সাম্রাজ্যবাদী আধুনিক বিশ্বে এক বিপ্লবী হলেন হুগো শ্যাভেজ ফ্রিয়াস, যিনি আমৃত্যু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল অবধি ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এই বিপ্লবী নেতা। কেমন ছিল তাঁর এই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন? এবং কিভাবেই বা তিনি একজন বিপ্লবী থেকে হয়ে উঠলেন একটি রাষ্ট্রের প্রধান? এই সব প্রশ্নের উত্তরই খুঁজবো আমাদের এই আয়োজনে।
প্রথমে জেনে নেই হুগো শ্যাভেজের শৈশব সম্পর্কে-
জন্ম এবং বাল্যকাল:
১৯৫৪ সাল, ২৪ জুলাই, ভেনিজুয়েলার দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট শহর সাবানেতা, বারিনাস জন্মগ্রহণ করেন হুগো শ্যাভেজ। তাঁর পুরো নাম হুগো রাফায়েল শ্যাভেজ ফ্রিয়াস। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা হুগো শ্যাভেজ ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং মা এলিনা শ্যাভেজও ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা।

শ্যাভেজরা ছিলেন ছয় ভাই, এই ছয় ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ তাঁর দরিদ্র স্কুল শিক্ষক বাবা মায়ের পক্ষে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছিল না। আর তাই তিনি এবং তাঁর বড় ভাই বারিনাসে তাঁর দাদি রসা ইনেস শ্যাভেজ-এর কাছে চলে যান এবং তিনিই হুগোকে প্রথম ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ভালবাসতে শিখান। আর এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে বলিভার এবং কার্ল মার্ক্স এর শিক্ষার সাথে পরিচিত হন।
এবার আসা যাক তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে-
প্রাক-রাজনৈতিক জীবন:
১৯৭১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে মিলিটারি একাডেমীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এর র্যাংক পড়েন। সেখানে তিনি মিলিটারি সাইন্স এর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। সামরিক জীবনে এই কর্নেল ১৯৯১-৯২ সালে প্যারাসুট ব্যাটেলিয়ন এর দায়িত্ব বহন করেন। ১৯৮২ সালে দুইজন ক্যাপ্টেন এর সাথে গড়ে তোলেন জাতীয়তাবাদী এবং বাম সংগঠন ‘বলিভিয়ান রেভোলিউশনারি মুভমেন্ট’।

১৯৮৯ এর অর্থনীতিক বিপদ কাটিয়ে উঠার জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেজ পেরেজ আইএমএফ এর সাথে চুক্তি করেন এবং কারাকাসের বিরোধীদের সামরিক চাপে ফেলেন। এতে করে আর্মির মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে ১৯৯২ তে শ্যাভেজের নেতৃতে সরকার পতনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, যার ফলে শ্যাভেজ কারাগারে চলে যান।
রাজনৈতিক জীবন :
১৯৯৩ এর মে মাসে কার্লোস পেরেজ কে পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে দেয়। ১৯৯৪ তে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কালদেরা জেল থেকে শ্যাভেজ কে মুক্তি দেন। এবং এই সময়ই আর্মি জীবনের পাট চুকিয়ে শ্যাভেজ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ফিফথ রিপাবলিক মুভমেন্ট গঠন করেন।

ভেনিজুয়েলার মতো একটি তেলসমৃদ্ধ দেশে সেই সময় ৩%জন মানুষ ছাড়া ৮০% ই বাস করতো দরিদ্র সীমারেখার নিচে। শ্যাভেজ তার প্রতিটি ভাষণেই সরকারের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার নিন্দুকেরা তাকে খালি কলসি হিসেবে অভিহিত করেন কিন্তু তার কথার সত্যতা জনগণকে নাড়া দিয়ে যায়।
প্রেসিডেন্সি হুগো শ্যাভেজ:
বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ‘ফিফথ রিপাবলিক মুভমেন্ট’ এর প্রধান হিসেবে শ্যাভেজ তার মনোনয়ন জমা দেন।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮ এর নির্বাচনে ৫৬.২% ভোট পেয়ে শ্যাভেজ জয়যুক্ত হোন। নতুন সংবিধান প্রস্তুত করার পর ২০০০ সালের জুলাই মাসে তিনি পুনঃ নির্বাচিত হোন।

দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১১ এপ্রিল, ২০০২ শ্যাভেজ সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক–বেসামরিক সম্মিলিত অভ্যুত্থান এর মাধ্যমে পেদ্রো কামোনা প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেন। তার ঠিক দুদিন পরেই আর্মির একাংশের সহযোগিতায় শ্যাভেজ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ডিসেম্বর ২০০২ থেকে মার্চ ২০০৩ পর্যন্ত দেশব্যাপী চলে অস্থির অবস্থা।
২০০৪ সালে জনগণের আস্থা ভোটে জয়লাভ করে শ্যাভেজের দল। ফলে আবার শান্তি ফিরে আসে।

তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট :
২০০৬ এর নির্বাচনের সুযোগে শ্যাভেজ বিরোধীরা সবাই একজনকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়ে ওঠেন। তিনি সোশাল ডেমোক্রেট এর ম্যানুয়েল রোজালেস। কিন্তু ৭০% ভোটারের অংশগ্রহণে হওয়া ভোটে ৬৩% ভোটই যায় শ্যাভেজের পক্ষে।

নির্বাচনে জয়লাভের পর শ্যাভেজ ২১ শতকের উপযোগী এক সমাজতান্ত্রিক নেতা হয়ে ওঠেন। যার অংশ হিসাবে তিনি বিভিন্ন কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সংবিধানে পরিবর্তনের মাধ্যমে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রাখার প্রস্তাব করেন কিন্তু জনগণের রোষানলে পরে তা ব্যর্থ হয়।

২০১২ সালের নির্বাচন :
ফলশ্রুতিতে ২০১২ সালের ৭ অক্টোবরের নির্বাচনে তিনি আবারো অংশগ্রহণ করেন। ডেমোক্রেটিক ইউনিটি রাউন্ড টেবিল এর হেনরিক কেপরিলস পান ৪৪.১৩% ভোট যেখানে গ্রেট প্যাট্রিওটিক পোল এর শ্যাভেজ পান ৫৫.২৫% ভোট।

নির্বাচনের এই ফলে মূল ভূমিকা রাখে – সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা সুবিধার সহজলভ্য করন সহ নানাবিধ কাজ। তিনি তার ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেন মাদুরো কে। শ্যাভেজের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তিনি শপথ নিতে সময় চান। কিন্তু ৫ মার্চ ২০১৩ তিনি পরলোকগমন করলে চতুর্থ দফায় সেই শপথ আর নেয়া হয়ে ওঠে না তার।

“সবার জন্য খাদ্য ” ছিল হুগো শ্যাভেজের জনপ্রিয়তার মূলমন্ত্র। যে খাদ্য তিনি জোগান দিতেন তেল বিক্রির অর্থ থেকে আমদানি করে। দেশে পণ্যের দাম নির্ধারিত করে দেয়ায় তার দেশের চাষিরা চাষ কাজে নিরুৎসাহিত হয়ে ওঠে। বর্তমান বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় ভেনিজুয়েলা এবং মাদুরো এক নতুন চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন।