সাহারা মরুভূমি: সোনালি বালির এক অপরূপ রাজ্য

0

সাহারা মরুভূমি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উষ্ণ মরুভূমি এবং আয়তনের দিক থেকে ৩য় বৃহত্তম মরুভূমি। মরুভূমি বলতে সেই সব এলাকাকে বুঝায় যেখানে বৃষ্টিপাতের হার বছরে ১০ ইঞ্চির কম হয়ে থাকে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী  আর্কটিক এবং এন্টার্কটিকা মরুভূমি হওয়ার শর্ত পূরণ করে। এই দুই মরুভূমির পরেই সাহারা মরুভূমির স্থান। তবে অনেক সময় সাহারা মরুভূমিকে ভুলবশত “পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মরুভূমি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

‘সাহারা’ অর্থ কি?

সাহারা শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে আঞ্চলিক আরবি শব্দ “শাহরা” থেকে যার অর্থ “মরুভূমি। “সাহারা” শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় “শ্রেষ্ঠ মরুভূমি”।

সাহারা মরুভূমি
সাহারা মরুভূমি
Source: www.businesspost.ng

সাহারা মরুভূমি কোথায় অবস্থিত?

উত্তর আফ্রিকার বৃহদাংশ জুড়ে সাহারা মরুভূমির রাজত্ব। এই রাজত্বের পূর্বে লোহিত সাগর, উত্তরে মেডিটেরিয়ান সাগর এবং পশ্চিমে আছে আটলান্টিক সাগর। দক্ষিণে এই সীমানা ধরা হয়েছে সাহেল পর্যন্ত, এক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রায়-অনুর্বর শুষ্ক অঞ্চল। আলজেরিয়া, চাদ, মিশর, লিবিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, পশ্চিম সাহারা, সুদান এবং তিউনিসিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে সাহারা মরুভূমি। বালির রাজ্য হলেও সাহারা মরুভূমির অনেকগুলো অংশ রয়েছে যেখানে কিছু পর্বতমালা এবং তৃণভুমি আছে।

সাহারা মরুভূমি
সাহারা মরুভূমি

সাহারা মরুভূমি মূলত পাথুরে মালভূমি ও বালির সমুদ্র দিয়ে গঠিত। বালির সমুদ্র ঢাকা থাকে বালিয়াড়ি দিয়ে যার বেশিরভাগের উচ্চতা ১৮০ মিটারের বেশি হয়ে থাকে। বাতাস এবং হাল্কা বৃষ্টিপাতের কারণে বালিয়াড়ি, বালির সাগর, পাথুরে মালভূমি, শুষ্ক উপত্যকা, শুষ্ক হ্রদ ও নুড়ি প্রান্তরের সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু পর্বতমালা, কতগুলো আগ্নেয়গিরি, মরুভূমির বালির নীচ থেকে উঠে আসে। এদের মধ্যে এয়ার পর্বতমালা, আহাগার পর্বতমালা, সাহারান অ্যাটলাস, তিবেস্তি পর্বতমালা, আদ্রার দে ইফোরাস এবং রেড সি হিলস উল্লেখযোগ্য।

সাহারা মরু অঞ্চলের সবচেয়ে অনুর্বর মধ্য সাহারা। এই অঞ্চলে গাছপালাও খুব একটা নেই। ওয়াদিস এর মত মরুভূমির উত্তর এবং দক্ষিণ অংশ সহ উঁচু এলাকাগুলোতে মরূদ্যান, তৃণভূমি, ঝোপঝাড় এবং কিছু গাছপালার দেখা মেলে। মধ্য সাহারার এলাকাগুলোর মধ্যে তানেযরফ্ত, তেনেরে, লিবিয়ান মরুভূমি, পূর্বাঞ্চলের মরুভূমি, নুবিয়ান মরুভূমি এবং অন্যান্য এলাকাগুলো সাহারার সবচেয়ে শুষ্ক এলাকা এবং কখনও কখনও এসব এলাকায় বছরে কোন সময়েই বৃষ্টি হয় না!

সাহারা মরুভূমি
Source: Never Ever Seen Before

সাহারা মরুভূমিকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়- পশ্চিম সাহারা, তিবেস্তি পর্বতমালা, এয়ার পর্বতমালা, তিনেরি মরুভূমি এবং লিবিয়ান মরুভূমি।

সাহারা মরুভূমির আয়তন

উত্তর আফ্রিকার ৩১% অংশ জুড়ে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত। এর আয়তন ৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বা ৩,৫০০,০০০ বর্গমাইল। আর যদি বছরে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকাগুলোকে যোগ করা হয়, তাহলে সাহারার মোট আয়তন দাঁড়াবে ১১ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটারে বা ৪,২০০,০০০ বর্গমাইলে। সাহারা মরুভূমির মোট আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের প্রায় সমান।

সাহারা মরুভূমির পিছনের ইতিহাস

সাহারা মরুভূমি সবসময় কিন্তু মরুভূমি ছিল না। আইস এজ এর পর সাহারার চিত্র আজকের শূন্য এবং শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়। তবে, প্রায় ১০,৫০০ বছর আগে আকস্মিক ভারি বৃষ্টিপাত এই মরুভূমিকে বাসযোগ্য মরু প্রান্তরে পরিণত করে। পরবর্তী ১০০ বছর নিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে সাহারায় জনবসতি বৃদ্ধি পায় এবং ছাগল ও ভেড়ার মত পশুপালন শুরু হয়। কিন্তু প্রকৃতি আবার তার রুক্ষতায় ফিরে আসে। প্রায় ৭,৩০০ বছর আগে বৃষ্টিপাত কমতে শুরু করে এবং প্রায় ৫,৫০০ বছর আগে সাহারার জনবসতি পুনরায় নীলনদের উপত্যকায় ফিরে আসে।

সাহারা মরুভূমির তাপমাত্রা

সাহারা মরুভূমির আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে এবং সূর্যের স্থায়িত্ব কাল অত্যন্ত দীর্ঘ। মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ বছরে ৩,৬০০ ঘণ্টা বা  ৮২% এর বেশি  সূর্যরশ্মি পেয়ে থাকে এবং পূর্বাঞ্চলে এর পরিমাণ ৪,০০০ ঘণ্টা বা ৯১% এর বেশি। সবচেয়ে বেশি উত্তাপের রেকর্ডের অধিকারী মিশরের উঁচু এলাকা (আসওয়ান ও লুক্সর) এবং নুবিয়ান মরুভূমি (ওয়াদি হালফা)।

সূর্যের অবিরত অবস্থান, কম গাছ-পালা, স্বল্প বৃষ্টিপাত এবং কম আর্দ্রতার ফলে সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত মরুভূমি এবং গ্রীষ্মে সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকা  সাহার মরুভূমি। গ্রীষ্মে এই মরুভূমির প্রায় সব জায়গায় গড় তাপমাত্রা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০০.৪ থেকে ১০৪.০ ডিগ্রী ফারেনহাইটে পৌঁছায়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল আলজেরিয়ান মরুভূমির বোউ বারনোস শহরের দখলে, ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১১৬.৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিকে প্রতিদ্বন্দ্বী রেখে এটিই এই পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গড় তাপমাত্রা।

মরুভূমির বালুর তাপমাত্রা আরও বেশি! দিনের বেলা বালু প্রচণ্ড গরম থাকে। ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১৭৬ ডিগ্রী ফারেনহাইটে উঠে যায় নিমেষেই! সুদানে বালুর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮৩.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস (১৮২.৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট)।

বাতাসে কম আর্দ্রতা এবং আকাশে মেঘ স্বল্পতার কারণে মরুভূমিতে সাধারণত প্রতিদিন দিন ও রাতের তাপমাত্রার বিশাল পার্থক্য ঘটে। দিনে প্রচণ্ড গরম আর রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা কেবল প্রচলিত বিশ্বাস মাত্র। রাতের বেলা সাহারার দৈনিক গড় তাপমাত্রা সাধারণত ১৩ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অথবা ২৩.৪ থেকে ৩৬.০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। কখনও কখনও তাপমাত্রা উপকূলীয় এলাকায়  ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১৮ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নিচে নামে, যেখানে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি।

সাহারা মরুভূমি
Source: DesertUSA

সাহারা মরুভূমির জীব-বৈচিত্র্য

মরুভূমি হলেও সাহারার আছে মরু অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক বিচিত্র জীবজগৎ। বৃষ্টিপাতের ভিত্তিতে সাহারার বৃক্ষরাজি বিভক্ত তিনটি প্রধান এলাকায়- উত্তরাঞ্চল (মেডিটেরিয়ান), মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল। সাহারা মরুভূমিতে উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২৮০০ প্রজাতির বৃক্ষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই সংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ সাহারার স্থানীয় উদ্ভিদ। মধ্য সাহারায় ৫০০ প্রজাতির গাছ রয়েছে যা এলাকার বিশালতার কাছে সামান্যই বটে। আকাসিয়া, খেজুর, সাকুলেন্ট, কাঁটাবন এবং ঘাসগুলো মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে- শক্তিশালী বাতাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে আকারে ছোট, শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য স্থূলকায় কাণ্ড, পানির সন্ধান করার জন্য মাটির নিচে প্রশস্ত মূল এবং ছোট মোটা পাতা অথবা কাঁটা যা আর্দ্রতা ধরে রাখে।

খেজুর গাছ
খেজুর গাছ Source : ThingLink

সাহারা মরুভূমির প্রাণীকুলও বেশ সমৃদ্ধ। সাহারায় বেশ কয়েক প্রজাতির শিয়ালের বাস। তাদের মধ্যে ফেনেক ফক্স, পেল ফক্স এবং রুপেলস ফক্স অন্যতম। এডেক্স নামক বিশাল এন্টিলোপের বাস সাহারা মরুভূমিতে এবং তারা পানি ছাড়া প্রায় এক বছর পর্যন্ত বাঁচে! দরকাস গাযেল নামক হরিণও অনেকদিন পর্যন্ত পানি ছাড়া বাঁচে এবং সাহারায় এই প্রজাতির হরিণ দেখতে পাওয়া যায়।

ফেনেক ফক্স
ফেনেক ফক্স ; Source:
Chirkup.me

আলজেরিয়া, তোগো, নাইজার, মালি, বেনিন এবং বুরকিনা ফাসো অঞ্চলে সাহারান চিতার দেখা মেলে। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, বর্তমানে মাত্র ২৫০ টি পূর্ণবয়স্ক সাহারান চিতার অস্তিত্ব আছে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের সূর্য এড়িয়ে চলা এই চিতাবাঘগুলো সাধারণত ফ্যাকাসে বর্ণের হয়। সাহারান চিতা ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির চিতাগুলো চাদ, সুদান এবং নাইজারের পূর্বাঞ্চলে বাস করে। এছাড়া সাহারা মরুভূমিতে মনিটর লিজার্ড, হাইরেক্স, স্যান্ড ভাইপার, রেড-নেক অস্ট্রিচ, আফ্রিকান সিলভার বিল, ব্ল্যাক ফেইসড ফায়ারফিঞ্চ এবং কিছু সংখ্যক আফ্রিকান বুনো কুকুর বাস করে। মৌরিতানিয়া এবং এনেদি মালভূমিতে কিছু ছোট প্রজাতির কুমির বাস করে।

সাহারান চিতাবাঘ;
সাহারান চিতাবাঘ; Source:
AnimalSake

মরুভূমির আরেক স্থানীয় বাসিন্দা ডেথস্টকার বিছা। এরা প্রায় ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এই বিছার বিষে অনেক বেশি পরিমাণে এজিটক্সিন এবং সাইলাটক্সিন থাকে যা অত্যন্ত বিপদজনক; এক দংশনে স্বাস্থ্যকর পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে। সাহারান সিলভার অ্যান্ট সাহারা মরুভূমির উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে এবং শিকারির কবল থেকে বাঁচার জন্য দিনে কেবল ১০ মিনিটের জন্য এরা আস্তানা থেকে বের হয়। সাধারণত পালিত পশু হিসেবে বিবেচ্য ড্রমেডেরি উট এবং ছাগলের দেখা মেলে সাহারা মরুভূমিতে। দ্রুত গতি এবং সহ্য ক্ষমতার জন্য এই দুই জাতের পশু যাযাবরদের কাছে জনপ্রিয়।

ডেথ স্টকার বিছা
ডেথ স্টকার বিছা; Source: Conservation Institute
রেড-নেক অস্ট্রিচ
রেড-নেক অস্ট্রিচ, Source :
The Mysterious World

বর্তমান সাহারা

১০০ বছর আগের সাহারার তুলনায় বর্তমান সাহারা প্রায় ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পাওয়া গেছে। এর পেছনে বিশ্ব উষ্ণায়নের অবদান কিছুটা হলেও দায়ী।

বর্তমান সাহারা
বর্তমান সাহারা
Source: Sahara Overland

একই সাথে খরা এবং বৃষ্টিপাতের হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কারণেও দিন দিন এই মরুভূমি বিশাল থেকে বিশালত্বর হতে চলেছে। এসব কারণের সাথে আরও যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির মানবসৃষ্ট পরিবর্তন। যার ফলে, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, সাহারার বৃদ্ধি বাড়বে বৈ কমবেনা!

Source Featured Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More