কনফুসিয়াস ছিলেন একজন প্রভাবশালি চাইনিজ দার্শনিক, শিক্ষাগুরু এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর নীতিবচন এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার গঠনের জন্য। তিনি ছিলেন কনফুসিয়ানিসম এর প্রতিষ্ঠাতা, নৈতিক এবং দার্শনিক এক পদ্ধতি যার অনুসারীদের এখনও চীনে খুঁজে পাওয়া যায়। ধরা হয়, বিখ্যাত এই চীনে দার্শনিক বেশ কিছু চাইনিজ ক্লাসিক লেখার লেখক অথবা সম্পাদক ছিলেন, তবে আধুনিক পণ্ডিতদের মনে এই বিষয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে যে তিনি আসলেও সেই লেখাগুলোর লেখক/সম্পাদক ছিলেন কি না। তবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তাঁর প্রদত্ত দর্শন অনেকগুলো শতক ধরে চীনের চিন্তাধারার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কে ছিলেন কনফুসিয়াস?
কনফুসিয়াস এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালে। কনফুসিয়াস নামটি মূলত চাইনিজ নাম “কং ফুজি”(মাস্টার কং) এর ল্যাটিনাইজড রূপ যার উদ্ভাবন ঘটায় কিছু জেসুইট মিশনারি, ১৬শ শতাব্দীর কোন এক সময়ে। চাইনিজ ভাষায় এই দার্শনিককে সাধারণত ডাকা হয় “কংজি” নামে। তবে তাঁকে “দ্য মাস্টার”, “ফার্স্ট টিচার”, “মডেল টিচার ফর টেন থাউসেন্ড এজেস” এবং “দ্য লডেব্লি ডিক্লেয়ারেবল লর্ড নি” হিসেবেও ডাকা হয়।

Source: Shanghai Mindfulness
ধারণা করা হয়, কনফুসিয়াস এর জন্ম হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালে, যোউ জেলায়, বর্তমান কুফু, চীন এর নিকটবর্তী এলাকায়। তাঁর বাবা নাম কং হি বা শুলিয়াং হি, যিনি ছিলেন স্থানীয় লু গ্যারিসনের প্রবীণ সেনানায়ক। যখন কনফুসিয়াসের ৩ বছর বয়স, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে। দারিদ্র্যের মধ্যে কনফুসিয়াসকে বড় করেন তাঁর মা ইয়াং ঝেংজাই আর ৪০ বছরের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯ বছর কনফুসিয়াস বিয়ে করেন কিগুয়ান নামের এক নারীকে এবং একবছর পর এই দম্পতির ১ম সন্তান হয়, যার নাম রাখা হয় কং লি। কিগুয়ান এবং কনফুসিয়াস পরবর্তীতে একসাথে দুই কন্যাসন্তানের পিতামাতা হন। ধারণা করা হয়, দুই কন্যার মধ্যে একজন শৈশবেই মারা যায়।
কনফুসিয়াসের জন্ম হয়েছিল “শি” গোষ্ঠীর মধ্যে, যা ছিল উচ্চবিত্ত এবং সাধারণ জনগণের মধ্যবর্তী গোষ্ঠী। ধারণা করা হয়, কনফুসিয়াস ত্রিশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি কাজে নিয়োজিত ছিলেন, ছিলেন বই সংরক্ষক এবং ঘোড়া ও ভেড়ার তত্ত্বাবধায়ক। যখন তাঁর মা মারা যান, রীতি অনুযায়ী কনফুসিয়াস তিন বছর পর্যন্ত শোক পালন করেছিলেন।

কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক জীবন
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর চীনের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অপসরণ কনফুসিয়াসের জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তখন আনুষ্ঠানিক ভাবে চোউ রাজবংশের উপর পুরো চীনের শাসনভার থাকলেও বাস্তবে চোউ রাজবংশের ভিতরে নিজেদের মধ্যেই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কনফুসিয়াস যে রাজ্যে বাস করতেন তার শাসক ছিলেন একজন ডিউক। যার অধীনে ছিল তিনটি সম্ভ্রান্ত পরিবার- মেং, জি এবং শু। লু রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল এই তিন পরিবারের হাতে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০১ সালে এই তিন পরিবার একজোট হয়ে ডিউক ইয়াং হু কে সরিয়ে দেয়।

কিন্তু তার পরপরই জি পরিবারের কর্মচারী গংশান ফুরাও লু রাজ্যের রাজধানী দখল করে নেয়। গংশান ফুরাওই কনফুসিয়াসকে নিজের শাসনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন, কিন্তু কিছু বিষয় বিবেচনা সাপেক্ষে এই দার্শনিক অস্বীকৃতি জানান। একই বছরে এই দার্শনিক একটি বৈধ সরকারের অধীনে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি মন্ত্রী পদে উন্নীত হন। গবেষকদের মতে, কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক পদোন্নতির পেছনে তিন পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জি পরিবারের হাত ছিল। গবেষকেরা এও ধারণা করেন যে, কনফুসিয়াস মূলত এই তিন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ক্ষমতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে কাজ করছিলেন। এই ধারণা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, কনফুসিয়াস তিনটি পরিবারের ক্ষমতার দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি তিন পরিবারের কাছ থেকে এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতি নিতে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত মং পরিবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
কনফুসিয়াসের নির্বাসন
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৭ সালে রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কনফুসিয়াস নিজে থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লু রাজ্য ত্যাগ করে কেন্দ্রীয় এবং উত্তরপূর্ব চীনের সং রাজ্য, কাই রাজ্য, চেন রাজ্য এবং ওয়েই রাজ্যের মধ্য দিয়ে ভ্রমন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ সালে তিনি বৃদ্ধাবস্থায় লু রাজ্যে ফিরে আসেন এবং সকলে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি সুখে থাকতে পারেননি। তিনি নিজের ছেলে এবং প্রিয় শিষ্য ইয়েন হু কে হারান। সম্ভবত প্রিয় শিষ্য ও প্রিয় পুত্র হারানোর শোক এবং নিজের রাজনৈতিক ধারণা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার কারণে কনফুসিয়াস ৭১ কি ৭২ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

কনফুসিয়াসের বিশ্বাস, দর্শন এবং শিক্ষা
কনফুসিয়াসের মৃত্যুর ঠিক পরপরই তাঁর অনুসারীরা কনফুসিয়াসের তত্ত্বগুলোর সংগ্রহ একত্র করে তাঁর চিন্তাধারার গুরুত্ব সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। তত্ত্বগুলো মূলত ছিল অনুসারীদের সাথে এবং কিছু শাসকদের সাথে কনফুসিয়াসের কথোপকথন। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষার উপরে নিজের বেশ কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেগুলো নিচে দেয়া হল-
দ্য গোল্ডেন রুল
কনফুসিয়াসের সামাজিক দর্শনের মূলে ছিল “রেন” বা “পারস্পরিক ভালবাসা”র সাথে সংযমের চর্চা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গোল্ডেন রুল ব্যবহারের মাধ্যমে রেন কে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই বিষয়ে তিনি বলেন,”তুমি নিজের জন্য যা চাও না, অন্যের জন্যেও তা আশা করোনা।“(লুনিউঃ ১২.২, ৬.৩০)
রাজনীতি বিষয়ে
কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল অনেকটা আত্মসংযমের উপর নির্ভরভিত্তিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন জননেতার উচিত আত্মসংযমের চর্চা করা যাতে করে সে নিরহঙ্কার থাকতে পারে এবং নিজ অনুসারীদের প্রতি দয়াশীল হতে পারে। এভাবে ইতিবাচক উপায়ে একজন নেতা নিজ জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

Source: Alamy
শিক্ষা বিষয়ে
কনফুসিয়াসের শিক্ষা বিষয়ক দর্শন ৬ টি বিষয়ে শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করে। ধনুর্বিদ্যা, ক্যালিগ্রাফি, গণনা, সংগীত, রথ চালনা এবং আচার-অনুষ্ঠান। কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন যে, একজন শিক্ষকের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষকে ন্যায়পরায়ন পথে চালনা করা। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি চীনের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, ন্যায় আচরণ এবং আচার অনুষ্ঠানের রীতিনীতি পুনরায় জাগিয়ে তোলেন।
কনফুসিয়ানিজম
কনফুসিয়ানিজমের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়- ঐতিহ্য, দর্শন, যুক্তি এবং মানবিকতার সংমিশ্রিত ধর্ম, রাজ্য চালনার একটি পন্থা বা সাধারণ অর্থে নম্রভাবে জীবন যাপনের পথ। কনফুসিয়ানিজম প্রতিষ্ঠিত কোন ধর্ম নয়, এর কিছু নিয়ম রয়েছে যার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের জন্য ভালবাসা, পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান প্রদর্শন এবং নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। কনফুসিয়ানিজম প্রসার ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে চীনে ১ম হান বংশের রাজত্বের সময়। এখন পর্যন্ত চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে কনফুসিয়ানিজম এর চর্চা রয়েছে।
কনফুসিয়াসের বিখ্যাত কিছু উক্তি
কনফুসিয়াসের অনেকগুলো বিখ্যাত উক্তির মাঝে কিছু উক্তি এরকম,
- আমি এই কারণে বিব্রত না যে আমার কথা কেউ বুঝতে পারেনা। আমি তখন বিব্রতবোধ করি যখন আমি অন্যকে বুঝতে পারি না।
- বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য করে নিজেকে গড়ে তোলো। এই বিষয়গুলোতে তোমার থেকে নিচু কারো সাথে মিত্রতা করোনা। যখন কোন ভুল করবে, সেই ভুলকে সঠিক করে নিতে ভয় পেয়ো না।
- নিজে যা শিখেছ তা পর্যালোচনা করা এবং নতুন কিছু শেখা, এই দুই যদি তোমার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি একজন শিক্ষক হবার জন্য উপযুক্ত।
- একজন ঊর্ধ্বস্থ ব্যক্তি সকলকে আপন করে নেয় এবং পক্ষপাতী নয়। একজন নিচু ব্যক্তি পক্ষপাতদুষ্ট এবং সকলকে আপন করে নিতে পারেনা।
- পড়াশুনা করে চিন্তা না করা অপব্যয়। চিন্তা করে পড়াশুনা না করাটা বিপজ্জনক।
- নিজের সন্দেহ দূর করার জন্য মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠো এবং সাবধানে নিজের বক্তব্য পেশ কর এবং এভাবে তোমার ভুল কম হবে।
- সাবধানী লোকের ভুল কম হয়।