আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহি ও স্মিথ বদায়ূনের মিথ্যাচার
“আকবর প্রায় সময় সকালবেলায় ফতেহপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদের সামনে একটি পাথরের উপরে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দেখে তিনি ব্যথিত হতেন। মুসলমানদের মধ্যে সুন্নী, শিয়া, মাহদভী এবং সূফি মতবাদের বিভেদ দূর করে সকল মতাবলম্বীকে একটি সমঝোতায় আনার চেষ্টা করেন” [ঐতিহাসিক বদায়ূন]
ষোড়শ শতকের উদার চিন্তাধারার প্রাণপুরুষ, যুগশ্রেষ্ঠ শাসক মহামতি আকবর তার বাল্যকাল থেকেই সত্যানুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি যখন গ্রাস করতে বসেছে সমাজকে, মানুষে মানুষে হানাহানির ধর্মীয় উন্মাদনা তাকে বারবার একটি কথাই মনে করিয়ে দিত এবং তা ছিল সম্মিলিত সহাবস্থান। কিভাবে ভারতবর্ষের সব ধর্মের অনুসারীদের অভিন্ন পতাকার ছায়াতলে আনা যায় সে চিন্তায় বিভোর থাকতেন স্বল্পশিক্ষিত অথচ গভীর চিন্তাশক্তির অধিকারী মহান সম্রাট। তার পূর্বপুরুষের উদার মনোভাব তার রক্তেও প্রবাহমান ছিল। তার মা হামিদা বানুর কাছ থেকে তিনি শৈশবেই ধর্মীয় স্বাধীনতার শিক্ষা নিয়েছিলেন। গৃহশিক্ষক আব্দুল লতিফও এ ব্যাপারে শিশু আকবরের মনোজগতে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। প্রাপ্তবয়সে এসে রাজপুত রমণীকে বিয়ে করে যার ষোলকলা পূর্ণ হয়।
শায়খ আবুল ফজল ও শায়খ ফয়জীর দর্শনে সম্রাট আকবর ক্রমে আকৃষ্ট হতে থাকেন। তারা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তা সত্য অনুসন্ধানের বিভিন্ন রূপ বৈ কিছুই না। উক্ত পণ্ডিতদের সংস্পর্শে এসে আকবরের ভাবনার জগত তীব্র আন্দোলিত হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি আবুল ফজল ও ফয়জীর প্রভাবের বলয়ে পড়ে যান। এতে সাম্রাজ্যের গোঁড়া আলেমগণ সম্রাটের প্রতি রুষ্ট হোন এবং তাকে ইসলামচ্যুত বলে ফতোয়া দিতে থাকেন।
ইবাদতখানা নির্মাণ
১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর তার সত্যানুসন্ধান দর্শনকে আরো বিকশিত করার মানসে ফতেহপুর সিক্রিতে একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করেন এবং সেথায় সব ধর্মের পণ্ডিতদের ধর্ম বিষয়ে বিতর্কের আহ্বান জানিয়ে গমন করতে নির্দেশ দেন। হিন্দু, জৈন, পারসিক, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মের বড় বড় ধর্মগুরু সেখানে পরস্পর তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হোন এবং আকবরের সমন্বিত সারবস্তুর খোঁজে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন। সম্রাট পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, তাদের এ বিতর্ক যাতে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ না করে সত্য অনুসন্ধানে আল্লাহর নৈকট্য বা আসল রূপ খুঁজার কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ইবাদতখানায় একসময় দেখা যায়, ধর্মগুরুরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে পারস্পারিক ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং একে অপরের গালমন্দ করা শুরু করেন।
আকবর তুমি কার?
সম্রাট আকবর একবার মুসলিম আলেমদের একটা প্রশ্ন করে তার যথাযথ উত্তর পাননি। অথবা যে উত্তর তিনি পেয়েছিলেন তা তার মনপুত হয়নি। আর এই সুযোগ লুফে নেন অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরা।
হিন্দুদের একটি প্রতিনিধিদল সম্রাটের নিকট এসে তাদের ধর্মমত ব্যাখ্যা করে এবং তাদের দেবতাদের মাহাত্মের কথা আকবরের সম্মুখে উপস্থাপন করে। আকবর তাদের কথা আগ্রহভরে শুনেন এবং তাদের যথেষ্ট সম্মান প্রদান করেন। সম্রাটের এমন ব্যবহারে হিন্দু ধর্মগুরুরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি হয়তো হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে ফেলবেন। আকবর হিন্দুদের ধর্মমত শুনার পাশাপাশি জৈন, পারসিক, খ্রিষ্টান ও শিখ ধর্মগুরুদের কথাও মনোযোগ সহকারে শুনার চেষ্টা করেন।
জৈন পণ্ডিত হিরা বিজয় সূরী, বিজয় কোন হুরী প্রমুখ সম্রাটকে জৈন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেন। ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন জৈন ধর্মগুরু সম্রাটের প্রাসাদে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়া শুরু করেন। জৈন্য গুরুরাও এক পর্যায়ে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন যে আকবর হয়তো জৈন ধর্ম গ্রহণ করতে চান কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। এজন্য জৈন পণ্ডিতগণ সম্রাট বরাবর সরাসরি জৈন ধর্ম গ্রহণের আবেদন তার সামনে পেশ করেন। কিন্তু সম্রাট সে আবেদন বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। বিফল মনোরথে প্রাসাদ ত্যাগ করে জৈন প্রতিনিধি দল।
পারসিকরাও আকবরকে তাদের ধর্মে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। কথিত আছে, এসময় সম্রাট রাজদরবারে সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। পারসিক ধর্মগুরু দস্তুর মেহেরজীকে আকবর গুজরাটে ২০০ বিঘা জমিও দান করেছিলেন। খ্রিষ্টান, শিখরাও সম্রাটের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে মহামতি সম্রাট আকবর কোন ধর্মই শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। তিনি কেবলমাত্র সব ধর্মের ধর্মগুরুদের পর্যাপ্ত সম্মান এবং তাঁদের আলোচনা শুনতেন মাত্র। এতে সম্রাটের উপর পণ্ডিতগণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাস করে বসে যে অচিরেই সম্রাট তাঁদের নিজ নিজ ধর্মে ধর্মান্তরিত হবেন। যা ছিল সর্বাংশে ভুল।
দ্বীন-ই-ইলাহি প্রতিষ্ঠা
অবশেষে দ্বিধাগ্রস্ত সম্রাট ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে সকল ধর্মের সারকথার সমন্বয়ে দ্বীন-ই-ইলাহি নামের তথাকথিত ধর্মমতের প্রবর্তন করে তার দোলাচলে থাকা সত্তাকে বন্ধনীতে আবদ্ধ করতে সমর্থ হোন।
দ্বীন-ই-ইলাহির প্রত্যেক সদস্যকে বলা হত সভ্য।
সভ্যরা একে অপরের সাথে দেখা করলে জল্ল জলালুল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করতেন। একজন সভ্য মারা যাওয়ার আগেই নিজের জেয়াফতের ব্যবস্থা করতেন। সভ্যের জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হত, করা হত ভোজের আয়োজন। সভ্যদের মাংস খাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের চারটি মানদণ্ড মেনে চলতে হত দ্বীন-ই-ইলাহির সদস্যদের। জান, মাল, সম্মান এবং ধর্ম এ চারটি বিষয়ের উপর নির্ধারণ করা হত সম্রাটের প্রতি ভক্তির মূল্য। যে সভ্য চারটি সম্রাটের তরে সমর্পণ করবে সে প্রথম শ্রেণীর সভ্য, যে তিনটি উৎসর্গ করবে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর, যে দুইটি সমর্পণ করবে সে তৃতীয় শ্রেণীর এবং যে একটি উৎসর্গ করে সে চতুর্থ শ্রেণীর সভ্য।
দ্বীন-ই-ইলাহি প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মানুষে মানুষে বিবাদ ভুলে গিয়ে একটি সহনশীল ধর্মভিত্তিক উদার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আসলে এটি কোন ধর্ম ছিল না। তার কোন গ্রন্থও ছিল না। সম্রাট এটির প্রচারও করেননি। কাউকে জোর করেও দ্বীন-ই-ইলাহির সদস্য বানান নি। যদি তাই চাইতেন তিনি তবে তার অধীন সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ মতের দীক্ষা নিতে প্রলুব্ধ করতেন। কিন্তু আকবর তা করেননি। এজন্য নিদেনপক্ষে ১৮ জন সদস্য শেষ পর্যন্ত জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছিলেন সম্রাট যারা কেবলমাত্র নিজস্ব ইচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন।
ভিনসেন্ট স্মিথ ও বদায়ূনীর মিথ্যাচার
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ও বদায়ূনী মনে করেন, সম্রাট আকবর শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। রক্ষণশীল মুসলিম ও খ্রিষ্টান লেখকদের প্রভাবে তারা এমনটি বলে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। বদায়ূনী তার মতের স্বপক্ষে আকবরের তথাকথিত ইসলাম বিরোধী কিছু আইনের উল্লেখ করেছেন। কি ছিল আইনগুলোতে চলুন দেখে আসি একঝলক।
১। সম্রাটের প্রতি সেজদা দেয়ার রীতি প্রচলিত হয়।
২। দাঁড়ি রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
৩। গরুর মাংস, পেঁয়াজ, রসুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
৪। মসজিদে আযান ও নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হয়।
৫। মুসলমানদের নামের আগে মোহাম্মদ রাখা বাতিল করা হয়।
৬। বার বছর পূর্বের ছেলেদের খতনা বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
৭। রমজান মাসে রোজা রাখা ও হজ্বযাত্রা রহিত করা হয়।
৮। কোরআন, হাদীস শিক্ষা বাতিল করা হয়। এর পরবর্তীতে গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস পাঠে গুরুত্ব দেয়া হয়।
৯। মসজিদকে গুদামে পরিণত করা হয়।
১০। ছেলেদের ১৬ বছরের আগে এবং মেয়েদের ১৪ বছরের আগে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়।
উপরোক্ত আইনগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় অধিকাংশের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের মূলনীতির কোন সম্পর্ক নেই। মসজিদ, আযান, রোজা, হজ্ব নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে ভারতীয় মুসলমানদের হজ্বযাত্রার প্রমাণ আছে। সুতরাং হজ্ব পালনে বাধা দেয়ার কথা সত্য নয়।
মুসলমান ছেলের আগে মোহাম্মদ নাম রহিত করা, এটিও একটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। খোদ আকবরের নিজের নামেই মোহাম্মদ যুক্ত ছিল এবং তার নাম পরিবর্তন করার কথাও কোথাও শুনা যায়নি। রোজা রাখা ও মসজিদে নামাজ পড়া যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা আগেই দেখেছি সম্রাট আকবর ছিলেন একজন উদার মানসিকতার অধিকারী। তিনি মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। তাই তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ভ্রান্ততারই প্রমাণ দেয়।
ধর্ম বিষয়ে স্বাধীন চিন্তাচেতনার উদ্বোধন করে মহান সম্রাট আকবর রক্ষণশীল আলেম উলামাদের বিরাগভাজন হোন। আকবরের শাসনের শুরু থেকেই এসব আলেমগণ তার বিরদ্ধে লেগে ছিল। শেষপর্যন্ত তাকে ইসলামত্যাগীর মিথ্যা তকমা লেপ্টে দিয়ে তারা ক্ষান্ত হয় যা বদায়ূন আর স্মিথের মনোভাবেই প্রতিফলিত হয়।
তথ্যসূত্র : ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, আবদুল করিম। পৃষ্ঠা ২৪৪-২৫১
cheap rybelsus 14 mg – how to get glucovance without a prescription DDAVP over the counter