একটি জাতির সংস্কৃতি সেই জাতির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আচার, অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি সামগ্রিক পরিচয় বহন করে। দেশ, জাতি, ধর্মভেদে আচার ও রীতির ধরণও আলাদা হয়ে থাকে। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মাঝেই আছে এমনি উদ্ভট কিছু রীতি ও প্রথা যা হতবাক করে দেয় আধুনিক সভ্যতাকে। নিগূঢ় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করেই পালন করা হয় অদ্ভুত ও উদ্ভট কিছু রীতি। এইসব আচার ও সংস্কৃতিকে শুধু উদ্ভট বললে ভুল হবে। এরকম সাতটি বীভৎস, অদ্ভুত ও আজব সংস্কৃতি নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।
আঙুল কাটার রীতি :
পরিবারের কারো মৃত্যু বাকি সদস্যদের জন্য তীব্র বেদনাদায়ক। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার দানি উপজাতির মহিলাদের কাছে পরিবারের কারো মৃত্যু শুধু মানসিক নয়, শারীরিক যন্ত্রনার কারণও বটে। দানি উপজাতির মহিলারা প্রিয়জনের মৃত্যুশোক প্রকাশ করেন শারীরিক যন্ত্রনার মাধ্যমে যা কিনা বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। অর্থাৎ পরিবারের কেউ মারা গেলে শোকের তীব্রতা বোঝাতে মহিলারা স্বেচ্ছায় কেটে ফেলেন নিজেদের আঙুল। আঙুল কাটার যন্ত্রণা বা কষ্টকে বিবেচনা করা হয় প্রিয়জনকে হারানোর প্রতীক হিসেবে। মনে করা হয়, যে যত বেশি আঙুল কাটে তার শোকও তত গভীর।
কাটার আগে আঙুলগুলোকে অসাড় করার জন্য শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় অনেকক্ষণ। কাটা হয়ে গেলে আঙুলের অংশগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, এতে তাদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তিতে থাকবে। যদিও খুব কম তবুও এই উদ্ভট রীতি এখনও প্রচলিত রয়েছে।
স্বজাতিভক্ষণ প্রথা :
ইয়ানোমামি উপজাতির বাস ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিল সীমান্তে অ্যামাজন রেইনফরেস্টে। তারা মূলত উদ্ভট রীতি ও আচারের কারণেই বিখ্যাত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এরা নিজেদের গোষ্ঠীর সদস্যের মাংসই ভক্ষণ করে থাকে। সভ্য সমাজে কেউ মারা গেলে তাকে মাটি চাপা দেওয়া হয় বা পোড়ানো হয়। কিন্তু ইয়ানোমামি উপজাতিরা তাদের গোত্রের কউ মারা গেলে সেই মৃতদেহ সৎকারের বদলে ভক্ষণ করে থাকে।
মৃতদেহকে পাতা দিয়ে মুড়িয়ে রেখে দেওয়া হয় ত্রিশ চল্লিশ দিন। তারপর হাড়গুলোকে আলাদা করে গুড়ো করে কলার সাথে মিসিয়ে স্যুপ তৈরি করা হয়। এক বছর পর সেই মৃতদেহকে পুড়িয়ে ছাই করা হয়। সেই ছাই দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ স্যুপ। তাদের বিশ্বাস, এই রীতি মেনে চললে মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে পৌছাতে পারবে।
মৃতের সাথে বসবাস :
এবার আসি ইন্দোনেশিয়ার টোরাজা উপজাতির অদ্ভুত আচার নিয়ে যারা সভ্যতার এই প্রান্তে দাঁড়িয়েও বাস করে যাচ্ছেন মৃত মানুষের সাথে।
মৃত্যুর পরও ছাড়তে ইচ্ছে হয় না প্রিয়মানুষটিকে। তারপরও সৎকারের জন্য বিদায় দিতে হয় সেই সব কাছের মানুষকে। কিন্তু এই রীতি মানতে নারাজ ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের টোরাজা উপজাতিরা। তারা মৃতদেহকে সৎকার না করে বাড়িতেই রেখে দেয় বছরের পর বছর। মৃতদেহ রাখার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়। সেই ঘরে থাকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বিছানা, জামা কাপড়। প্রতিদিন খাবারও দেওয়া হয়। যতদিন না তার শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য জমকালো অনুষ্ঠান করার মতো অর্থ জোগাড় করা যায়, ততদিনই চলে মৃতের সঙ্গে প্রতিদিনের এই অদ্ভুত জীবনযাপন। বিদায়ের দিন মহা আয়োজন করা হয়। বলি দেওয়া হয় মহিষ। তারা বিশ্বাস করে মহিষ মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে পৌছে দেবে।
এখানেই শেষ নয়। প্রতি বছর মানেনে নামক এক উৎসবে মৃতদেহগুলোকে কফিন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। মৃতদেহকে নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে সাজিয়ে ঘোরানো হয় পুরো গ্রাম। শিশু থেকে শুরু করে অনেক বছর পুরোনো মৃতদেহগুলোও বাদ যায় না।
মূলত এই আচার মেনে চলা হয় মৃতদেহ পরিষ্কার করে নিজ গ্রামে ফিরিয়ে আনার জন্য। যদি কেউ গ্রামের বাইরে মারা গিয়ে থাকেন তাহলে সেই মৃতদেহকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং নিজের গ্রামে আবার ফিরিয়ে আনা হয় যেন তিনি নিজের ঘরে ফিরে আসছেন।
ভাল্লুক হত্যা করে উপাসনা :
জাপান ও রাশিয়ার আইনু সম্প্রদায়ে ভাল্লুক উৎসর্গ করার একটি প্রথা প্রচলিত রয়েছে। ধর্মীয় আচার অনুযায়ী তারা বিশ্বাস করে ভাল্লুক হলো ঈশ্বরের একটি রূপ। ভাল্লুকের মাধ্যমেই ঈশ্বর মানবজাতিতে অধিষ্ঠান করছেন। আর তাই ভাল্লুক উৎসর্গ করলে তা মানবআত্নার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
বহিরাগতদের কাছে এই আচার অবশ্যই অদ্ভুত ঠেকবে। গুহা থেকে ঘুমন্ত মা ভাল্লুককে হত্যা করে তার বাচ্চাকে নিয়ে আসা হয়। বাচ্চাগুলোকে দুই বছর ধরে প্রতিপালনের পর বর্শা দিয়ে হত্যা করা হয়।
ভাল্লুকের চামড়া বর্শার সাথে মুড়িয়ে এর মাথায় ভাল্লুকের খুলি ঝুলিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়। এরপর ভাল্লুকের রক্ত পান করে ও মাংস ভোজন করে গ্রামবাসীরা এই আচার পালন করে থাকে। এই প্রথাটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
স্ত্রীকে কোলে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটা :
চীনে বিয়ের একটি মজাদার প্রথা চালু রয়েছে। চীনের সব জায়গায় না থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় মেনে চলা হয় এই ঐতিহ্য।
বর যখন নববধূ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তখন তাদের মানতে হয় ভিন্ন এই রীতি। স্ত্রীকে কোলে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে প্রবেশ করতে হয় স্বামীকে। এর দ্বারা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝানো হয়।
স্ত্রী যখন গর্ভবতী হয় তখনও অনেকে এই আচার মেনে চলে। তাছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতেও তারা আগুনের উপর হেঁটে প্রার্থনা করে।
তিব্বতি আকাশ সমাধি :
আকাশ সমাধি হল তিব্বতিদের শেষকৃত্যের একটি রীতি। কারো মৃত্যু হলে এ রীতি অনুযায়ী দুই তিনদিন মৃতদেহ ঘরে রেখে দেওয়া হয়। এই সময়ে তিব্বতি সাধুরা নেচে গেয়ে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করে। তারপর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আকাশ সমাধি স্থলে। মৃতদেহ বিভিন্ন অংশে কেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয় পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় জীবজন্তদের উদ্দেশ্যে।
তারা মনে করে জীবদ্দশায় মানুষ যেমন জীব জন্তু হত্যা করে মাংস ভক্ষণ করে থাকে তেমনি মানুষের মৃত্যুর পরও যেন জীব জন্তুরা তাদের পাওনা মিটিয়ে নিতে পারে।
মৃতের বিয়ে :
চীনের শাংসি গ্রামের লোকেদের বিশ্বাস, যে বাড়ির ছেলে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যায় সে পরিবার অভিশপ্ত হয়ে যায়। অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলে মৃতের আত্মা শান্তি পায় না এবং তা ওই পরিবারকেও শান্তিতে থাকতে দেয় না। তাই মৃত ছেলের বিয়ে দিতেই তৎপর হয়ে উঠেন পরিবারের লোকজন। খোঁজ চলে অবিবাহিত মৃত কনের। ওই গ্রামের বেশির ভাগ লোক খনিতে কাজ করে। তাই অল্পবয়সে প্রাণ হারানোর সংখ্যাও বেশি। অনেক সময়ই মৃত ছেলের জন্য মৃত পাত্রী পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। তাই মৃত পাত্রকে তখনকার মত সমাধিস্থ করা হয়। পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেলে কবর থেকে মৃতদেহ তুলে বিয়ে দেওয়া হয়।
উদ্ভট রীতিগুলোর মাঝে কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিছু এমনিতেই বিলুপ্তির পথে। তারপরও এমনই অনেক অদ্ভুত ও বিকট সংস্কৃতি এখনও চালু রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে।