মধ্যযুগে আরব দুনিয়ার শেষ রাজবংশ হল মামলুক বংশ। ‘আইয়ুবী বংশের’ ধ্বংসস্তূপের উপরে মিশরে প্রতিষ্ঠিত হয় “মামলুক সাম্রাজ্য”। মিশর ছাড়াও লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া ও ভারতে মামলুকরা রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি অর্জন করেছিল। মিশর ও সিরিয়ায় মামলুকরা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেছিল যা মামলুক সালতানাত (১২৫০-১৫১৭) হিসেবে পরিচিত। মুসলিম বিশ্বকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করে মামলুক শাসন মিশরের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।
মামলুক কারা
“মামলুক” শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। মিশরে যুদ্ধবন্দীদের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। “আইয়ুবী” সুলতান মালিক আল সালিহর সময়ে এই সমস্ত ক্রীতদাসদেরকে দেহরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশ ও জাতির এ ক্রীতদাসরা মুসলিম খলিফা ও সুলতানদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে তারা আইয়ুবী বংশের দুর্বলতার সুযোগে একটি স্বাধীন সালতানাতের সূচনা করে। মামলুক বংশের শাসকরা অধিকাংশই ছিলেন তুর্কী ক্রীতদাস।
মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা
১২৫০ খ্রিস্টাব্দে শাজার আদ-দুর নামে একজন বিধবা নারী মিশরে এ মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন তুর্কী বা আর্মেনিয়ান ক্রীতদাসী। তিনি মামলুক (ক্রীতদাস) ছিলেন বলে তাঁকে মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। শাজার পূর্বে খলিফা আল মুস্তাসিমের হারেমে ছিলেন। তখন সুলতান সালিহের ক্রীতদাসী হিসেবে কাজ করার সময় তাঁর গর্ভে খলিল নামে সালিহের পুত্র সন্তান জন্ম হয়। অল্প বয়সে এ সন্তানটি মৃত্যুবরণ করে। এ কারণেই তিনি ইতিহাসে “খলিলের মাতা” হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। পুত্রের জন্মের পরই দাসত্বের শৃঙ্খল মোচন হয় শাজারের এবং কথিত আছে পুত্রের জন্মের পর সালিহ তাঁকে বিয়ে করেন। তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী মহিলা ছিলেন। এক বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করবার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা তাঁর ছিল। সালিহের মৃত্যুর পর শাজার ক্ষমতার শীর্ষে উঠলে মহিলা শাসককে কেউই সহজভাবে মেনে নিচ্ছিল না। তিনি নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। শেষ পর্যন্ত আমীররা ইজ্জ আদ-দ্বীন আইবাককে সুলতান হিসেবে মনোনীত করলে সুলতানা শাজার তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেন। কিন্তু দ্বিতীয় মুসলিম নারী শাসকের (প্রথম রাজিয়া সুলতানা) পতনের মূল কারণ হয় ঈর্ষা।
মামলুক সালতানাতের শ্রেণীবিভাগ
মামলুক শাসকগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- বাহরি মামলুক ও বুরজি মামলুক। “বাহরি” মামলুকরা নীলনদের রওডা দ্বীপ অঞ্চলের সেনানিবাসে বসবাস করত। নীলনদকে প্রচলিত কথায় বাহরি বা সমুদ্র বলা হতো। আর “বুরজি” মামলুকরা বুরুজ অর্থাৎ দুর্গে অবস্থান করত। সুলতান কালাউন এদের বুরুজে অবস্থান করতে দেয় বলে এদেরকে “বুরজি মামলুক” বলা হয়। বাহরি ও বুরজি মামলুকদের শাসনকালে দেখা গেছে অনেক সময়ই সুলতানের পুত্র সিংহাসন লাভ না করে সুলতানের ক্রীতদাস তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।
বাহরি সাম্রাজ্য
বাহরিগণ রাজত্ব করেন ১২৫০ থেকে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাহরি মামলুকগণ প্রধানত তুর্কী ও মঙ্গোল ছিলেন। বাহরিদের পূর্বপুরুষ ছিল আইয়ুবি আল-সাহিরের দেহরক্ষী। সেখান থেকেই তাঁরা দেশের শাসকের পর্যায়ে উন্নীত হন। বিদেশি ক্রীতদাসদের দেহরক্ষী নিযুক্ত করার প্রথা চালু করেন বাগদাদের খলিফারা। শাজার আদ-দুরকে বাদ দিলে বাহরি মামলুক শাসকদের সংখ্যা মোট ২৪।
বাহরি শাসনামলে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য শাসক রয়েছে এবং তাঁদের নেতৃত্বে ইতিহাস বিখ্যাত যুদ্ধও সংঘটিত হয়–
আইবাক (১২৫০–১২৫৭)
ইজ্জ আদ-দ্বীন আইবাকই ছিলেন প্রথম মামলুক সুলতান। তিনি ১২৫০ থেকে ১২৫৭ পর্যন্ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাসন করেন। একজন সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন তিনি। সুনিপুণ কৌশলে সমগ্র রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। তবে আইবাক ব্যক্তিজীবনে শাজার-আদ-দুরের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাইলে দুজনের সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। আইবাক দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে হিংসার বশবর্তী হয়ে শাজার তাঁকে হত্যা করেন। এতে আমীররাও ক্ষিপ্ত হয়ে শাজারের উপর প্রতিশোধ নিতে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এরপর আমীররা সুলতানের পরিত্যক্ত প্রথম স্ত্রীর পুত্র আলীকে “আল মালেক আল-মনসুর” উপাধি দিয়ে মামলুক সিংহাসনে বসান। কিন্তু সে মাত্র ১৫ বছরের নাবালক হওয়ায় তার প্রতিনিধি হিসেবে আইবাকের সহকারি কুতুজ রাজপ্রতিনিধির পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্ষমতালোভী কুতুজ বালক রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।
কুতুজ (১২৫৯–৬০)
ক্ষমতালোভী সুলতান সাইফ আদ-দ্বীন কুতুজের শাসনের ব্যাপ্তিকাল খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও ইতিহাসে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে আছেন আইন জালুতের যুদ্ধে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য।
আইন জালুতের যুদ্ধ (১২৬০)
১২৬০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত আইন জালুতের যুদ্ধ মিশরের মামলুক ইতিহাস তথা মুসলিম ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কুতুজ ক্ষমতায় থাকাকালে মঙ্গোল বীর হালাকু খান বাগদাদ নগরী ধ্বংসের পর মিশর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে কুতুজ তাঁর সেনাপতি বাইবার্সকে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তবে শেষ পর্বে কুতুজ স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। আইনজালুত নামক স্থানে দুপক্ষের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় এই যুদ্ধ আইন জালুতের যুদ্ধ হিসেবেই পরিচিতি পায়। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়টি যুদ্ধ ইতিহাসের ধারা বা গতিপথকে পরিবর্তন করেছিল “আইন জালুতের যুদ্ধ” এদের মধ্যে অন্যতম। মামলুকদের জয়ের মাধ্যমেই মিশর মঙ্গোলদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং ফলশ্রুতিতে মিশরে মামলুকদের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
যুদ্ধের পরপরই সুলতান কুতুজের সাথে সেনাপতি বাইবার্সের মনোমালিন্য শুরু হলে একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন বাইবার্স।
বাইবার্স (১২৬০–৭৭)
বাইবার্স ছিলেন মামলুক বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান তথা মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বীর। শাজার আদ-দুর মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা করলেও বাইবার্সকে বলা হয় মামলুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
সুলতান বাইবার্স ক্ষমতায় আরোহণ করেই আল-মালিক আল-জাহির (বিজয়ী), রুকন আদ-দ্বীন (ধর্মের স্তম্ভ) এবং আবু আল-ফুতুহ (বিজয়ীদের পিতা) নাম ও পদবী অর্জন করেন। তাঁর পুরো নাম আল-মালিক আল-জাহির রুকন আদ-দ্বীন বাইবার্স আল-বান্দুকদারী। প্রকৃতপক্ষে বান্দুক অর্থ আড়ধনু। তিনি “বান্দুকদার” উপাধিটি পেয়েছিলেন তাঁর তীরন্দাজ মনিব ‘আইতাকিন বান্দুকদার’ এর কাছ থেকে যার মানে আড়ধনুকদারীর মালিকানাধীন (বান্দুকদারী)। তিনি তুর্কী ক্রীতদাস হওয়া সত্ত্বেও নিজ যোগ্যতা ও প্রতিভা বলে মামলুক সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন। ১২৬০ থেকে ১২৭৭ সাল পর্যন্ত শাসনামলে মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত, ক্রুসেডদের দমন, গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন করে তিনি মামলুক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। তিনি শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দেননি পাশাপাশি খাল-খনন, নদী বন্দরের উন্নতি সাধন ও ডাক বিভাগের উন্নতি করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। বাইবার্স কর্তৃক স্থাপিত মসজিদ (১২৬৯) ও বিদ্যালয় তাঁর নামের স্মারকরূপে আজও বর্তমান। ক্ষমতায় থাকাকালে বাইবার্সের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল আব্বাসীয় খিলাফত পুন:প্রতিষ্ঠা করা। আব্বাসীয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও মূল ক্ষমতা মামলুকদের হাতেই ছিল। ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় বাইবার্সের।
কালাউন (১২৭৯–৯০)
বাইবার্সের পর আল-মালিক উল-মনসুর কালাউন ছিলেন মামলুকদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনিও তুর্কী ক্রীতদাস ছিলেন। বাইবার্সের পুত্রের সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়। বাইবার্সের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করেন কিন্তু তাঁরও মৃত্যু ঘটলে তাঁর নাবালক ভাই সালামিস শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে সালামিস অযোগ্য প্রমাণিত হওয়ায় সালামিসকে অপসারণ করে আমির ওমরাহদের অনুরোধে ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে কালাউন ক্ষমতা দখল করেন। তিনি দক্ষ হাতে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি বহিঃশত্রু দমন করে সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। “জেসুরার যুদ্ধে” সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে প্রতিহত করেন, “হিমসের যুদ্ধে” মঙ্গোলদের আক্রমণের মোকাবেলা করেন, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সফল হন। ক্রসেডার ও খ্রিস্টানদের দমনে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় প্রদানের জন্য তিনি “মালিক আল মনসুর” বা “বিজয়ী রাজা” উপাধিতে ভূষিত হন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সাফল্যের পরিচয় রেখেছেন। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করার পাশাপাশি দুর্গ সংস্কার, অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ ও আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে কায়রোতে অত্যাধুনিক সুবিধাসহ একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন ৷ ১২৭৯ থেকে ১২৯০ সাল পর্যন্ত ১১ বছর মামলুক সাম্রাজ্য কৃতিত্বের সাথে শাসন করেন সুলতান কালাউন ৷
আল–আশরাফ (১২৯০–১২৯৩)
কালাউনের পুত্র আল-আশরাফ ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর বাহরি রাজবংশের সুলতান নিযুক্ত হন। আল-আশরাফও পিতার মত সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। আল-আশরাফের সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের চির অবসান ঘটে। মাত্র ৩ বছর রাজত্ব করার পর ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দে আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি।
আল–নাসির মোহাম্মদ
সুলতান কালাউনের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সুলতান আল-নাসির মোহাম্মদের রাজত্বকাল মিশরের মামলুক ইতিহাসে ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। মাত্র নয় বছর বয়সে ক্ষমতায় আসার পর দু বার পদচ্যুত হয়ে তিনদফায় (১২৯৩-৯৪, ১২৯৮-১৩০৮, ১৩০৯-৪১) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর এই দীর্ঘ শাসনকালে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখেন তিনি। “মারজ-আস-সাফার” যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজিত করে চিরতরে বিদায় করেন। লেবাননের বিদ্রোহী প্রজা, খোরাশানের শিয়া সম্প্রদায় এমনকি বেদুঈনদেরও কঠোর হস্তে দমন করেন তিনি। ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি রাজস্ব সংস্কার এবং কৃষি খাতেও অবদান রাখেন। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যে ৩০ টি মসজিদ নির্মিত হয়। রাজ্য থেকে মদ্যপান ও অন্যান্য পাপাচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে শুধু মামলুক সাম্রাজ্যে অবদানই রাখেননি তিনি বাহরি মামলুক বংশের পতনের মূল কারণেও রয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত বিলাসিতার ফলে দেশের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। প্রজাদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি।
বাহরি মামলুকদের পতন
নাসিরের মৃত্যুর পর ৪২ বছর ধরে তাঁর ১২ জন বংশধর রাজত্ব করেন (১৩৪০-৮২)। তাঁরা নামেমাত্র শাসক ছিলেন, আমিরগণই শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। বাহরি মামলুকদের শেষ সুলতান নাসিরের প্রপৌত্র সালিহ হাজি ইবনে শাবানের কাছ থেকে বারকুক নামক জনৈক কারকিসিয়ান ক্রীতদাস ক্ষমতা দখলপূর্বক বুরজি মামলুক গোত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। আর তাঁরই হাত ধরে ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে ১২২ বছর ব্যাপী বাহরি মামলুক বংশের চির অবসান ঘটে।
বুরজি সাম্রাজ্য
বুরজি মামলুকদের শাসনকাল ১৩৮২ থেকে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। বুরজি শাসকের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। সিংহাসনের ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার বা স্বজনপ্রীতিকে কোনরকম আমল দিত না বুরজিরা। কব্জির জোড়ে কিংবা আমীরদের সমর্থন আদায় করে যে সিংহাসন দখল করতে পারত সেই মনোনীত হতো সুলতান হিসেবে। ২৩ জন বুরজি সুলতান মিলে ১৩৫ বছর রাজত্ব করেন ঠিকই কিন্তু বাহরি মামলুকদের মতো এত গৌরবময় যুগ সৃষ্টি করতে পারেননি। এ বংশের উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন কানসু আল ঘুরী। তাঁর সময়েই “মারজ দাবিকের” যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
ষড়যন্ত্র, লুঠতরাজ এবং হত্যার ক্ষেত্রে বাহরিদের প্রবণতাই অব্যাহত রেখেছিল বুরজিরা। সেই কারণেই বুরজি যুগকে সিরিয়া ও মিশরের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়।
বুরজি মামলুকদের অধিকাংশই ছিল কারকিসিয়ান। শুধু খুশকদম (১৪৬১-৬৭) ও মিমুর বুখঘা (১৪৬৭) ছিলেন গ্রিক। কেবলমাত্র ৯ জন সুলতান মিলেই ১২৪ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাকিদের সময়কাল খুবই কম ছিল। নয়জন মামলুক যথাক্রমে বারকুক, ফারাজ, আল-মুয়াইয়াদ শাইখ, বারস বে, জাকমাক, ইনাল, খুশ কদম, কাইত বে এবং কানসু আল ঘুরী। অবশিষ্ট ১৪ জনের বিশেষ কোন ক্ষমতা ছিল না।
মারজ দাবিকের যুদ্ধ
মিশরে মামলুকদের ইতিহাসে “মারজ দাবিকের যুদ্ধ” এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইতিহাসের ধারা পরিবর্তনকারী যুদ্ধগুলোর মাঝে মারজ দাবিকের যুদ্ধও রয়েছে। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগাস্ট সিরিয়ার আলেপ্পোর নিকটবর্তী “মারজ দাবিকের” প্রান্তরে মামলুক সুলতান কানসু আল ঘুরীর সাথে তুর্কী সুলতান প্রথম সেলিমের এই ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মামলুক বাহিনীর একাংশের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মামলুক বাহিনীকে পরাজিত করে সুলতান সেলিম সহজেই সিরিয়া ও মিশর তুর্কী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ মিশরে মামলুক সুলতানাতের চির অবসান ঘটে এবং মিশর তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীনে একটি প্রদেশে রূপান্তরিত হয়। ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ সুলতান ঘুরী অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে নিহত হন এই যুদ্ধে।
মামলুক শাসনের অবসান
কানসু আল ঘুরীর পর তাঁর ক্রীতদাস ও পোষ্যপুত্র দ্বিতীয় তুমানবে (১৫১৬-১৭) সিংহাসনে আরোহণ করলেও তুর্কী বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। ফলস্বরূপ ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে শাজার আদ-দুর কর্তৃক মিশরে প্রতিষ্ঠিত মামলুক সাম্রাজ্য ২৬৭ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করবার পর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কী সুলতান প্রথম সেলিমের হাতে এর চির অবসান ঘটে।
মিশরে মামলুক সাম্রাজ্য পতনের পেছনে রয়েছে আরও নানাবিধ কারণ–
১. ইবনে খালদুনের নীতিমালা
ইবনে খালদুন অনেকটা ভবিষ্যৎ বাণী করেই বলেছিলেন, মানুষের স্বাভাবিক জীবনকাল ১২০ বছর। কোন সাম্রাজ্যের জীবনকালও তাই। যদি তাতে যুগ সন্ধিক্ষণের অনুপাতে তারতম্য ঘটে থাকে তবুও তা সাধারণভাবে তিন পুরুষের অধিক স্থায়ী হয় না। এক পুরুষ ৪০ বছর করে ধরলে তিন পুরুষের জীবনকালও হয় ১২০ বছর। মিশরে মামলুক বংশের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
২. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব
মামলুক সাম্রাজ্যে একজন শাসকের অবসানের পর পরবর্তী শাসক নির্বাচনে কোন নিয়ম কানুন অনুসরণ করা হয়নি। এর ফলে গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে মামলুক বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. সুলতানদের অযোগ্যতা
বাইবার্স, কালাউন, আল-নাসির বাদে বেশিরভাগ সুলতানই অযোগ্য ছিলেন। সুলতান বায়স বে (১৪২২-৩৮) দুইজন চিকিৎসককে হত্যা করেন কারণ চিকিৎসকরা তাঁকে একটি কঠিন রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। এ রকম খামখেয়ালির বশে অনেক অজ্ঞতার পরিচয় দেন বেশিরভাগ সুলতান।
৪. অভিজাত শ্রেণীর অধঃপতন
অভিজাত শ্রেণী বিভিন্ন সময়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়ে তৎপর থাকায় আস্তে আস্তে তাঁদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটতে থাকে এবং পুরো রাজ্যে এর প্রভাব পড়ে।
৫. দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ
মামলুক সুলতান আল-নাসির ও বারস-বের সময় দেশে দুর্ভিক্ষ ও প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে করে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটলে জনগণের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
৬. তৈমুর লংয়ের আক্রমণ
মামলুক সুলতান বারকুক তৈমুরের দূতকে হত্যা করলে তৈমুর সিরিয়ার উত্তর অঞ্চল আক্রমণ করেন। বিশ্ব বিখ্যাত বীর তৈমুর লংয়ের আক্রমণ মামলুক সাম্রাজ্যকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
৭. তুর্কীদের আক্রমণ
মিশরের মামলুক সুলতানদের উপর শেষ আঘাত আসে তুর্কীদের কাছ থেকে। মারজ দাবিকের যুদ্ধই ছিল এই সেই শেষ আঘাত যার মাধ্যমে মামলুক সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয়ে পড়ে।
মামলুক সাম্রাজ্যের অবদান
দীর্ঘ ২৫০ বছরে মামলুকরা মিশরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অবদান রেখে গেছেন।
১. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা
মামলুক আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নতি সাধিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরবগণ জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতিক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করে।
২. ইতিহাস ও সাহিত্য
ইতিহাস রচনায় মামলুকরা খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। এসময় ইসলামের কতিপয় খ্যাতনামা ঐতিহাসিক যেমন- আবুল ফিদা, ইবন তাগরিবিরদি, আল-সুয়তি এবং আল মাকরিযির আবির্ভাব ঘটে। আবু ফিদা “মুক্তাতাসার তারিখ উল বাশার” অর্থাৎ “মানব জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” রচনা করেন।
৩. বিশ্বকোষ ও ধর্মশাস্ত্র
বিশ্বকোষ রচনায় মামলুক যুগ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ধর্মশাস্ত্র ও ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রেও মামলুক যুগে উৎকর্ষ সাধিত হয়। এছাড়া কবিতায় এ যুগে “আলিফ-লায়লার” পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়।
৪. শিল্পকলা
মামলুক রাজত্বকালে মিশরে স্থাপত্য শিল্প ও চারুকলার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময়ে অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, স্কুল, সমাধি ইত্যাদি নির্মিত হয়। কুফি লিখন পদ্ধতি, জ্যামিতিক নকশা, লতা-পাতা প্রভৃতি উপাদানের ব্যবহারে মামলুক স্থাপত্য শিল্প বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
buy terbinafine for sale – where can i buy griseofulvin grifulvin v ca
rybelsus 14mg generic – glucovance without prescription cost desmopressin