ফ্রান্সিসকো পিজারো : ইনকা সভ্যতা ধ্বংসের শুরু যার হাতে

1

ভাবুন তো যার জন্মপরিচয় নেই তাকে সমাজে কোন স্থানে অবস্থান করতে হয়! আমাদের সমাজ তাদের ঘৃণা ভরে দেখে তবে এই পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয়েছিল যারা পিতৃ মাতৃ বা বংশ নয় বরং নিজের পরিচয় নিজে সৃষ্টি করেছিলেন । তাদের মাঝ থেকে আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব তেমন একজন এর সাথে, যিনি একদিকে যেমন একটা সভ্যতা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলার প্রধান কারিগর আবার অন্যদিকে স্প্যানিশদের জন্য সে একজন রাজ্য বিজেতা।

ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ (১৪৭১-১৫৪১) একজন স্প্যানিশ রাজ্য বিজেতা ছিলেন, যিনি ইনকা সাম্রাজ্যে বিজয় অভিযান চালান এবং ইনকা সভ্যতা দখল করেন। তিনি ইনকা সাম্রাজ্যের সম্রাট আতাহুয়ালপাকে বন্দি ও হত্যা করে ইনকা সাম্রাজ্যকে স্পেনের ভূমি বলে দাবি করেন।

ছবিতে ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ
ছবিতে ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ
Source: Wikipedia

প্রাথমিক জীবন

ফ্রান্সিসকো পিজারো স্পেনের ত্রুজিলোর ক্যাসেরেসে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমানে যা এক্সট্রিমাদুরা নামে পরিচিত। তিনি পদাতিক সেনাবাহিনীর কর্নেল গোঞ্জালো পিজারো (১৪৪৬-১৫২২) এবং ফ্রান্সিসকা গোঞ্জালেজ এর অবৈধ প্রণয়ের ফসল ছিলেন। অবৈধ হিসেবে জন্মানোর ফলে তার জন্ম সাল বা তারিখ ব্যাপারে তেমন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। তবে তা সম্ভবত ১৪৭০ থেকে ১৪৭৪ সালের মধ্যে হবে। একই কারণে ছোটবেলায় তার শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেও কেউ যত্নবান ছিল না ফলে তিনি তার পিতার শুয়োরের পালের দেখভাল করতে করতে নিরক্ষর হয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন।

তার পিতা পদাতিক বাহিনীর কর্নেল হিসেবে কর্দোবার অধীনে সেনাবাহিনীতে নোভেরা এবং ইটালিয়ান অভিযানে চাকুরী করতেন। তার মা তার জন্মের ও অনেক পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সংসার শুরু করেন। এবং সেখানে তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন যার নাম ছিল ফ্রান্সিসকো মার্টিন দ্য এলকান্তারা। পিজারোর এই বিপৈত্রিক ভাই তার সাথে পেরু জয়ের অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল।

১৫০৯ সালের ১০ নভেম্বর পিজারো এলোনসো দো ওজদার সাথে স্পেন থেকে উরাবা উপসাগরের পথে জীবনের প্রথম সমুদ্র অভিযানের পাল তোলেন। পূর্বে ওজদার উপনিবেশ স্থাপনে ব্যর্থ হওয়া অঞ্চলে এবার পিজারো আবারো নতুন করে আঘাত হানেন এবং তা দখল করেন।

ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ
ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ
Source: history.com

কর্ম জীবন

পানামা

১৫১৩ সালে পিজারো ভাস্কো ন্যুনেজ দো বালবোয়ার সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল পেরিয়ে পানামার ইস্থমাসে পৌঁছান। কিছুদিন পরে পেদ্রো এরিয়াস দাভিলা ক্যাস্টিলা দো ওরোর নতুন গভর্নর নিযুক্ত হন এবং বালবোয়ার স্থলাভিষিক্ত হন। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে পিজারো দাভিলার খুব ঘনিষ্ঠ লোক হয়ে ওঠেন এবং দাভিলা তাকে স্থানীয় লোকজন ও পশুদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নেওয়ার তদারকির দায়িত্ব দেন। দাভিলা যখন বালবোয়াকে সাজা দিতে চাইলেন তখন তিনি পিজারোকে তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। পিজারো নতুন গভর্নরের নির্দেশ মতো যার সাথে সে দেশে গিয়েছিলেন সেই বালবোয়াকে গ্রেপ্তার করে তার হাতে তুলে দেন। ১৫১৯ সালে বালবোয়াকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়। দাভিলার প্রতি আনুগত্য দেখে দাভিলা তাকে পানামার মেয়রের দায়িত্ব দেন। তিনি ১৫১৯ সাল থেকে ১৫২৩ সাল পর্যন্ত পানামা সিটির মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।

পেরু অভিযান

পানামায় থাকা অবস্থায় লোকমুখে পেরুর ধনসম্পদ ও প্রাচুর্যের কথা পিজারোকে পেরুর দিকে টানতে থাকে। তিনি ১৫২৪ ও ১৫২৬ সালে পেরু অভিযান এবং ইনকা সভ্যতা দখল করার পরপর দুটি পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। উভয়ই ব্যর্থ হয় স্থানীয় কোন্দল, খারাপ আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত রসদের অভাবে।

চিত্রঃ পেরুর ধনসম্পদ লুট
চিত্রঃ পেরুর ধনসম্পদ লুট
Source: tripsavvy.com

পানামার নব-নিযুক্ত গভর্নর পেদ্রো দো লস রিওস পিজারোকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন কিন্তু পিজারো দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হতেই থাকেন। ১৫২৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি উত্তর পেরুতে পৌঁছেন এবং স্থানীয় জনগণের কাছে প্রচুর মূল্যবান ধনসম্পদের অস্তিত্বের টের পান। এই আবিষ্কার পিজারোকে অঞ্চলটি দখলে তৃতীয় অভিযানে অনুপ্রাণিত করে। এরপর তিনি পানামায় ফিরে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন কিন্তু গভর্নর তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। পিজারো তখন সরাসরি রাজা চার্লস-১ এর কাছে সরাসরি আবেদন করতে স্পেনে চলে আসেন। রাজা তাকে যে শুধু পেরু অভিযানের লাইসেন্স দেন তাই না বরং তাকে ইচ্ছেমত যেকোনো অঞ্চল দখলের অনুমতি দেন। এরপর পিজারো বন্ধু ও পরিবারবর্গ নিয়ে ১৫৩০ সালে নতুন অভিযানের উদ্দেশ্যে পানামা ত্যাগ করেন।

যখন তিনি পেরুর স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে কোণঠাসা হওয়ার উপক্রমে পড়েন তখন তিনি সেখানের প্রথম স্প্যানিশ অভিযানকারী সান মিগুয়েল দো পিউরার কাছে যান। পেরুর সম্রাট আথুয়ালপা তার অঞ্চলে নতুন স্প্যানিশ উপস্থিতি সহ্য করতে পারছিলেন না তাই তিনি প্রতিরোধ করছিলেন কিন্তু তিনি কাজামারকার যুদ্ধে পিজারোর কাছে বন্দি হন। পিজারো সম্রাটের মুক্তির বিনিময়ে এক ঘর স্বর্ণ মুক্তিপণ দাবী করেন। তিনি মুক্তিপণ আদায় করেন ঠিকই কিন্তু আথুয়ালপাকে মুক্ত না করে ১৫৩৩ সালের ২৬ জুলাই হত্যা করেন।

পিজারোর সামনে বন্দি আথুয়ালপা
পিজারোর সামনে বন্দি আথুয়ালপা
Source: tiempo26.com

একই বছর পিজারো ইনকার রাজধানী কাজকোতে প্রবেশ করেন এবং পেরু দখল সমাপ্ত করেন। ১৫৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তার প্রকল্প বাস্তবায়নের স্মৃতি স্বরূপ লিমা শহরের গোড়াপত্তন করেন।

দক্ষিণ আমেরিকা অভিযান

১৫২৪ সালে পানামাতে থাকা অবস্থায়ই পিজারো হার্নান্দো দো লুক নামের একজন ধর্মযাজক ও দিয়েগো দো আলমার্গো নামের একজন সৈন্যের সাথে দক্ষিণে অভিযান ও দখলের ব্যাপারে আঁতাত করেন। পিজারো, আলমার্গো এবং লুক পরবর্তীতে যা দখল করবে তা নিজেদের মধ্যে তিন ভাগে ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের চুক্তিকে দীর্ঘমেয়াদী করেন। তাদের চুক্তি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে যেখানে পিজারো অভিযানের নেতৃত্বে থাকবে, আলমার্গো সৈন্য ও খাদ্য সরবরাহ করবে এবং লুক অর্থ ও রসদ সরবরাহের দায়িত্বে থাকবে।

প্রথম অভিযান (১৫২৪)

১৫২৪ সালের নভেম্বরে প্রথম ৮০ জন সৈন্য ও ৪০ টি ঘোড়া নিয়ে পানামা থেকে পেরুর উদ্দেশ্যে পিজারো প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন। সে অভিযানে জুয়ান দো সালসেদো ঝাণ্ডা বাহক, নিকোলাস দো রিবেরা কোষাধ্যক্ষ এবং কারভেলো পরিদর্শকের  দায়িত্ব পালন করেন।

দ্বিতীয় অভিযান (১৫২৬)

দুই বছর পরে পিজারো, আলমারগো এবং লুক পেদ্রারিয়াস দেভিলার অনুমতি নিয়ে তাদের দ্বিতীয় অভিযানের জন্য আবারও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন কিন্তু গভর্নর দেভিলা পিজারোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং পিজারোকে অনুমতি না দিয়ে নিজেই নিকারাগুয়া তে একটি  অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ইতোমধ্যে পেদ্রো দো লোস রিওস নামের নতুন গভর্নর দেভিলার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি পিজারোর এই অভিযানের অনুমতি প্রদান করেন।

পিজারোর মৃত্যু

১৫৪১ সালের ২৬শে জুন দিয়েগো দো আলমারগো-২ “এল মোজো” এর ২০ জন ভারী অস্ত্রশস্ত্র বাহী একদল সমর্থক হঠাৎ করে লিমায় পিজারোর প্রাসাদে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে এবং শহরে দ্বিতীয় আলমার্গোকে নতুন গভর্নর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বুরখোলদার এবং জনসনের মতে পিজারোকে অতর্কিত আক্রমণের সময় তার প্রাসাদে অনেক অতিথিই অবস্থান করছিল কিন্তু খুব কমই তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। যারা এসেছিল তাদের সংখ্যা মতান্তরে সাত থেকে পঁচিশ। পিজারো বাঁচার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রাণপণে লড়াই করে তার দেহরক্ষী, সৎ ভাই মার্টিন দে আলকান্তারা সহ নিহত হন।

পিজারো নিজেই দুইজন আততায়ীকে হত্যা করে তৃতীয় জনকে যখন তলোয়ার দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই গলায় ছুরিকাঘাত হয় এবং সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং তারপর তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। ৭০ কিংবা অন্তত ৬২ বছর বয়সী পিজারো তার শরীরের ক্ষত দিয়ে বহমান রক্তধারা দিয়ে নিজহাতে মেঝেতে পবিত্র ক্রুশ চিহ্ন আঁকেন এবং জিসু খৃষ্টের স্মরণে কাঁদতে থাকেন। এরপর পিজারোর দেহাবশেষ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে অনেকক্ষণ অযত্নে পড়ে থাকার পরে শেষমেশ তার মাথা এবং শরীর পৃথক করে গির্জার মেঝে নীচে পৃথক পৃথক বাক্সে সমাহিত করা হয়।

চিত্রঃ পিজারোর কফিন
চিত্রঃ পিজারোর কফিন
Source: Wikipedia

এই ঘটনার খানিক বাদেই ফ্রান্সিসকো পিজারোর মৃত্যু হয় এবং নবীন আলমার্গো পেরুর সকল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

১৮৯২ সালে কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার বার্ষিকী পালনের সময় পিজারোর মরদেহ বিশ্বাস করে একটি কাচের কফিন প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে গির্জার পুনঃনির্মানের সময় খনন কার্যে গির্জার নিচে থেকে একটি বক্স উদ্ধার করা হয় যেখানে লেখা ছিল ‘এটি পিজারোর মস্তক, যে পেরু আবিষ্কার করেছিল’

পিজারোর উত্তরাধিকারীরা

এন দো ত্রুজিলোকে বিয়ে করার পর তাদের সংসারে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল যার নাম ও ছিল ফ্রান্সিসকো, যে পালিয়ে তার এক আত্মিয়াকে বিয়ে করেছিল। পিজারোর মৃত্যুর পর ইনেস ইয়্যুপাঙ্কুই, আথুয়ালপার প্রিয় বোন যাকে পিজারো বিয়ে করেছিলেন আথুয়ালপাকে বন্দি করে তিনি আম্পুয়েরো নামক একজন স্প্যানিশ যোদ্ধাকে বিয়ে করে তার কন্যা সন্তান সহ স্পেন ত্যাগ করেন। আথুয়ালপার এক স্ত্রী ডোনা এনজেলিনার সাথে পিজারোর অবৈধ প্রনয়ে তার তৃতীয় এক পুত্রের জন্ম হয় সে স্পেনে পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. https://www.biography.com/people/francisco-pizarro-9442295

২. www.history.com/topics/exploration/francisco-pizarro

৩. https://www.britannica.com/biography/Francisco-Pizarro

৪. https://www.allaboutexplorers.com/explorers/pizarro/

Leave A Reply
1 Comment
  1. Nrmngk says

    cost lamisil 250mg – griseofulvin ca griseofulvin online buy

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More