হলিউডের পর্দায় হয়তো দেখে থাকতে পারেন একাই শত্রুপক্ষের গাড়ি ধ্বংস করে যাচ্ছে নায়ক। এগুলো শুধুমাত্র ভিএফএক্স আর ক্যামেরার কারসাজি কিন্তু আমাদের দেশে এমন একজন সুর্যসন্তান ছিলেন যিনি পাকিসেনার সাতটি স্পীডবোট একাই ধরাশায়ী করেন আর কভারিং হিসেবে যুদ্ধপথে একা থেকে তাঁর রেজিমেন্টের ১৫০ জন সহযোদ্ধাদের নিরাপদে ব্যারাকে পৌঁছাতে সাহায্য করে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ঠিক যেমনটা সহযোদ্ধাদের রক্ষার্থে করেছিলেন আরেক বীরশ্রেষ্ঠ, সুর্যসন্তান ল্যান্সনায়েক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ একটা গর্বিত দেশ যার বুকে জন্মেছিলো এমন অমুল্য হীরের টুকরোগুলো। তাঁদের মধ্যে একজন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ। মরণোত্তর পদোন্নতি হিসেবে ল্যান্সনায়েক খেতাবটা পেয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস কর্তৃক। তাঁর সম্মাননার ঝুলিতে শোভা পাচ্ছে ২০১৪ সালে পিলখানার বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তিত হয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ নামকরণ, মানিকছড়ি, মুসলিম পাড়া, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এর একটি উচ্চ বিদ্যালয় তাঁর নামে নামকরণ। তাছাড়াও ফরিদপুর জেলার একটি কলেজ তাঁর নামে রাখা হয়েছে যেটি বর্তমানে সরকারিকরণ করা হয়েছে। শালবাগান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক, সাপছড়ির মধ্যবর্তী স্থানে ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ECB-16) একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনসহ সিলেটের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তাঁর নামে রাখা হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠর দেয়া ৫২ শতাংশ আর বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদের মাধ্যমে এলাকাবাসীর ৪৮ শতাংশ মিলে মোট এক একর জায়গার উপর ২০০৭ সালে স্থাপন করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।
ফরায়েজী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজী শরীয়ত উল্লাহর প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা গর্বিত জনপদ ফরিদপুর, যার বুকে ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজলোর (অতীতে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত ছিলো) সালামতপুরে জন্মেছিলো দেশমাতৃকার আরেক গর্বিত সন্তান ল্যান্সনায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। তাঁর গ্রাম সালামতপুরের বর্তমান নাম সম্মানার্থে রউফনগর রাখা হয়েছে।
তাঁর বাবা ‘মুন্সি মেহেদি হাসান’ স্থানীয় মসজিদের সম্মানিত ইমাম ছিলেন যিনি ১৯৫৫ সালেই মৃত্যুবরণ করেন। মাতা ‘মুকিদুন্নেসা’ ছিলেন একজন গৃহিণী। দুই বোন জোহরা এবং হাজেরা সহ পিতৃহীন ৪ জন সদস্যের পরিবারের হাল ধরতে ১৯৬৩ সালের ৮ মে যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে।
ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার ছিলেন তাঁর ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব। উনার থেকেই সৈনিকদের শৃঙ্খল ও রোমাঞ্চকর জীবনযাপন সম্পর্কে জেনে ছোটবেলা হতেই রাইফেলসে যোগদানে ইচ্ছা পোষণ করতেন।
এরই মধ্যে নিজের বাবার হাতে শিক্ষাজীবনে হাতেখড়ি হওয়া অদম্য সাহসী ও মেধাবী মুন্সি আব্দুর রউফের শিক্ষাজীবন মাত্র অষ্টম শ্রেণীতেই চুকে যায় বাবার মৃত্যুর পরেই। বাস্তবতা অনেক কঠিন হয়েই ধরা দেয় বালকের কাছে। মৃত্যু কি জিনিস তা বুঝার বয়স খুব অল্পই হয়েছিলো তাঁর।
মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলো, “ মা, বাবা কি সত্যিই মারা গিয়েছেন? “ সারাক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকতেন কিভাবে মায়ের দুঃখ কষ্ট, পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে চিন্তামগ্ন থাকতেন তিনি।
চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে বাঁধ সাধলো তাঁর বয়স, অগত্যা বাধ্য হয়ে তিন বছর বাড়তি দেখিয়েই চাকরিতে জয়েন করেন তিনি। এরপর চুয়াডাঙ্গার ইআরপি ক্যাম্পে নিজের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সেরে আব্দুর রউফ পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান উচ্চতর প্রশিক্ষণের নিমিত্তে। ছ’মাসের মধ্যে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয় কুমিল্লায়। রাইফেলসে নিযুক্ত থাকার পরেও মন পড়ে থাকতো ঘরের প্রতি। নিয়মিত ঘরে টাকা পাঠাতেন, চিঠি লেখতেন। ছুটি নিয়ে পারলে মাঝেমধ্যে উড়াল দিয়ে ঘরে চলে আসতেন। মায়ের কষ্ট অনেকাংশেই লাঘব হলো কারণ বড় মেয়ে জোহরার বিয়েতে শাড়ি দিতে পারেন নি বলে মনের ভিতর অনেকটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছিলেন মমতাময়ী মা। সেদিন ছোট্ট আব্দুর রউফ কথা দিয়েছিলেন, “ দেখো মা!! আমি একদিন বড় হয়ে চাকরী করবো। তখন অনেক শাড়ি কিনে দেবো”। ছেলে কথা রেখেছিলো চাকুরী নিয়ে কিন্তু আরেকটি কথা রাখতে গিয়েও পারেন নি আর তা হলো ছোট বোনের বিয়েতে শাড়ি নিয়ে আসার কথা দিয়েও গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে আসাটা তাঁর হলো না। তবে ফিরেছিলেন বীরবেশে, মৃত আব্দুর রউফ, একজন বীরশ্রেষ্ট খেতাব নিয়ে।
সময়টা ছিলো ১৯৭১ সাল। মুন্সি আব্দুর রউফ ২৫ মার্চের আগে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামের ১১ নং উইংয়ে। দায়িত্বে ছিলেন মাঝারী মানের একটি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং চালক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যোগ দেন মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে থাকা অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ। অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানীর উপর দায়িত্ব পড়ে এই জলপথে পাকিবাহিনী প্রতিরোধের।
৮ এপ্রিল, ১৯৭১। সুর্য ঠিক মাথার উপর থেকে কিছুটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। হঠাৎ নীরব জলের বুক ছিঁড়ে তেড়েফুঁড়ে আসতে লাগলো পাকিবাহিনীর ৭ টি স্পীডবোট ও ২ টি লঞ্চ যার মধ্যে ছিলো দুই কোম্পানী পাকি সৈন্য। স্বয়ংক্রিয় এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসা পাকিবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ানের লক্ষ্য ছিলো বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ধ্বংস।
প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই শুরু হলো আক্রমণ পাকিবাহিনীর পক্ষ হতে। অবিরত মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে স্পিডবোট হতে আর লঞ্চ হতে ছুটে আসছে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল। মৌমাছির ঝাঁকের মতো সাই সাই করে গুলি ছুটে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।
ঠাঁসা আক্রমণে ক্যাম্প পুরোই ব্যাকফুটে চলে গেলো তবে অদম্য সাহস, দেশমাতৃকাকে হায়েনাদের কবল হতে বাঁচাতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরকার হলে ঝরবে তাজা রক্ত, খসে পড়বে প্রাণ। কিন্তু বাস্তবতা অতোটা সহজ ছিল না। উপর্যপরি আক্রমণে সব প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন ভঙ্গুর প্রায় তখন মুন্সি আব্দুর রউফ চিন্তা করলেন এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলেরই মৃত্যু অনিবার্য। সুকৌশলে পিছে হটার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাঁর সহযোদ্ধারা নির্দেশ পাওয়া মাত্রই পিছু হটতে শুরু করলেন।
তবে, এভাবে সম্ভব নয়। পিছ হতে কেউ নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে কভার না দিলে ঘাঁটিতে থাকা সকলের মৃত্যু নিশ্চিত। যেই ভাবা সেই কাজ। সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলে হাতে তুলে নিলেন মেশিনগান আর দুর্বার গতিতে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে। চোখে স্বপ্ন সবাইকে নিরাপদ রাখতে হবে। গেলে যাবে নিজের প্রাণ তবে তাঁর এই আত্মত্যাগের ফলে বাকি ১৫০ জন দেশের জন্য অনেক কিছুই দিতে পারবে, ছিনিয়ে আনতে পারবে জয়। এটাই সুযোগ পাকিস্তান রাইফেলসে করা অস্ত্র চালানোর ট্রেনিংয়ের সদ্ব্যবহারের। কল্পনা নয় একদম বাস্তব অকাট্য সত্য যে, তাঁর গুলিতে একের পর এক হানাদার বাহিনী লুটিয়ে পড়তে লাগলো এবং তিনি এক এক করে ৭ টি স্পীডবোট ধ্বংস করে দিলেন নিমিষেই। উপায়ন্তর না দেখে দুটো লঞ্চ নিয়েই পিছু হটতে বাধ্য হলো শত্রুপক্ষ এবং আব্দুর রউফের রেঞ্জের বাহিরে গিয়ে শুরু করলো লঞ্চ থেকে মর্টার শেলের বর্ষণ।
নির্মম আক্রমণ একার পক্ষে সামাল দেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠলো না বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফের। তাঁর পবিত্র দায়িত্ব শেষ, গুণে গুণে প্রায় ১৫০ জন সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছেন তিনি। এবার মৃত্যু আসলে আসুক। হঠাৎ একটা মর্টারের গোলা এসে পড়লো আব্দুর রউফের পরিখায়। মুহুর্তেই আব্দুর রউফের পবিত্র শরীর শেলের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।
দেশমাতৃকার পেলো একজন সাহসী, উদ্যম সন্তানকে। মাটি সিক্ত হলো একজন গর্বিত সন্তানের রক্তে। একটি মাত্র মেশিনগানের সাহায্যে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে পরিচয় দিলেন একজন আত্মত্যাগী বন্ধুত্বের।
সুর্যসন্তানকে নিয়ে পশ্চিমের সুর্য হেলে পড়তে লাগলো আর সে সাথে আব্দুর রউফ বাকিদের রক্ষা করে বাঁচিয়ে দিয়ে দেশকে রক্ষার নতুন সুর্য উঠার পথ সুগম করে দিলেন।
মায়ের বারবার গাঁয়ে ফিরে আসার অনুরোধে লেখা চিঠিগুলোর উত্তর আর কখনোই দেয়া হয় নিই, ছোট বোনের জন্য শাড়ি নেয়া হলো না তবে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্ত আকাশ-বাতাসের স্বাদ নিতে পারার সুযোগ এদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছিলো। তিনি ছিলেন অভেদ্য, দুর্বার, অদম্য, একজন বীর, দেশের তরে প্রাণ দেয়া শহীদ, তারচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন স্বাধীন দেশের বীরশ্রেষ্ঠ।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। একে একে দামাল ছেলেরা ফিরতে লাগল দেশের পতাকা হাতে তবে মুকিদুন্নেসার ছেলে আব্দুর রউফ এর আর ফেরা হলনা । একজন সন্তানহারা মায়ের এর চেয়ে কষ্টের প্রতীক্ষা আর কিছুই হতে পারেনা।
তবে বীরশ্রেষ্ঠের মায়ের আক্ষেপবিহীন জবাব ছিল,
‘শেয়াল-কুকুরের মতো পালিয়ে না মরে দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে বীরের মতো লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছে আমার ছেলে।‘
১৯৭১ এর ২০ এপ্রিলে মৃত্যুর পর বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফকে সমাহিত করা হয় রাঙ্গামাটির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী স্থানে। ওই জায়গায় বাংলার বীর সন্তান মাটির নিচে শুয়ে আছে খবরটা অবশ্য জানতে ১৯৭১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো স্থানীয়দের। দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামের এক আদিবাসীই সর্বপ্রথম তাঁর সমাধি শনাক্ত করেন এবং পরবর্তীতে সরকারীভাবে নতুন করে সংস্করণের মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
জাতি আজীবন কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে সুর্যসন্তানদের। মুক্ত বাতাসে প্রতিটা নিশ্বাসের সহিত শ্রদ্ধায় আরেকবার ভরে উঠবে মন। বাংলাদেশ আসলে গর্বিত এমন সন্তানকে বুকে ধারণ করতে পেরে।
( বিভিন্ন তথ্যসুত্রের জন্য বিভিন্ন ব্লগ, আর্টিকেল এবং উইকিপিডিয়া হতে সাহায্য নেয়া হয়েছে। )