ঢাকেশ্বরী মন্দির: বল্লাল সেনের স্মৃতি ধারণ করা ঢাকার অভিজাত এক মন্দিরের ইতিহাস

4

ঢাকা শহরের নাম নিলেই অবধারিতভাবে যেসব চিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে তার মধ্যে আছে ঢাকার অন্যতম সেরা স্থাপনা ঢাকেশ্বরী মন্দির। ঢাকা শহরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের যতগুলো মন্দির আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন  হচ্ছে ঢাকেশ্বরী মন্দির। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা এ হিন্দু মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে সেন রাজা বল্লাল সেনের স্মৃতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ঢাকেশ্বরী রোডের কিনারে প্রাচীন বাংলার চিহ্নস্বরূপ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজাত এ মন্দির। সময়ে সময়ে সংস্কারের ভেতর দিয়ে যাওয়া এ স্থাপনার ইতিহাস নিয়ে রয়েছে বেশ শক্ত দ্বিধাবিভক্তি। আজ সেই ইতিহাসই শুনাবো আপনাদের।

ঢাকেশ্বরী মন্দির
ঢাকেশ্বরী মন্দির
Source: Templeconnect

ইতিহাস

কিংবদন্তি বলছে, সেন রাজা বল্লাল সেনের মা যখন নিজ স্বামী দ্বারা নির্বাসিত হয়ে জংগলে অবস্থান করছিলেন তখন বল্লাল সেন ছিলেন শিশুমাত্র। সেই জংগলেই বেড়ে উঠেন সেন সাম্রাজ্যের ভাবী রাজা। এমন একদিন বল্লাল সেন যখন খেলাধূলা করছিলেন তখন পাতা দিয়ে ঢাকা একটি দেবমূর্তির দৃষ্টিগোচর হয় তার। একে দৈব ইংগিত গণ্য করে যে স্থানে মূর্তিটি পেয়েছিলেন তিনি সেখানেই একটি মন্দির বানানোর মনস্থির করেন। ১২ শতকে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে যখন বল্লাল সেন, সেন মসনদে অধিষ্ঠিত হোন তখন তার ইচ্ছা মোতাবেক যেখানে দেবমূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল সেখানেই একটি সুশোভিত মন্দির নির্মাণ করেন। মূর্তিটি ঢাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল বলে এর নাম দেন ঢাকেশ্বরী মন্দির।

ঢাকেশ্বরী মন্দির
ঢাকেশ্বরী মন্দির
Source: 123RF.com

অনেকে ধারণা করেন এই ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকেই ঢাকা শহরের নামকরণ হয়েছে। তবে বল্লাল সেনের আমলেই এ মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল এমন দাবি অকাট্য হিসেবে মানতে নারাজ অনেক ঐতিহাসিক । তারা মনে করেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী দেখে মনে হয়না এটি সেন আমলে নির্মিত। কারণ সেন আমলে চুন বালির মিশ্রণে কোন স্থাপনা নির্মাণ করা হত না, চুন বালি বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে। তাই তাদের মত, ঢাকেশ্বরী মন্দির কোন এক মুসলিম রাজার আমলে নির্মাণ করা হয়েছে। আবার আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরীতে দশটি সুবার যে জরিপ চালান তাতে সুবা বাংলার এ মন্দিরের কোন উল্লেখ নেই। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ, খিলান সম্বলিত প্রবেশপথ আবার মুঘল স্থাপত্যকলার সাথে মিলে যায়। এদিক দিয়ে কেউ কেউ দাবি করেন এ মন্দির মুঘল আমলে নির্মিত। ঊনিশ শতকের শেষদিকে এ মন্দির ঝোপঝাড়ে আবৃত ছিল, একজন পুরোহিত পর্যন্ত ছিল না। পরবর্তীতে সংস্কারের আওতায় কয়েকজন পুরোহিতের মাধ্যমে মন্দিরটি পরিচালিত হতে থাকে।

ঢাকেশ্বরী মন্দির
ঢাকেশ্বরী মন্দির
Source: Hindu Existence

গঠনশৈলী

ঢাকেশ্বরী রোডের উত্তর পাশে অনুচ্চ আবেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যে থাকা এ মন্দিরের প্রবেশমুখে রয়েছে একটি সিংহদ্বার । সিংহদুয়ারটি নহবতখানা তোরণ নামে পরিচিত। মূল মন্দিরের বাইরে মহানগর পূজামণ্ডপ অবস্থিত, এখানেই রয়েছে দূর্গাপূজার স্থায়ী বেদী। মূল মন্দির উজ্জ্বল হলুদাভ, উত্তর পশ্চিমে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। বড় পুকুর, অশত্থ বৃক্ষ, মঠ, বাগান, সন্ন্যাসীদের আশ্রম ইত্যাদির উপস্থিতি

অনেকটা আরাকানি বৌদ্ধদের ঢং উঠে এসেছে। মূল মণ্ডপে রয়েছে যুগল মূর্তি। একটি দশভুজা এবং অন্যটি চতুর্ভুজ দেবমূর্তি। পূর্বদিকের প্রধান মন্দিরে রয়েছে আরেকটি ঝমকালো তোরণদ্বার , তার উপরেই শোভা পায় এক বিশাল ঘণ্টা।  

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অন্যতম শোভা তার শান বাধানো পুকুর। দুইদিক বাধাই করা এই পুকুরে পুন্যার্থীরা স্নান ও ভোগ দিয়ে থাকে। মন্দিরের ভেতরে খোলা জায়গায় বিশেষ পূজার দিনে মেলা বসে। পহেলা বৈশাখে এ মেলায় নানা শ্রেণীপেশার মানুষ অংশ নেয়। এছাড়া মন্দিরের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একান্ত নিজস্ব লাইব্রেরি। যদিও এখানে দর্শনার্থী বা পূন্যার্থীদের প্রবেশের সুযোগ নেই।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা
Source: Zee News – India.com

প্রার্থনার সময়সূচি

শনিবার সন্ধ্যা ৬ টায় অনুষ্ঠিত হওয়া শনিপূজার মত সপ্তাহের প্রতিদিনই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা অর্চনা করা হয়। এর মধ্যে রবিবার বিকেল ৫ টায় হয় কীর্তন হরী সেবা, সোমবার শিবপূজা, মঙ্গল,বুধ ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত হয় দূর্গামাতার অর্চনা এবং শুক্রবার সকাল ১০ টায় হয় মা সন্তোষীর পূজা।

ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমী যেকেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন ঢাকার অন্যতম সেরা এই স্থাপনা। এজন্য আপনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে  দক্ষিণ পশ্চিমে হাটা শুরু করতে হবে । একটু পেরুলেই ঢাকেশ্বরী রোডের প্রান্তেই হলুদাভ প্রাচীন আমলের এ মন্দির সহজেই দৃষ্টিগোচর হবে ।

Source Feature Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More