের কাছেও সেইন্ট নিকোলাস অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার মহানুভবতা ও মানুষকে সাহায্য করার গল্প ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

সান্তার কারাবরন ও মৃত্যুঃ

রোমান সম্রাজ্যের প্রচলিত ধর্ম ছিলো প্যাগানিজম। খ্রিষ্ঠান ধর্মের প্রসার তারা মেনে নিতে পারে নি। তাই সেইন্ট নিকোলাসকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। অবশেষে প্রায় পাঁচবছর বন্দী থাকার পর রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন এর আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার মৃত্যুবার্ষিকীতে একে অন্যকে উপহার দেয়ার প্রথা চালু করেন। ১০৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডের প্রাক্কালে একদল নাবিক নিকোলাসের দেহাবশেষ তুরস্ক থেকে ইতালির বারি শহরে একটি মঠে নিয়ে যান। মঠটি ছিল একজন দেবীর, যিনি শিশুদেরকে নানা উপহার দিতেন বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করতেন। নিকোলাস ওই দেবীর জায়গা দখল করেন। শুরুরদিকে জার্মান এবং সেল্টিক ভক্তরা ওডেনের উপাসনা করত। এই ওডেন ছিলেন থর, ব্যালডার ও তিউর পিতা। ওডেনের ছিল লম্বা সাদা দাড়ি এবং তিনি প্রতিবছর শরতের এক সন্ধ্যায় আকাশ থেকে ঘোড়ায় চড়ে নেমে আসতেন। নিকোলাস ধীরে ধীরে ওডেনের জায়গা দখল করেন। তার যে রূপ দাঁড় করায় সেটা হলো বড় সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ, যিনি ভারী শীতের পোশাক পরে বল্গা হরিণটানা স্লেজ গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ান। ১৮০৯ সালে ঔপন্যাসিক ওয়াশিংটন আরভিন (রিপ ভ্যান উইঙ্কেল ও দ্য লিজেন্ট অব স্লিপি’র জন্য বিখ্যাত) নিকারবকার হিস্ট্রি নামে ডাচ সংস্কৃতির ওপর একটা ব্যঙ্গরচনা (স্যাটায়ার) লেখেন। সেখানে তিনি একাধিকবার সেইন্ট নিকোলাসের ডাচ নাম সান্তা ক্লজ- এর উল্লেখ করেন(যিনি বড় সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ এবং ভারী শীতের পোশাক পরে বল্গা হরিণটানা স্লেজ গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ান)। খুব দ্রুতই খিষ্টধর্মানুসারীরা নিকোলাসকে একজন সেইন্ট হিসেবে গ্রহণ করেন এবং প্রচার করেন যে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ নিকোলাস ঘরে ঘরে বাচ্চাদের জন্য উপহার রেখে যান।

তথ্যসূত্রঃ
https://bn.m.wikipedia.org/wiki/

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More