হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব দেশ ইসলামের দীপ্ত আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে। তাঁর জীবদ্দশায় আরবের দূরবর্তী অঞ্চল গুলোয় ইসলামের প্রচার ও প্রসার না হলেও তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধীকারীগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বিজয় পতাকা বহন করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম শতকের শুরুতেই ইসলাম ইউরোপের সমগ্র স্পেন, উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে ইসলাম পৃথিবী ব্যাপী প্রসার লাভ করতে থাকে।
খলিফা হযরত ওমর রাঃ এর খেলাফতের সময় মুসলমানগন প্রথম ভারত বিজয়ের চেষ্টা করে, দূরাভিযানের বিপদ ও নানা অসুবিধার জন্য তখন অভিযান সাফল্যের মুখ দেখেনি। খিলাফাতের পর উমাইয়া শাসনামলে উমাইয়া বংশের শাসক খলিফা আল ওয়ালিদের ক্ষমতা লাভের পর আরবের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হয়। আরব সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ বিন কাসিম কে ভারতের সিন্ধু ও মুলতান প্রেরণ করে ভারত উপমহাদেশ জয়ের দ্বার উম্মোচন করেন।

Source: FeedYeti.com
মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সিন্ধু অভিযানের কারণ কি ছিল?
অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে মুসলমান সাম্রাজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। মুসলমানদের রাজ্যসীমা বিস্তৃত হতে হতে ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু রাজা দাহিরের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। প্রথমত, আরব মুসলিম সৈন্য পারস্য অভিযান করতে গেলে ভারতীয়রা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারস্যবাসীকে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, প্রাচ্য খেলাফাতের হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনকালে হাজ্জাজ বিরোধী বিদ্রোহী মুসলমানদের অনেককে সিন্ধু রাজা দাহির আশ্রয় দিয়েছিলো। এসব কারণে আরব মুসলিমরা সিন্ধু রাজা দাহিরের উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিলো।
এসব কারণে ভারতীয়দের উপর মুসলমানরা ক্ষিপ্ত থাকলেও নানান প্রতিকূলতায় ভারত অভিযান সম্ভব হয়নি। ওমর (রা.) এর সময় ভারত অভিযানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এমন সময়ে আরব সাম্রাজ্যের খলিফার জন্য সিংহল রাজ কর্তৃক উপঢৌকন দিয়ে ৮টি জাহাজ প্রেরণ করে। এ ৮ টি জাহাজ ভারতের সিন্ধু প্রদেশের দেবল বন্দরে জলদস্যু দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দাহিরের নিকট লুণ্ঠন হওয়া ৮ টি জাহাজের ক্ষতিপূরণ দাবি করলে দাহির নাটকীয়ভাবে এর ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দাহির জলদস্যুদের তার শাসনের বহির্ভুত ও শাস্তি দানে অক্ষম বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

Source: ThePinsta
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দাহিরের উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে খলিফা ওয়ালিদ থেকে সিন্ধু প্রদেশ আক্রমণের অনুমতি গ্রহণ করেন। প্রথমে ওবায়দুল্লাহ ও পরে বুদাইল কে সেনাপতি করে পরপর দুটি অভিযান প্রেরণ করলেও দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। ওবায়দুল্লাহ ও বুদাইল দু’জনই নিহত হয়। পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হাজ্জাজ দু’বার ব্যর্থ হয়েও হাল ছেড়ে দেন নি। সিন্ধুবাসীদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি তার স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিম কে তৃতীয় অভিযানের সেনাপতি করে সিন্ধু প্রেরণ করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন ভারতের সিন্ধু অভিযানে বের হন, তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। ১৭ বছরের যুবক কে সেনাপতি করে হাজ্জাজ ৬ হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য সহ সিন্ধু প্রদেশ প্রেরণ করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম ইরানের পথ হয়ে মাকরানের মধ্যে দিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে মাকরানের সেনাবাহিনী ও হিন্দু শাসকদের অবিচারে বিক্ষুব্ধ জাঠ ও মেঠদের সাহায্য গ্রহণ করেন। ৭১১-১২ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্দুর দেবল বন্দরে উপস্থিত হন।
দেবল বন্দরের অপরদিকে কাসিম কে সাহায্যার্থে আরেকটি যুদ্ধাস্ত্রসহ জাহাজ উপস্থিত হয়৷ এদিকে মুসলমান সেনাবাহিনী ‘বলিস্ত’ নামক এক প্রস্তর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করে দেবল বন্দর ধ্বংস করে দেন। ব্রাক্ষন ও রাজপুত বেষ্টিত এ দেবল অঞ্চলের পতন ঘটলে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিন্ধু প্রদেশের দিকে অগ্রসর হন।

Source: Chandragupta’s India
পথিমধ্যে নিরুন , সিওয়ান সহ আরো কয়েকটি দুর্গ মুহাম্মদ বিন কাসিম জয় করেন। এ সময় ভারতীয় সাধারন হিন্দু সিন্ধু রাজদের শাসনে অতিষ্ট হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধীনতা স্বীকার করেন। এরপর রাওয়ার নামক স্থানে মুসলমান সৈন্যগণ সিন্ধু রাজা দাহিরের নিকট প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। ৭১২ খৃষ্টাব্দে রাওয়ারে মুহাম্মদ বিন কাসিম ও দাহিরের মাঝে তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে রাজা দাহির পরাজিত ও মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুতে অন্যান্য সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। রাজা দাহিরের স্ত্রী অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সিন্ধু জয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম মুলতানের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে হিন্দুদের সাথে এক যুদ্ধ সংগঠিত হয়, কাসিম মুলতান অধিকার করেন। ব্রাক্ষ্মণাবাদ ও দখল করে নেন। হিন্দুরা ব্রাক্ষ্মণাবাদ রক্ষার্থে প্রাণপণ লড়াই করেছেন, মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। মুলতান ও ব্রাক্ষ্মণাবাদ জয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু ও পাঞ্জাবের সিন্ধু উপত্যকাস্থ অঞ্চলটি অধিকার করেন।

Source: YouTube
সিন্ধু বিজয়ে মুসলমানদের সাফল্য
সিন্ধু বিজয়ের ফলে মুসলমানদের আসলে কোন অর্জন হয়েছিলো কি না, এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে তর্ক বিতর্ক রয়েছে। কারণ তাৎক্ষনিক সিন্ধু বিজয়ের পর মুসলমানরা ভারতের রাজনীতিতে স্থায়ী কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মুসলমানদের পরবর্তী ভারত অভিযানের পথ কিছুটা উম্মুক্ত হয়েছে বলে বলা যায়।
সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল বিবেচনায় আধুনিক ঐতিহাসিক স্টেনলি লেন-পুল বলেন, “ভারতবর্ষ ও ইসলামের ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু বিজয় একটি উপাখ্যান বিশেষ। ইহা একটি নিষ্ফল বিজয়”। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, কারণ সিন্ধু বিজয় ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তেমন পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি। মুহাম্মদ বিন কাসিম এর এ বিজয় সিন্ধু ও মুলতানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এছাড়া সিন্ধু রাজ দাহির পরাজিত হলেও ভারতের হিন্দুশক্তি, রাজপুত শক্তি মুহাম্মদ বিন কাসিমের আনুগত্য স্বীকার করে নাই। ভারতে তখন আরব অধিকার অতি ক্ষুদ্র অংশে বিস্তার লাভ করে।

Source: Dunya Blogs – Dunya News
এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক দিক থেকে সিন্ধু বিজয় সুদুরপ্রসারী ফলাফল না আনলেও সাংস্কৃতিক ভাবের আদান প্রদানের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। মুসলিম সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার আচরণের প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশে লক্ষ্য করা গিয়েছে। যদিও বিস্তৃতভাবে ইসলাম প্রচার করা মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষে সক্ষম হয়নি। কিন্তু পরবর্তী মুসলিম শাসকদের ভারত অভিযানের পথ খুলে দিয়েছে সিন্ধু বিজয়। ভারতের সাথে আরবের বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়। এছাড়াও অনেকেই মনে করে, সিন্ধী ভাষায় আরবের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সিন্ধী ভাষার অনেক শব্দ আরবী ভাষা থেকে নেয়া হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন, সুদুরপ্রসারী ভারতে মুসলমানদের প্রবেশে এ বিজয় ভুমিকা রাখে। তাৎক্ষণিক ভাবে মুসলমানরা ভারতে স্থায়ী হতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে সুলতান মাহমুদ থেকে অন্যান্য মুসলিম বিজেতার আগমনের দ্বার উম্মোচন করে মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই সিন্ধু ও মুলতান বিজয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু মর্মান্তিক ঘটনা হলেও তার মৃত্যু নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী প্রচলিত আছে। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দাহিরের দু’কন্যা সূর্যদেবী ও পরিমলদেবী কাসিমের হাতে অপমানিত ও লাঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ খলিফা কে জানান। খলিফা কাসিমকে বস্তায় বন্ধী করে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন৷ কাসিমের মৃত্যুর পর দাহিরের দু’কন্যা তাদের ছলচাতুরি প্রকাশ করেন। এ ঘটনাকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ ভিত্তিহীন তথ্য বলে উড়িয়ে দেন।
আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক ঐক্যমত পোষন করে বলেছেন, কাসিমকে রাজধানী দামাস্কাকে আহবান করে কারারুদ্ধ করে খলিফার আদেশে হত্যা করা হয়। সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু যেভাবেই হোক, তার উত্থানের মত পতনও ইতিহাসের এক নাটকীয় ঘটনা।