বিশ্বের বুকে এক গভীর ক্ষতস্থান তৈরি করে দিয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো একে অপরের বিপক্ষে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে মানবতা কে করে তুলেছিল বিপন্ন। হিরোশিমা-নাগাসাকি আজও দ্বিতীয় বিশ্বের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আজও তাদের মূল্য দিয়ে যেতে হচ্ছে পারমানবিক বোমার আঘাতের। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের বড় কোন প্রভাব না পড়লেও আমাদের দেশে ই রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এক স্থান। বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন যুদ্ধ সংগঠিত না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে মারা যাওয়া কয়েক শত যোদ্ধার কবর রয়েছে বাংলাদেশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহত এসব যোদ্ধাদের কবর সমূহ বাংলাদেশের দুটি কবরস্থানে বা সিমেট্রিতে রয়েছে। বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুইটি সিমেট্রির মধ্যে একটি কুমিল্লা ও অন্যটি চিটাগাং এ অবস্থিত। চিটাগাং এর ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লার থেকে অনেক বড়। আজ আমরা চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রি সম্পর্কে তুলে ধরব।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি এর ইতিহাস

Source: Wikimedia
চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রির অপর নাম চিটাগাং কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি। এটি মূলত কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন কর্তৃক পরিচালিত একটি সমাধি সৌধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক এই সিমেট্রি প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ১৪ তম পদাতিক বাহিনী চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত এবং এখানে যুদ্ধে আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য ১৫২ তম জেনারেল হাসপাতাল চালু করেছিল। এই হাসপাতালের কার্যক্রম ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চালু ছিল। এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়া মোট ৪০০ জন যোদ্ধা ককে কবর দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের সেভেন সিস্টার্সভুক্ত আসাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে যুদ্ধে মারা যাওয়া অনেক সেনার মরদেহ এখানে স্থানান্তর করে সমাধিস্থ করা হয়। এই সিমেট্রি প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সকল সেনা মারা গেছে তাদের সম্মান জানানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই ওয়ার সিমেট্রিতে দেশের আরও অনেক অস্থায়ী সিমেট্রি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাদের লাশ এনে সমাধিস্থ করা হয়। যে সকল অস্থায়ী সিমেট্রি থেকে লাশ আনা হয় তার মধ্যে রয়েছে চিটাগাং সিভিল সিমেট্রি,চন্দ্রঘোনা ব্যাপ্টিস্ট মিশন সিমেট্রি, চিড়িঙ্গা মিলিটারি সিমেট্রি,কক্সবাজার নিউ মিলিটারি ও সিভিল সিমেট্রি,চিটাগাং বুরিয়াল গ্রাউন্ড,ঢাকা মিলিটারি সিমেট্রি,ডেমাগিরি সিমেট্রি,ধুয়াপোলং মুসলিম বুরিয়াল গ্রাউন্ড,ধুয়াপোলং খ্রিস্টান মিলিটারি সিমেট্রি,দোহাজারী মিলিটারি সিমেট্রি,যশোর প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রি,খুলনা সিমেট্রি, লাংলেহ সিমেট্রি (আসাম),নয়াপাড়া সিমেট্রি (আসাম),পটিয়া সিমেট্রি,রাঙামাটি সিমেট্রি,তেজগাঁও রোমান ক্যাথলিক সিমেট্রি,তুমব্রুঘাট মিলিটারি সিমেট্রি ইত্যাদি।

কবর সংখ্যা
চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রিতে মোট ৭৫৫ টি কবর রয়েছ। ৭৫৫ টি কবরের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর মোট ৭৩১ জন সেনা কবর রয়েছে। কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর বাইরে এখানে একজন নেদারল্যান্ডের নৌবাহিনীর একজন সদস্যদের কবর রয়েছে এবং ১৯ জন জাপানি সেনার কবরও এখানে রয়েছে। কমনওয়েলথভুক্ত যে দেশগুলোর সেনা সদস্যের কবর রয়েছে তার মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেশী সংখ্যক সদস্যের কবর রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া মোট ৪৭১ জন সেনার কবর চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রি তে রয়েছে। এছাড়া অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ২০৭ জন,কানাডার ২৫ জন,অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন, নিউজিল্যান্ডের ১ জন সেনার কবর রয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হন নি এমন চারজন ব্রিটিশ সেনার কবরও এই সিমেট্রিতে রয়েছে। চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রির মোট ১৭ টি কবরের মানুষদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তারা আজও অজানা হয়ে ই চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রি তে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে বিপুল পরিমাণ সেনা সদস্য ই মারা গেছে সেটা চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রির এই অল্প সংখ্যক কবর হতে ই বোঝা যায় কারণ এই অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোন প্রকার আক্রমণ প্রতি আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি তবু এত সংখ্যক সেনার লাশ এই ওয়ার সিমেট্রি তে কবর দেওয়া হয়েছে।

Source: flickr.com
যেভাবে যাবেন
চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রি চিটাগাং বিমানবন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর এবং চিটাগাং বন্দর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দামপাড়ায় অবস্থিত। এই ওয়ার সিমেট্রির সঠিক অবস্থান হচ্ছে ১৯, বাদশা মিয়া চৌধুরী রোড,দামপাড়া, চিটাগাং। এই ওয়ার সিমেট্রি পূর্বে ধানক্ষেত ছিল কিন্তু বর্তমানে এটির উন্নয়ন করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রাম আর্টস কলেজ এবং ফিনলে গেস্ট হাউসের নিকটে অবস্থিত।

Source: cda.gov.bd
এই ওয়ার সিমেট্রিতে চাইলে ঘুরেও আসতে পারেন। আপনি যদি চিটাগাং থেকে যান তাহলে আপনাকে সিএনজি নিয়ে এই ওয়ার সিমেট্রি তে যেতে হবে। তবে স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি খ্রিস্টান কবরস্থান হিসেব পরিচিত। রাস্তা থেকে এই ওয়ার সিমেট্রি ভালো ভাবে দেখা যায় না। ফিনলে গেস্ট হাউসের পিছনে ঢালের গোড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধে আত্মত্যাগ করা সেনাদের কবরস্থান টি অবস্থিত। আপনি যদি চিটাগাং এর বাইরে থেকে গিয়ে চিটাগাং ওয়ার সিমেট্রি দেখতে চান তাহলে আপনাকে প্রথমে বাস,ট্রেন অথবা আকাশপথে চিটাগাং যেতে হবে।তারপর সেখান থেকে ওয়ার সিমেট্রিতে যেতে পারবেন।প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্য সকাল ৭.০০ টা থেকে দুপুর ১২.০০ টা এবং দুপুর ২.০০ টা থেকে বিকাল ৫.০০ পর্যন্ত খোলা থাকে। নির্দিষ্ট এই সময়ের বাইরে অন্য কোন সময় আপনি এই ওয়ার সিমেট্রি তে প্রবেশ করতে পারবেন না।
এই ওয়ার সিমেট্রি টি চারদিক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গল জাতীয় গাছ,ফলজ গাছ এবং বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো। এই বিখ্যাত ওয়ার সিমেট্রির প্রবেশের গেট থেকে কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে সরু পাকা রাস্তা তৈরি করা আছে। ওয়ার সিমেট্রিতে প্রবেশের পর আপনি ৭৫৫ টি কবর ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনীর ৪০০ জন নাবিক এবং ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজের ৬০০০ জন নাবিকের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বঙ্গোপসাগরে ডুবে মারা গেছেন। এই ওয়ার সিমেট্রি তে তাদেরকেও স্মরণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে অসংখ্য সেনা মারা গেছে চাইলে তাদের সকল কে উদ্দেশ্য করে এই ওয়ার সিমেট্রি তে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতে পারেন।
তথ্যসূত্র :
১.http://icwow.blogspot.com/2010/04/chittagong-world-war-cemetery.html?m=1
২. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chittagong_War_Cemetery
৩. https://www.cwgc.org/find-a-cemetery/cemetery/2015700/CHITTAGONG%20WAR%20CEMETERY