২০১৩ সালের কথা। ডিসেম্বরের ১৭-১৮ হবে। আমার এক বন্ধু এসে বলল, “কিরে? ‘চাঁদের পাহাড়’ মুভিটার ট্রেইলার দেখেছিস? না দেখলে এই নে।”
ট্রেইলার দেখে আমি তো পুরো থ। বাংলায় এই প্রেক্ষাপটে ছবি বানানো যেতে পারে, আমি ভাবিনি এর আগে। ট্রেইলারের শেষ দিকে গিয়ে রিলিজিং ডেট দেখালো আরও কিছুদিন পর। মানে ভাল প্রিন্ট হাতে আসতে আসতে আরও প্রায় ২-৩ মাসের ধাক্কা। আমার যেন তর সইছিল না আর। যতটা না মুভিটা দেখার জন্য, তার থেকে বেশি কাহিনীটা জানার জন্য আগ্রহ হচ্ছিল বেশি। ট্রেইলারের একদম শেষ দিকে একটা লাইন পড়ে আমি একটু হোঁচট মত খেলাম। ভুল দেখিনি তো? আবার রিওয়াইন্ড করে দেখলাম। নাহ, ঠিকই দেখেছি প্রথমবার। গুগল করলাম। নাহ। এইখানেও তা ই লেখা।
“চাঁদের পাহাড় ছবি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে।” বাঙ্গালী লেখক……তাঁর এডভ্যাঞ্চার কাহিনী, তাও আবার আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে? আমি ততদিনে স্যার হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডে মজেছি বেশ। এলান কোয়ার্টারমেইনের সাথে আফ্রিকার বনে বাদারে ঘুরে বেড়াই। জুলুল্যান্ডের যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করি। আমার কাছে অন্য কোনো এডভেঞ্চার কাহিনী লেখককে এতটা আহামরি মনে হবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। এর আগে পথের পাঁচালী পড়েছি; পড়েছি অপরাজিতও। ওগুলো বেশ লেগেছে। তবে ওদুটোর জনরা (genre) তো আলাদা। এগুলোর সাথে কি আর এডভ্যাঞ্চারের তুলনা চলে!
লাইব্রেরীতে খোঁজ নিলাম। চাঁদের পাহাড় পেলাম না। কি আর করা। যার নাই কোনোকিছু, তার ভরসা পিডিএফ। গুগল করে পিডিএফ নামালাম। রাতে পড়া শুরু করলাম। দু’এক পৃষ্ঠা পড়ার পর কিন্তু আমার মন থেকে সকল ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ গেছো ব্যাঙের মত হাইজাম্প দিয়ে দূরে সরে গেল। এখনো মনে আছে, রাত ৩-৩.৩০ এর দিকে বইটি শেষ করে ভাবছিলাম, কি করলাম এদ্দিন? এরকম একটি বই পড়লাম না? অল্প পরিচিত ঐ বাঙ্গালী লেখকের জন্য শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠেছিল সেদিন। উপন্যাসে উল্লিখিত ভৌগলিক বর্ণনা, বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা সব লেখক জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাপ দেখে লিখেছিলেন। কিন্তু বর্ণনা ছিল এতই নিখুঁত, পড়ে মনে হবে লেখক যেন নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করছেন।
এরপর একে একে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী, অশনি সংকেত, মেঘমল্লার, তালনবমী পড়লাম। বিশ্বাস করুন আর না করুন, বাংলা উপন্যাসের প্রতি আমার ভালবাসা আগের থেকে কয়েকশ গুন বেড়ে গেল। উনার লেখনশৈলী এমনই যে, পাঠকের মনে হবে সে যেন কাহিনী ঠিক নিজ চোখে ঘটতে দেখছে।
দুর্ভিক্ষ কি জিনিস, দুর্ভিক্ষে ঠিক কি হয়, তা আমি কখনো জানতাম না। যদি না আমি ‘অশনি সংকেত’ পড়তাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত ‘নতুন গাঁ’ নামক গ্রামটিতে বসে আছি। চারপাশে খাদ্যের জন্য সমাজের নানা স্তরের মানুষের হাহাকার যেন নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। গ্রামের প্রতিটা চরিত্র যেন লেখক নিজে। লেখকের লেখনশৈলীর কল্যাণে যখন যে চরিত্রের কথা বলা হবে, পাঠকের মনে হবে সে নিজেই সেই চরিত্র অথবা সে চরিত্র যেন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা সবাই তো হোটেল, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, তাইনা? কখনো কি ভেবে দেখেছি ঐ হোটেল বা রেস্টুরেন্টটির বাবুর্চি বা শেফ (chef) যাই বলুন না কেন, তাঁর কথা? কতটুকু চাপ তাঁকে সামলাতে হয় প্রতিদিন, তা কি কখনো মাথায় এসেছে আমাদের? যদি না এসে থাকে, যদি না ভেবে থাকেন, তবে ভাবতে বাধ্য হবেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ এই উপন্যাসটি পড়ার পর।
আমরা যারা শহুরে সভ্যতায় অভ্যস্ত, তারা কখনো অরণ্যের স্বাদ বুঝব না। গাছপালার সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক ঠিক কতটা নিবিড় হতে পারে, সেটা বুঝব না। যদি বুঝতে চান, ‘আরণ্যক’ পড়ুন। গাছপালাকে অনেক আপন মনে হবে।
মন ভাল নেই? ডুব দেয়ার মত কিছু খুঁজছেন? ‘পথের পাঁচালী’ পড়ুন। ছোট অপুর দুরন্তপনা আপনার মন ভাল করে দিবে। দুর্গার জন্য মন আপনার হু হু করে উঠবে। পথের পাঁচালীর দ্বিতীয় অংশ হলো ‘অপরাজিত’। অপুর বড়বেলার ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে এটি রচিত।
মজার ব্যাপার কি জানেন? বই পড়ুয়া নয় কিন্তু ‘পথের-পাঁচালী’ নামটি শুনেছে এমন কয়েকজনকে এর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করুন। ৩০-৪০% এর কাছ থেকে ‘সত্যজিৎ রায়’ এই নামটি পাবেন। তাদের অনেকে জানেনই না এর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাদের ধারণা সত্যজিৎ রায় ছবি বানিয়েছেন, কাহিনীও তাই উনারই লেখা।
ছোটবেলায় ভূতের গল্প/অতিলৌকিক গল্প প্রচুর পড়েছি। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি যা সামনে এসেছে, পড়েছি। “হুমায়ূন আহমেদ” এর বাংলা হরর গল্প নিয়ে লিখা একটি প্রবন্ধ পড়ে গতবছর পরিচিত হলাম ‘তারানাথ তান্ত্রিকের’ সাথে। বলাই বাহুল্য, এই তারানাথ তান্ত্রিকের স্রষ্টাও আর কেও নন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। আরও আগেই পড়তাম, কিন্তু নামখানা কোথাও পাইনি এর আগে। বিভূতিভূষণ “তারানাথ তান্ত্রিক’’ এর দু’টি গল্পই কেবল লিখে যান। বাকী গল্পগুলো লিখেন তাঁর অত্যন্ত সুযোগ্য পুত্র ‘তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’। তাঁর সম্পর্কে নাহয় আরেকদিন কথা হবে। আজ বিভূতিভূষণকে নিয়েই বলি।
বাংলা অতিলৌকিক গল্পগুলি বেশিরভাগ যেন একই ছাঁচে লিখা। যেখানে লেখক বা লেখকের পরিচিত কোনো ব্যক্তি কোনো একজনের সাথে কোনো এক জায়গায় যান অথবা কিছু সময় কাটান এবং পরে জানা যায় যে ওই ব্যক্তি অনেক আগেই মারা গেছেন। তো এ ছাঁচের বাইরে ভিন্ন কিছু যদি পড়তে চান, তবে বলব তারানাথ তান্ত্রিক পড়ার কথা। ভূতের গল্প বা অতিলৌকিক গল্প সম্পর্কে চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা আপনার পালটে যাবে। পাঠক তন্ত্র-মন্ত্রের একটি সম্পূর্ণ নতুন জগতে প্রবেশ করবেন।
অতিলৌকিক গল্পের কথা যখন উঠলই তখন উল্লেখ করা যেতে পারে “ডাইনী’’ নামের ছোট গল্পটির কথা। ভূতুরে অশরীরী কোনো কিছুর বিন্দুমাত্র বর্ণনা না দিয়ে আপনার শরীরে যদি কিছু কাঁপন ধরাতে পারে। তবে সে এই গল্পটি। কেন একথা বলছি, তা না পড়লে বুঝতে পারবেন না।
আরেকটি অতিলৌকিক ছোটগল্প হলো ‘অভিশপ্ত’। বরিশালের যে অংশটা সুন্দরবনের কাছাকাছি, এই গল্পের প্রেক্ষাপট সেই অঞ্চলের। পুরো গল্পটায় যদি ডুবে যেতে পারেন, তাহলে শেষটুকু পড়ে আপনার গা শিরশির করবেই করবে।
বিভূতিভূষণের মামার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে। এখানেই ২৪ অক্টোবর, ১৮৯৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁর নিকট বারাকপুর গ্রামে। তাঁর পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। বিভূতিভূষণ ছিলেন তাঁদের পাঁচ সন্তানের মাঝে সবার বড়।
বিভূতিভূষণের পিতা ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য এবং কথকতার জন্য তিনি “শাস্ত্রী” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। পিতার কাছেই তাই তাঁর পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। তারপর গ্রামের আরও কয়েকটি পাঠশালায় পড়াশোনার পর তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যেহেতু তিনি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন, তাই ঐ বিদ্যালয়ে তিনি অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখার সুযোগ পান। উনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে, উনার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে এনট্রান্স এবং ১৯১৬ সালে কলকাতার রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায়ও ডিস্টিংশন সহ পাশ করেন এবং আইন বিষয়ে এম এ তে ভর্তি হন। কিন্তু পড়ালেখা ছেড়ে দেন ১৯১৯ সালে।
ঐ বছরই হুগলী বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু ভাগ্যে তাঁর সংসার সুখ টিকেনি বেশিদিন। বিয়ের মাত্র এক বছর পরই গৌরী দেবী মারা যান। স্ত্রীর শোকে তিনি কিছুদিন প্রায় সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করেন।
অনেকদিন সংসারবিমুখ থাকার পর ১৯৪০ সালে ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীকে বিয়ে করে আবার সংসারজীবন শুরু করেন। বিয়ের প্রায় সাত বছর পর উনার একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উনার জীবনে বহু পেশায় কাজ করেছেন। তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। এসময় কিছুদিন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে বাংলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। তারপর খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি, গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। তারপর কিছুদিন ধর্মতলার খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। যেখানে তিনি আমৃত্যু কর্মরত ছিলেন।
১৯৫০ সালের ১লা ডিসেম্বর, বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খন্ড) ঘাটশিলায় এই মহান কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। উনার মৃত্যুর পরের বছরই উনি তাঁর ‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর জন্মস্থান বনগাঁ মহকুমায় যে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি আছে ওটার নাম তাঁর সম্মানার্থে রাখা হয়েছে “বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য”।
VR বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কল্যাণে এখন আমরা কোনো ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অনুভূতি অর্জন করতে পারি। এখন ধরুন, কোনো গল্প পড়েই যদি আপনার অনুভূতি হয় যে আপনি সেই গল্পের একটি চরিত্র অথবা পুরো ঘটনা আপনার চোখের সামনে ঘটছে, তখন সেই লেখককে আপনি জাদুকর ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারবেন কি? এমনই জাদুকরী লেখনশৈলীর অধিকারী ছিলেন বিভূতিভূষণ। যিনি সারাজীবন আড়ালে থেকে নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। আর বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন এক অমরত্বের খনি; যে খনি থেকে অমরত্ব আহরণ করে যেকোনো পাঠক উজ্জীবিত হয়ে উঠবে।
side effects from zofran
how to get off zyprexa