“বিশ্বাসকে হত্যা করে যারা ইতিহাসে কুখ্যাত”

4

 

‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, যে বিশ্বাসকে হত্যা করেছে। অর্থাৎ বিশ্বাসের ঘাতক। তার মানে ঘাতক হওয়ার পূর্বে সে কারো আস্থা অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে কোন এক সময় সে আস্থাকে ভূলুণ্ঠিত করে অপব্যবহার করেছে তার বিশ্বাসের মর্যাদার। আমাদের চলার পথে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, এমনকি আমরা নিজেরাও কখনো অন্যের বিশ্বাসের অমর্যাদা করে বসি। ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাসঘাতকতা সমাজের প্রচলিত ভারসাম্য নষ্ট করে। কিন্তু বৃহৎ ক্ষেত্রে যদি বিশ্বাসঘাতকতা সংগঠিত হয়, আরো খোলাসা করে বলতে গেলে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে, জাতির সাথে যে বেঈমানি করে সে নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। দেশে দেশে এমন কিছু কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে সাজানো হয়েছে ইতিবৃত্তের আজকের ফিচার।

জন ড্যাস

বিশ শতকের চল্লিশের দশকের ঘটনা। আমেরিকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে ধারাবাহিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জার্মানি এক অভিনব ফাঁদ পাতে। জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে ৮ জন ইংরেজি ভাষা জানা জার্মান নাগরিককে বিপুল পরিমাণ জাল টাকার সম্ভারের সাথে আমেরিকায় পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য জাল টাকা আমেরিকার বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে অর্থনীতির ধস নামানো। এই ৮ সদস্যের টিমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন জন ড্যাস। প্রাথমিকভাবে এই পরিকল্পনা প্রায় সফল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষের দিকে এসে বেঈমানি করে বসেন জন ড্যাস। প্রচুর পরিমাণে উৎকোচ গ্রহণের বিনিময়ে আমেরিকার কাছে ফাঁস করে দেন সব তথ্য। নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। একে একে গ্রেফতার করা হয় পরিকল্পনায় জড়িত থাকা বাকি সদস্যদের। রাতারাতি জন ড্যাস বনে যান খলনায়ক। জার্মানিতে আজো বিশ্বাসঘাতকের অন্য নাম জন ড্যাস।

বেনেডিক্ট আর্নল্ড

বিখ্যাত আমেরিকান রেভ্যুলেশন ওয়্যার স্মরণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্মারকে বেনেডিক্ট আর্নল্ডকে মূল্যায়ন করা হয়েছে এভাবে, “বেনেডিক্ট আর্নল্ড, সুসংগঠিতভাবে এ যুদ্ধ পরিচালনায় যারা নায়কোচিত ভূমিকা পালন করেছেন, যাদের অর্জনে এসেছে এ সফলতা তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে তিনি একজন। আমেরিকান রেভ্যুলেশন ওয়্যার বিজয়ের সাথে ঐতিহাসিক বিপ্লব অর্জনে বিশাল ভূমিকা পালন করেন এই বিশ্বাসঘাতক “।

বেনেডিক্ট আর্নল্ড
বেনেডিক্ট আর্নল্ড
Source: CW Jefferys

দেশের জন্য, দেশের বিপ্লবের জন্য এতকিছু করেও প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ার অভিমানে ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তিনি বেছে নেন অন্যায় পথ। বেঈমানি করেন দেশের সাথে। যোগ দেন ইংল্যান্ড বাহিনীর সাথে। ফাঁস করে দেন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি। যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে শান্তিতেই ছিলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধের পরে ইংল্যান্ড তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শেষজীবনে কানাডায় এসে থিতু হোন এবং ১৮০১ সালে মারা যান।

“You are a traitor benedict arnold”
তার কুকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ আমেরিকায় তার নামে প্রবাদ পর্যন্ত চালু হয়ে গিয়েছে।

মার্ডেচাই ভান্নু

ইসরায়েল দেশটি সম্ভবত তার অন্তিম সময় পর্যন্ত যে ব্যক্তিটিকে স্মরণ করবে প্রবল ঘৃণার সাথে, বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে তারা যে নামটি ব্যবহার করবে সন্দেহাতীতভাবে তিনি হচ্ছেন মার্ডেচাই ভান্নু। জাতিতে মরক্কোর এ ব্যক্তি ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। আশির দশকে একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচিতে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে গবেষণার জন্য পরমাণু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে এমন ধোঁয়া তোলে প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল এগিয়ে চলছিল ভয়ংকর প্রাণঘাতী পরমাণু অস্ত্র বিনির্মাণে। পশ্চিমা বন্ধুদের পরোক্ষ সহযোগিতার মাধ্যমে ইসরায়েল তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছান শুরু করে। মানব বিধ্বংসী পরমাণু কর্মসূচির একজন কর্মী হিসেবে ভান্নুর এ কাজটি পছন্দ হয়নি। ব্যয় সংকোচনের দোহাই দিয়ে ভান্নুকে ১৯৮৫ সালে তার চাকরি হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।

মার্ডেচাই ভান্নু
মার্ডেচাই ভান্নু
Source: Journalist & Radio Producer

একই বছর লেবার ইউনিয়নের সুপারিশে চাকরি পুনর্বহাল হয় তার। চাকরি ফিরে পাওয়ার পর পরমাণু কর্মসূচির প্রকৃত সত্য উদঘাটনে তিনি প্রয়াসী হোন। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেন প্রায় পঞ্চাশের অধিক ছবি। ঠিক তারপরই ফিলিস্তিনদের প্রতি অনুরাগী এমন অভিযোগ তোলে তাকে আবার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। ইহুদি থেকে গ্রহণ করেন খ্রিস্টধর্ম। অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালে ভান্নুর সাথে পরিচয় হয় ওসাকা গুইরিরো নামের এক কলম্বিয়ান সাংবাদিকের। এসময় গুইরিরোর সাথে ভান্নু একটি চুক্তি করেন। বাংলাদেশি মূল্যের প্রায় ৮ কোটি টাকার বিনিময়ে তার কাছে থাকা গোপন ছবি বিনিময়ে সম্মত হন তিনি। ১৯৮৬ সালের ৫ অক্টোবর গুইরির তত্ত্বাবধানে সানডে টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয় পরমাণু কর্মসূচির গোপন ৫৭ টি ছবি। অনুমিতভাবেই ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে যায় পুরো বিশ্বজুড়ে। ঘটনার খলনায়ক মার্ডেচাই ভান্নুকে সমুচিত শাস্তি দিতে তৎপর হয় ইসরায়েলী গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ। কূটনীতিক ঝামেলার দরুন লন্ডন থেকে ভান্নুকে গ্রেফতার করতে না পারে লেলিয়ে দেয়া হয় সিন্ডি নামের এক সুন্দরি নারীকে। লন্ডনে ভান্নুর সাথে প্রেমের অভিনয় করে মিথ্যা প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে সিন্ডি। ভান্নু কোন ধরণের বাছবিচার ছাড়াই তার প্রেমে সাড়া দেন এবং তারই হাত ধরে অবকাশ যাপনের জন্য চলে যান ইতালি। এখানেই ফেঁসে যান তিনি। ইতালির সমুদ্রবন্দরে তখন অপেক্ষা করছিল মোসাদের অত্যাধুনিক জাহাজ ‘আইএস নোগা’। সিন্ডি আর ভান্নু যখন তাদের জন্য নির্ধারিত হোটেলে উঠতে যাবেন তৎক্ষণাৎ মোসাদের দুই কর্মকর্তা ভান্নুকে আটক করে অচেতন করে দেন। এই অচেতন অবস্থায়ই তাকে ইসরায়েলে নেয়া হয়। কঠোর গোপনীয়তার সাথে বিচারকার্য শেষ করে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় ভান্নুকে। এর মধ্যে প্রথম ১১ বছর তার সাথে কাউকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। ২০০৪ সালের ২১ শে এপ্রিল শর্তসাপেক্ষে মুক্তি মেলে তার।

রোসেনবার্গ দম্পতি

রোসেনবার্গ দম্পতি
রোসেনবার্গ দম্পতি
Source: Timetoast

বিশ শতকের ৫০ এর দশক। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। এরই মাঝে পুরোদমে এগিয়ে চলছিল যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মসূচির কাজ। জুলিয়াস ও ইথেল রোসেনবার্গ নামের এক বিজ্ঞানী দম্পতি গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন এই পরমাণু কর্মসূচিতে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তারা নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরমাণু কর্মসূচির গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। ১৯৫০ এর জুলাই মাসে এ অভিযোগে প্রথম আটক করা হয় স্বামী জুলিয়াস রোসেনবার্গকে। একই বছরের আগস্টে আটক করা হয় ইথেলকেও। প্রথমে এ বিজ্ঞানী দম্পতি ষড়যন্ত্র কাজে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে এক আদালতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এপ্রিলের ৫ তারিখ তাঁদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জুন ১৯, ১৯৫৩ সালে বৈদ্যুতিক চেয়ারে আটকিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আলফ্রেড রেড

আলফ্রেড রেড নামের এ বিশ্বাসঘাতক ১৮৬৪ সালের ১৪ মার্চ বর্তমান ইউক্রেনের লাম্বার্গে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা ছিলেন পেশায় একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা। রেড ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। কর্মক্ষেত্রে তার দক্ষতা ও যোগ্যতাবলে তিনি হয়ে উঠেন অস্ট্রিয়ার কাউন্টার ইন্টেলেজিন্সির প্রধান। এসময় তিনি পরিচিতি পান একজন ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত কেউ জানত না যে তিনি মূলত একজন ডবল এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন।

আলফ্রেড রেড
আলফ্রেড রেড
Source: Oberösterreichische Nachrichten

গোপনে আঁতাত করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। ১৯০৩ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেন তিনি। ১ম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সাইবেরিয়া আক্রমণের সকল তথ্য ফাঁস করে দেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। এছাড়া সোভিয়েত সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীকে বিব্রত করেন রেড। সোভিয়েতে নিয়োজিত অস্ট্রিয়ান গুপ্তচরের কথাও ফাঁস করে দেন এ বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতার তথ্য প্রকাশ হয়ে গেলে রেড আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার বিশ্বাসঘাতকতার দরুন অস্ট্রিয়ার ৫ লাখ নাগরিককে বরণ করতে হয়েছিল করুণ পরিণতি।

মেরি সুরাট

মেরি সুরাট নামের এ বিশ্বাসঘাতিনী আমেরিকার ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল আমেরিকায় যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সুরাট তখন তার স্বামীসহ অবস্থান করছিলেন নিউইয়র্কে। এর পরপরই স্বামী মারা গেলে তিনি চলে আসেন ওয়াশিংটনে। ওয়াশিংটনে এসে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বোর্ডিং। কিন্তু আদতে তার উদ্দেশ্য কোনভাবেই এরকম ছিল না।

মেরি সুরাট
মেরি সুরাট
Source: Mowwgli

১৮৬৪ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লিংকনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এই বোর্ডিং’এ ফাঁদ পাতে হত্যাকারীরা। এই পরিকল্পনায় পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন মেরি সুরাট। ১৮৬৫ সালে যখন লিংকনকে হত্যা করা হয় তখন প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে মেরি সুরাটের নাম তালিকায় আসে। ১৮৬৫ সালের ৭ জুলাই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মীর জাফর

মীর জাফরকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই। নিজ কাজের জন্য যে তার নিজের নামকে কলুষিত করেছিল ইতিহাসে, অবধারিতভাবে বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে যে নামটি আসবে, ভারতীয় উপমহাদেশের কুখ্যাত ব্যক্তি সে, মীর জাফর ওরফে মীর জাফর আলী খান। মূলত মীর জাফর ছিল আরব থেকে আসা এক বেদুইন। নবাব আলীবর্দি খান তাকে বকশী পদে নিয়োগ দেন।

মীর জাফর
মীর জাফর
Source: Navrang India – WordPress.com

আলীবর্দি মারা গেলে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণকে মীর জাফর ভালভাবে নিতে পারেনি। নবাবের খালাতো ভাই শওকত জং কে মসনদে বসানোর চেষ্টা করে সে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে নবাব তাকে বকশী পদ থেকে প্রত্যাহার করে সেনাপতি পদে বহাল করেন। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে মীর জাফর তার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে। ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে যুদ্ধের ময়দানে নবাবকে ভুল পরামর্শ দিয়ে পরাজিত করে। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের মাধ্যমে কার্যত পুরো উপমহাদেশে চালু হয়ে যায় ব্রিটিশ শাসন। আর ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সাথে যোগ হয় একটি নাম, মীর জাফর!

তথ্যসূত্রঃ

১. https://listverse.com/2012/06/19/10-notable-traitors-in-history/
২. http://www.history.com/topics/mary-surratt
৩. ইতিহাসের খলনায়ক -নাফে নজরুল, প্রতিভা প্রকাশ।
৪. http://www.bd-pratidin.com/various/2013/08/02/8911

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More