যেই কয়জন রাজনীতিবিদের জীবনী বললেই ২০ শতকের রাজনীতি বিবৃত হবে একজন স্যার উইনস্টন লিওনার্ড স্পেনসার চার্চিল। ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তার শত্রুর অভাব ছিল না। ১৯৬৫ সালে তিনি যখন মারা গেলেন, নিঃসন্দেহে বন্ধু-শত্রু সকলেই ব্যাথিত হয়েছিল। বর্বর নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউরোপকে একত্র করতে পেরেছিলেন তিনিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে তিনি পুরো বিশ্বকে একত্র করার মহান উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন।
১৯৪০ সালের আগে হিটলারের আগ্রাসন যখন বেড়েই চলছিল তখনই তিনি সোচ্চার ছিলেন হিটলারের বিরুদ্ধে। তিনি সর্বপ্রথম “লর্ড অব এডমিরালিটি” পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪০ সালে তিনি মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান।তখন হিটলারের বাহিনী অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া,ডেনমার্ক দখল করে ফেলেছে। এসময় হিটলারের বাহিনী নরওয়ে দখল করার আগেই তার প্রস্তাব ছিল নরওয়েতে সৈন্য মোতায়েন করা। কিন্তু তখনকার প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইন এর বিরোধিতায় তা আর করা হয় নি।পরে যখন হিটলার নরওয়ে দখল করে বসে, চেম্বারলেইন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। পরবর্তীতে অনাস্থা ভোটে চেম্বারলেইন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান।এবং প্রধানমন্ত্রী হন চার্চিল। নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম এর পরে হিটলারের বাহিনী যখন ফ্রান্সে তখন দায়িত্বে এসে রুখে দাড়ান তিনি।
সাচ্চা দেশপ্রেমিক সৈনিক, লেখক কিংবা রাজনীতিবিদ সবদিক দিয়েই চার্চিল ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি দুই-দুইবার গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টায় ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, দ্বিতীয় বার ১৯৫১-৫৫ সালে।
চার্চিলের জীবন নিঃসন্দেহে একটি মহাকাব্য। যে জায়গায় তিনি পৌছতে পেরেছেন তা আর কেউ পারে নি। কেমন ছিল তার জীবনের বিভিন্ন অংশ তাই জানাবো আজ।
২০০২ সালে বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সেরা ব্রাইটন নির্বাচিত হন। এ থেকেই বোঝা যায় হিটলার বিজয়ী এই নেতাকে তার দেশের মানুষ কতটা মনে রেখেছে।বিভিন্ন সময়ে চার্চিলের জীবন নিয়ে বেশ অনেকগুলো ফিল্ম,সিরিজ নির্মিত হয়েছে।তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিচার্ড বারটন,ব্রায়ান কক্স ও গ্যারি ওল্ডম্যান এর মতোন অভিনেতারা।
১৮৭৪ সালের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দাদা জন স্পেনসার চার্চিল ছিলেন ডিউক অব মার্লবোরো। বাবা লর্ড র্যানডল্ফ চার্চিল ছিলেন সম্মানিত সরকারি নেতা। আর মা জেনি ছিলেন নিউ ইয়র্কের মহিলা। এ তো গেল তার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কথা।কিন্তু এমন পরিবারে থেকেও চার্চিলের ছেলেবেলা তেমন একটা সুখকর ছিল না।শোনা যায় বাবা মা নাকি তাকে তেমন সময় দিতেই পারেন নি।
রবীন্দ্রনাথের যেমন স্কুল সহ্য হত না, তেমন না হলেও প্রথম যে দুইটি স্কুলে শিশু উইন্সটন পড়াশোনা করেছেন তাতে যে রেকর্ডস পাওয়া যায় তা মোটেই ইতিবাচক নয়। শিশু চার্চিলের রিপোর্ট এর বেশ অনেক জায়গায় তার নামে অনেক অভিযোগ দেখা যায়। অন্য বাচ্চারা তার জন্য রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। অভিজাত পরিবারগুলোর রীতি অনুযায়ী চার্চিল এবার পড়তে যান একটি বোর্ডিং (হ্যারো স্কুল) স্কুলে।সেখানে গিয়েও তিনি মানিয়ে নিতে পারছিলেন না।এ সময়ের কিছু আবেগপ্রবণ চিঠি পাওয়া যায় যেখানে তিনি তার মা বাবাকে স্কুলে এসে দেখা করবার জন্য আকুল আবেদন জানান, কিন্তু র্যানডলফ দম্পতি খুব কম সময়ই সেখানে যেতে পেরেছিলেন।বাবার সাথে উইনস্টন এর সম্পর্ক তেমন একটা ভাল ছিল না।বাবা র্যানডল্ফ চার্চিল উইন্সটনকে মোটামুটি ব্যর্থ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।১৮ বছর বয়সে উইন্সটন চার্চিল ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসেন,এসময় কোমায় ছিলেন প্রায় তিনদিন।
কোন কিছুতেই তিনি ভাল করতে পারছিলেন না জন্যে এসময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।তিনবার পরীক্ষা দিয়ে তিনি রয়েল মিলিটারি কলেজে ভর্তি হতে পারেন।কিন্তু এখানে শেষটা বেশ ভালই ছিল বলা যায়।মূলত এ সময়ই তার প্রতিভা বের হয়ে আসতে শুরু করে।সেনাবাহিনীর প্রায় প্রতিটি কার্যেই তিনি অগ্রগামী ছিলেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে উইন্সটন তার নামের চার্চিল অংশের সার্থকতা প্রমাণ করেন।দক্ষিণ আফ্রিকায় শত্রুবাহিনীর হাত থেকে তিনি পালালে তার মাথার দাম ২৫ পাউন্ড ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই চার্চিল নিজ দেশে অক্ষত ফিরে আসতে সমর্থ হন।লেখক প্রতিভার অনেকটা প্রকাশ ঘটেছিল সৈন্য থাকা অবস্থায়ই।পাঁচ বছরের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনটি বই তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।(স্টোরি অব দি মালাকান্দ ফিল্ড,রিভার ওয়ার,লন্ডন টু লেডিস্মিথ ভায়া প্রিটোরিয়া)। স্কুলে ভাল করতে না পারা,মিলিটারী স্কুলে তিনবারে ভর্তি হওয়া ছেলেটা যে ওয়াশিংটন পোস্টের মত প্ত্রিকার রিপোর্টার হবে কে জানত!!
১৯০০ সালে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে কনজারভেটিভ পার্টির ব্যানারে উইন্সটন চার্চিল পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।সৈন্যের উর্দি ছেড়ে তিনি নিজেকে রাজনীতিতেই নিয়োজিত করেন।এরপরে ১৯০৪ সালেই হঠাৎ তিনি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির বিপক্ষে গিয়ে লিবারেল পার্টিতে যোগদান করেন।কনজারভেটিভ পার্টি তাকে উপাধি দেয় “ব্লেইনহেম র্যাট”।এরপরে একে একে উলটাতে থাকে ইতিহাসের পাতা।
লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় যায়, উইন্সটন চার্চিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন,এরপর হন প্রথম লর্ড অব দ্য এডমিরালিটি।ব্রিটিশ নেভীতে এভিয়েশন এর প্রচলন ঘটাতে তার আগ্রহ ছিল সীমাহীন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ গালিপোলির যুদ্ধে তার করা করা প্ল্যান একদম মাঠে মারা যায়। এসময় তিনি পদত্যাগ করেন ১৯১৫।তিনি আবার মন্ত্রিত্বে ফিরে যান লয়েড জর্জের সরকারে।কিন্তু ১৯২২ সালে আবার তাকে পূর্বের দল কনজারভেটিভ পার্টিতে ফিরে আসতে হয়।তার বাবা মেধাবী রাজনীতিবিদ হয়েও ছিলেন ব্যর্থ কিন্তু চার্চিল ছিলেন বেশ সফল।আমরা চার্চিল কে চিনি দুবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে,নোবেল বিজয়ী হিসেবে। জাতিসংঘ গঠনে তার বেশ অবদান আছে।কিন্তু বেশ কিছু ব্যাপার নিয়ে চার্চিলের কিছু খলনায়কির উদাহরণ ও আছে।
সারাটা জীবন জুড়েই চার্চিল ভারত স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন।মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তার চক্ষুশূল।তিনি প্রকাশ্যে ভারতবর্ষের প্রতি তার ঘৃণা প্রদর্শন করতেন।ভারতে কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তাব ছিল তারই করা।একজন মার্কামারা বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করে গেছেন। মেসোপটেমীয় যুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহারের প্রস্তাব করে তিনি হয়েছেন সমালোচিত, পরিচয় দিয়েছেন নিজের ভিতরের পশুত্বের।তার সিদ্ধান্তের কারণেই কেনিয়ায় দেড় লক্ষ মানুষ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অত্যাচারিত হয়েছে।আফগানিস্তান এ একের পর এক পশতু গ্রাম গুলো গুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা।
তার এই নৃশংস মনোভাবের কারণ খুজতে যাওয়া যেতে পারে গভীরে। ছেলেবেলার অনাদর আর কঠিন আঘাত গুলো তার চিন্তা চেতনাকে পরিণত বয়সে করে ফেলেছিল বিকৃত।
প্রায় ২০টি বইয়ের লেখক চার্চিল ১৯৫৩ সালে(দ্য হিষ্ট্রি অব সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ৫০০টি পেইন্টিং এর জনক চার্চিল পেইন্টিং শুরুই করেন ৪০ বছর বয়স থেকে।কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি তিনি তা রপ্ত করে ফেলেন।যে বছর তিনি নোবেল পান সে বছরই রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর কাছে নাইটহুড পান চার্চিল।
জীবনের শেষ কটা দিনে তিনি আলঝেইমার্স রোগে ভুগেছিলেন।১৯৬৫ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।তার মৃত্যুতে পুরো বৃটেন শোকাহত হয়ে গিয়েছিল।চার্চিলের অনুসারীরা চার্চিলের মৃত্যুর পরে ইন্টারন্যাশনাল চার্চিল সোসাইটি গঠন করে।তারা বিভিন্ন ভাবে এখন চার্চিলকে স্মরণ করে।তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন
winstonchurchill.org থেকে।