বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর – এক অকুতোভয় যোদ্ধা

0

আগে হতে ক্যাপ্টেনের পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সাথে মিলে পাক হানাদারদের সাথে লড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করা। আর্টিলারি বাহিনী উপর্যুপরি গোলা বর্ষণে যখন পাকসেনাদের ঘাঁটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে তখনই ক্যাপ্টেন তাঁর দলবল সহ আক্রমণ চালাবেন।

কিন্তু ১৯৭১, ডিসেম্বরের ১০ তারিখ বাংলাদেশে প্রবেশের পর ১১ তারিখে আর্টিলারি বাহিনীর আসার কথা থাকলেও কোন চিহ্নই ছিল না তাদের। ওয়ারলেসে বারবার আর্টিলারি বাহিনীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হল। এদিকে সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো। পরপর দুইদিন যোগাযোগের অব্যর্থ প্রয়াস। একসময় তাদের পথ চেয়ে না থেকে নিজেই আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৪ তারিখে আক্রমণের শুরুতে পাকবাহিনীর এলএমজি (লাইট মেশিন গান) হতে ছোঁড়া অবিরাম গুলি বর্ষণে মুক্তিবাহিনীর সামনে অগ্রসরে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ওই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন সেই মেশিনগান ধ্বংসের জন্য বাম হাতে ছোট মেশিন গান আর ডান হাতে গ্রেনেড নিয়ে সুকৌশলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন এবং ছুঁড়ে মারেন তাঁর হাতে থাকা গ্রেনেড। সঙ্গে সঙ্গে মেশিন গান পয়েন্ট ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু আরেকটি দোতলা বিল্ডিংয়ে ওঁত পেতে থাকা পাকবাহিনীর স্নাইপার গান হতে ছোঁড়া বুলেট এসে তাঁর কপাল ভেদ করে যায়।

অকুতোভয় এই বীর যোদ্ধার নাম ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মাত্র ২২ বছরে শহীদ হওয়া এই বীরশ্রেষ্ঠের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৭ই মার্চ বরিশাল জেলার, বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে। তিনি ছিলেন মাওলানা আবদুল মোতালিব হাওলাদার ও সাফিয়া খাতুনের জ্যেষ্ঠপুত্র। দাদা আব্দুর রহিম হাওলাদার গ্রামের অত্যন্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জমিদার ছিলেন এবং এলাকার উন্নয়নে অবদানস্বরূপ তাঁর নামানুসারেই গ্রামের নাম দেয়া হয়েছিল রহিমগঞ্জ।

মাত্র ৪ বছর বয়সে পারিবারিক আর্থিক অনটনের কারণে শিক্ষার পাটখড়ি দিতে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো মুলাদি থানায় তাঁর মামার কাছে। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্র পাতারচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মুলাদি মাহমুদজান হাইস্কুল থেকে যথাক্রমে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে তিনি ট্যালেন্ট-পুলে বৃত্তি পান। এসএসসি পাশ করেছিলেন ১৯৬৪ সালে মুলাদি মাহমুদজান হাইস্কুল থেকেই এবং তিনি গণিতসহ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে ভর্তি হন যেখানে খেলাধুলার জন্য তার নামডাক ছিল। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। খেলাধুলার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। কলেজ জীবনেই তিনি পাঠ করেন লেনিন, মাও-তুং, চে গুয়েভারার মতো সংগ্রামী ব্যক্তিদের জীবনী ও রাজনৈতিক দর্শন।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে। তবে এর আগে আর্থিক সমস্যার কারণে প্রকৌশলী হওয়ার এবং চোখের সমস্যার দরুন বিমান বাহিনী হতে বাদ পড়েন। তিনি প্রচণ্ড কম-ভাষী ছিলেন এবং পরোপকারী ছিলেন তাঁর দাদার মতোই। বেতন হতে ২০ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি টাকা শরণার্থীদের সাহায্যার্থে দান করতেন।

১৯৬৮ সালের জুন মাস। তিনি ইঞ্জিনিয়ার কোরে কমিশনড প্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালের নৃশংসতা শুরুর দিকে তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কাবাকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়নে। সেই সময়কালের পৈশাচিক নির্যাতন তাঁকে প্রচণ্ড ভাবিয়ে তুলত, পশ্চিম পাকিস্তানে বসে নৃশংসতার কথা শুনতেন আর ভাবতেন কিভাবে দেশে ফিরে আসা যায়।
তাঁর সহযোগীরাও ভাবছিলেন দেশে ফেরার ব্যাপারে।

Muhammad Ataul Gani Osmani

৩ জুলাই, ১৯৭১ সাল। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আনাম শিয়ালকোটের কাছের সীমানা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। সঙ্গে থাকা সবাই সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাঁদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ হয় তাঁরই বন্ধু ক্যাপ্টেন হামিদের মাধ্যমে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়াতে মোটামুটি রকমের বিপদ ছাড়াই সহজে ফাঁকি দিয়ে পেরিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যেতে সক্ষম হন তাঁরা। সাথে ছিল একটি মাত্র পিস্তল। সেখানে গিয়ে প্রথমেই উপস্থিত হন বিএসএফ ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে। এরপর দিল্লি থেকে কলকাতা। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান হতে চারজন সামরিক অফিসারের উপস্থিতিতে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীদের মনে দারুণ উৎসাহের সঞ্চার হল। মুক্তিযুদ্ধের চীফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী ওয়ারফিল্ড থেকে কলকাতায় এসে এই পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা জানালেন।]

কলকাতা হতেই পাঁচ বীর যোদ্ধাকে পাঠানো হল বিভিন্ন সেক্টরে। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের দায়িত্ব পড়লো ৭ নং সেক্টরে, যোগ দিলেন মেহেদিপুরের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। বয়স তখন ২২-২৩, টগবগে এক যুবক তিনি। পরনের লুঙ্গী, গেঞ্জি। মাথায় বাঁধা লাল গামছা আর পায়ের ক্যানভাসের জুতো দেখে অনেকেই আঁচ করতে পারেনি এই বীর যোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার কতোটা কঠিন ইস্পাতের ন্যায় বলীয়ান, কতোটা দৃঢ় তাঁর মনোবল।

১৯৭১ এর ৩ ডিসেম্বর। যুদ্ধ প্রায় শেষাবস্থায় দখলে থাকা পাকবাহিনীদের বিরুদ্ধে সমানে চলতে থাকলো নিধন লড়াই। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সেক্টরের পাশেই বয়ে চলছে মহানন্দা নদী এবং তার অপর পাশেই শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে পাকবাহিনী। এদের প্রতিহতের দায়িত্বে ছিল তরুণ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মহিউদ্দিন।

১০ শে ডিসেম্বর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে অবস্থান করে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সহকারে দল গঠন করলেন আক্রমণের লক্ষ্যে। পূর্বপরিকল্পনা ছিল ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনী দিয়ে গোলাবর্ষণ করে তাদের দুর্বল করে দিয়ে পরে ওইখানে সম্মুখে আক্রমণ করবেন দলবল নিয়ে। কিন্তু বারবার আর্টিলারি বাহিনীর সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দখলমুক্ত করতে শুরু হল অভিযান।
সময় ছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর ভোররাত। যেহেতু প্রথমের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে তাই সরাসরি আক্রমণ করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনে সহযোদ্ধাদের কাছে জানতে চাইলেন কে কে যেতে ইচ্ছুক তাঁর সাথে … !!! তন্মধ্যে ২০ জন এগিয়ে এলে তাঁদের নিয়েই রওনা দিলেন। ডিসেম্বরের শীতের রাত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় প্রত্যেকের অবস্থা নাজেহাল। কোনোমতে রেহাইচর এলাকা দিয়ে মহানন্দা নদী পাড়ি দিলেন পায়ে হেটে। উত্তর দিক হতে অতর্কিত হামলা শুরু করলেন বেয়নেট দিয়ে আর দ্রুত এগোতে থাকলেন দক্ষিণ দিকে।

Chapai Nawabganj

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পুরো পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলেন আগে হতেই যাতে এই পাশ হতে আক্রমণ চালানোর সময় অপরপাশ হতে কোন গুলিবর্ষণ না হয়।
আক্রমণের এক পর্যায়ে বাকি মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের। এতোটা সাবধানতার পরেও বিধিবাম …!! বাঁধের উপর থাকা কয়েকজন পাকিস্তানি সিভিল আর্মড ফোর্সের সৈন্য মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে যোগ দিলো পাকবাহিনীর সঙ্গে। সাথে-সাথে শুরু হল প্রবল গুলিবর্ষণ।
মুক্তিবাহিনীর ব্যাক-ফুটে যাওয়া দরকার কিন্তু দালানের উপর থাকা এলএমজির প্রবল গুলি বর্ষণে ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

ক্যাপ্টেনের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, মেশিনগান পয়েন্টটা ধ্বংস করাই লাগবে। গোপনে পজিশন থেকে বের হয়ে বাম হাতে এসএমজি আর ডান হাতে গ্রেনেড নিয়ে ছুটে গেলেন আর মেশিনগান লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলেন গ্রেনেড।
মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো মেশিনগান পয়েন্ট। কিন্তু আগে হতেই অন্য দালানে লুকিয়ে থাকা স্নাইপার শ্যুটারের ছোঁড়া গুলি এসে তাঁর কপাল ভেদ করে যায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। সহযোদ্ধারা পিছু হটলেন, কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে চলে গেলেন নিরাপদ দূরত্বে। মেহেদিপুর ক্যাম্পে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মৃতপ্রায় তাঁরা। সবাইকে জানিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেনের শহীদ হওয়ার কথা। দ্রুত সহযোদ্ধারা নিজেদের সামলে উঠে ক্যাপ্টেনের বলিদানের সৎসাহসকে সহায়ক করে আবার আক্রমণ করেন। প্রবল আক্রমণের তোড়ে পাকবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে এবং এরিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের আত্মত্যাগে মুক্ত হল চাঁপাইনবাবগঞ্জ

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর-এর সমাধি

নদীর পাঁড়ে খুঁজে পাওয়া গেলো ক্যাপ্টেনের নিথর দেহ। যথার্থ সম্মানের সহিত তাঁকে সমাহিত করা হল গৌড়ের ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে। ১৪ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদিন। মহানন্দা নদীর বুক ছিঁড়ে বেয়ে চলা প্রত্যেকটা তরঙ্গে আজও মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের আত্মত্যাগের চিত্র ফুঁটে উঠে। বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগেই তাঁর মৃত্যু। দেশমাতৃকাকে বিজয়মালা নিজ হাতে পড়িয়ে দেয়া হল না তাঁর কিন্তু সেদিনের দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিলো আজকের লাল সবুজের এই দেশের স্বাধীন কথন।

 

(বিভিন্ন তথ্যসূত্রের জন্য বিভিন্ন ব্লগ, আর্টিকেল এবং উইকিপিডিয়া হতে সাহায্য নেয়া হয়েছে)

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More