অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় (শেষ পর্ব)

31

প্রথম পর্বের পর-

১৩৬২ সালে ওরহান মারা যাবার পর, তার একমাত্র উত্তরসূরি ছিলেন মুরাদ। সুলেমান পাশা নামে তার আরও একজন সন্তান ছিল কিন্তু তার মৃত্যুর এক বছর পূর্বে সুলেমান শিকার করতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান।

রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্যের রূপ দেন সুলতান মুরাদ

অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনজন সুলতানকে বিবেচনা করা। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন মুরাদ। মুরাদ যোদ্ধার চেয়ে কূটনৈতিক হিসেবে বেশি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে একটি জাতিকে রূপ দেন। তিনি বিশাল একটি আধুনিক সেনাবাহিনী নিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর শক্তি সরাসরি ব্যবহার করেননি। তবে তিনি সেটা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন। এভাবেই ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপরের কাজ ছিল সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর। বিভিন্ন অঞ্চল জয়  এবং বাইজেন্টাই সাম্রাজ্যের বাকি অংশ দখল এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ দখল করার জন্য অটোমান সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করা ছিল মুরাদের কাজ। তিনি সামরিক নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার সময়ে অত্যন্ত সফল ছিলেন। তিনি তার রাজত্ত্বকালে পশ্চিমাদের পূর্বের কাছে মাথানত করতে বাধ্য করেন যেটা এক সময় পূর্ব পশ্চিমের নিকট করেছিল।

সুলতান মুরাদ
সুলতান মুরাদ
Source: YENİ.MOBİ

ওরহান ছিলেন ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের অগ্রদূত এবং তার ছেলে মুরাদ ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম শ্রেষ্ঠ সুলতান। চতুর্দশ শতাব্দির বাকি সময় জুড়ে তিনি শাসন করেছেন। মুরাদ একজন যুদ্ধবাজ হয়েও হয়েও সামরিক আগ্রহকে পাশে রেখে নেতৃত্বের গুণাবলির মাধ্যমে অটোমান অঞ্চলকে বলকান দ্বীপপুঞ্জের শেষ সীমানা পর্যন্ত বর্ধিত করেন। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং রাজনৈতিক ভাবে বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিশাল এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত সরকার ব্যবস্থার কাঠামো গড়ে তোলেন। এভাবে ভেঙে যাওয়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ভেঙে যাওয়া অংশগুলো একত্রিত করে শূণ্যস্থানটি এমনভাবে পূরণ করেন যা সেই সময়ের অন্য কোন শক্তি সেটা করতে পারেননি। মুরাদ তার রাজ্য অভিষেকের মাত্র পনেরো মাসের মধ্যে  থ্রেসের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়। এছাড়া চোরলূল দূর্গে অটোমানরা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বলকানের সমস্ত অঞ্চলে তুর্কিভীতি ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় মুরার বুরসার পরিবর্তে আড্রিয়ানোপলে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। এরপর অটোমানরা আরো ভয়ংকর হতে থাকে, তারা কনস্টান্টিনোপলকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমে যাত্রা শুরু করে। অটোমানরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট জন পালাইয়োলগকে একজন পুতুল সম্রাটে পরিণত করেন। ১০ বছর পর তিনি মুরাদকে নিজের অধিরাজ মেনে নিয়ে মুরাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

এর মধ্যে অটোমান সেনাবাহিনী ইউরোপের অভ্যন্তরে বুলগেরিয়া, মেসোডেনিয়া, সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরি পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু পোপ আরবানের নেতৃত্বে খ্রিস্টান শক্তিরা নিজেরা একত্রিত হয়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ১৩৬৩ সালে সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরির সেনাবাহিনী অটোমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য আড্রিয়ানোপলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে কিন্তু রাতের অন্ধকারে উৎসব শেষে হাঙ্গেরির সৈন্যরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন অটোমানরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার সৈন্যরা পালানোর চেষ্টা করলেও অটোমান সৈন্যরা সকলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এরপর খ্রিস্টানরা আরো কয়েকবার মুরাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের কারনে তারা ব্যর্থ হোন।

অটোমান সেনাবাহিনী
অটোমান সেনাবাহিনী
Source: Realm of History

ইউরোপে এসে অটোমানদের রাজ্যের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং রাজ্যসমূহে বিভিন্ন জাতি,ধর্ম,বর্ণ,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষা ছিল। এদের সংমিশ্রণ করা ছিল কঠিন কাজ কিন্তু এক্ষেত্রে মুরাদ তার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন।

বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টানরা ইসলাম সম্পর্কে তেমন জানতো না তাই তারা সহজে ধর্মান্তরিত হতেও রাজি ছিল না, অন্যদিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করতে গেলেও হিতে বিপরীত হতে পারে সেটা ভেবে। মুরাদ স্থানীয় সৈন্যদের তার প্রতি অনুগত করার জন্য হাজার হাজার খ্রিস্টান সৈন্যদের তাদের জমিদারিতেই বা তাদের রাজকুমারের অধীনেই নিয়োগ দেন এবং তাদের মুক্ত করে দেন, সেই সাথে রাষ্ট্রীয় জমি ভোগ করারও অধিকার দেন। মুরাদ খ্রিস্টান সেনাবাহিনী থেকে সবচেয়ে সুদক্ষ সেনাদের নিয়ে একটি আলাদা সুশৃঙ্খল বাহিনী গড়ে তোলেন যারা সুলতানকে  ব্যক্তিগত ভাবে সেবা প্রদান করত। এরাই হচ্ছে বিখ্যাত জানিসারিস বাহিনী। ওরহানের সময় এরা ছিলেন দেহরক্ষী কিন্তু মুরাদ এদের মিলিশিয়া বাহিনীতে পরিণত করেন। ইউরোপে জয় করা খ্রিস্টান অঞ্চল সমূহের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য এদের প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রতিটি বিজয়ী এলাকা থেকে যারা ধর্মান্তরিত অনিচ্ছুক ছিল তাদেরকে নিয়ে জানিসারিস বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ১৩৩৬ সালে মুরাদ মারিতজা উপত্যকার প্রায় সবটুকু এবং বুলগেরিয়ার দক্ষিণ ভাগ দখল করে নেন এবং এখানকার সম্রাট সিসমান তার প্রজায় হন।

বাইজেন্টাইন বিদ্রোহের মধ্যস্থতাকারী মুরাদ

১৩৭২ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট তার বিদ্রোহী সন্তান আন্ড্রোনিকাশকে বন্দি করেন কিন্তু আন্ড্রোনিকাশ বন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়ে জেনোইস এবং অটোমান সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন এবং পিতা এবং ছোট ভাই ম্যানুয়েলকে বন্দি করেন। আন্ড্রোনিকাশ নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। তিন বছর বন্দি থাকার পর সম্রাট ও তার ছোট সন্তান পালিয়ে যান কিন্তু তাদের ধরে মুরাদের নিকট পেশ করা হয়। এ সময় মুরাদ নিজের স্বার্থকে ব্যবহার করে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে দেন। আন্ড্রোনিকাশকে সলোনিকার গভর্ণর করেন আর তার পিতাকে বিপুল পরিমাণ বার্ষিক করের নিশ্চয়তায় পুনরায় সম্রাট হিসেবে বসান।

বাইজেন্টাইন বিদ্রোহ
বাইজেন্টাইন বিদ্রোহ
Timetoast

সেই সাথে সম্রাট তাকে এশিয়ার সর্বশেষ বাইজেন্টাইন শহর ফিলাডেলফিয়াকে অটোমানদের হাতে দিয়ে দেন কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে সম্রাট এবং তার ছোট ছেলে ম্যানুয়েল সেখানে মুসলিম শাসণ কায়েম করার জন্য খ্রিস্টানদের বিপক্ষে লড়েন। এভাবেই একজন বাইজেন্টাইন সম্রাটের প্রভাব-প্রতিপত্তির চূড়ান্ত অবনমন ঘটে যখন তাকে তুর্কি সুলতানের দয়া আর বদান্যদায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়।এরপর সার্বিয়ার দিকে মুরাদ নজর দেন। সার্বিয়াতে অগ্রসর হওয়ার জন্য সোফিয়া দখল করাটা অটোমানদের জন্য জরুরী হয়ে পড়ে কারণ এর অবস্থান ছিল বলকান অঞ্চলের একদম কেন্দ্রে ছিল। ১৩৮৫ সালে সোফিয়া কোন রকম যুদ্ধপাত ছাড়াই অটোমানদের দখলে চলে আসে।

ইউরোপের প্রভু মুরাদ

ইউরোপে মুরাদ বলকানে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রভু হিসেবে কনস্টান্টিনোপল থেকে বেলগ্রেড পর্যন্ত রোমান মহাসড়কের পাঁচ ভাগের চার ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ১৩৮৮ সালে সুলতান মুরাদ বুলগেরিয়া জয় করেন। বুলগেরিয়া জয় করার পর তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে সার্বিয়ার দিকে অগ্রসর হন। স্বাধীন সার্বিয়ার ভাগ্য নির্ধারণের এই যুদ্ধ হয় কসোভোর জনশূণ্য এক প্রান্তরে। সার্বিয়া এবং তার মিত্ররা সংখ্যায় ছিল কম কিন্তু নৈতিকভাবে এবং আত্মবিশ্বাসে ছিল ভরপুর। মুরাদ বিজয় নিশ্চিতের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন  যেন যুদ্ধের সময়ে কোনো রাজপ্রাসাদ, শহর বা গ্রাম ধ্বংস না হয়।  একটি সমৃদ্ধ দেশের অধিকার পাওয়ার জন্য তিনি এর সম্পদ নষ্ট না করতে কড়া ভাবে নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে সার্বিয়ানদের মধ্যে ছিল বিশ্বাসের অভাব এবং সেনাবাহিনীতি বিশ্বাসঘাতকও ছিল। তাদের নেতৃত্বে থাকা রাজকুমার লাজার, তার জামাতাকে রাজদ্রোহী আখ্যা দেন। মুরাদ বাতাসের গতিবেগ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন কারণ বাতাস শত্রু পক্ষের দিক থেকে বইছিল তাই অটোমান সৈন্যদের চোখে ধুলা পড়ার আশঙ্কা ছিল। যুদ্ধের আগের দিন রাত্রে মুরাদ ইবাদাত করে কাটান এবং শহীদের মতো মৃত্যু কামনা করেন। পরদিন সকালে বাতাস পড়ে যায়, যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। শত্রুপক্ষে লাজারের জামাতা ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে সরে পড়েন ফলে তারা এত দূর্বল হয়ে পড়ে যে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু লাজারের জামাতার সরে ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। তিনি মুরাদের আনুগত্য প্রকাশের ছলনায় তার নিকট উচ্চ পদবি দাবি করেন, মুরাদ মঞ্জুর করলে তিনি সুলতানে সামনে হাঁটু গেড়ে বশ্যতা স্বীকারের অভিনয় করার সময় মুরাদের বুকে ছোরা ঢুকিয়ে দেন। মুরাদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে যান। এভাবেই বিজয়ের মূহুর্তে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম শ্রেষ্ঠ শাসকের জীবনাবসান ঘটে।

অটোমান সৈন্য
অটোমান সৈন্য
Source: Realm of History

মুরাদ মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যেই পিতার রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যের পর্যায়ে নিয়ে যান।

বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের রাজত্ত্বকাল

১৪৫১ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ। তিনি ছিলেন সুলতান প্রথম মেহমেদের পৌত্র এবং দ্বিতীয় মুরাদের পুত্র। প্রথম মুরাদের মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্যে সুলতান হিসেবে রাজত্ত্ব করেন সুলতান প্রথম বায়েজিদ, সুলতান প্রথম মেহমেদ এবং সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ। দ্বিতীয় মুরাদের সন্তান ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ। তার বাবা দ্বিতীয় মুরাদ তার ত্রিশ বছরের রাজত্বকালে ন্যায়বিচার, বিশ্বস্ততা,  প্রজাদের জন্য মঙ্গলময় কর্মকান্ডের জন্য অটোমান জনগণের নিকট থেকে স্নেহ ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন।  সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ প্রথম বারের মতো কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করেন। কিন্তু গ্রিকরা তাদের শহর প্রতিরক্ষা করে। ইতিমধ্যে সম্রাট ম্যানুয়েলের মৃত্যু হলে মুরাদ ম্যানুয়েলের উত্তরসূরি অষ্টম জনের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ থেকে সরে আসেন। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ বড় ভাইয়েরা কম বয়সে মারা যাওয়ার কারণে ১৪৪৪ সালে দ্বিতীয় মুরাদ মেহমেদকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে অবসরে চলে যান। কিন্তু ১৪৪৬ সালে দ্বিতীয় মুরাদ ফিরে আসেন কারণ সেই সময় দ্বিতীয় মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল আক্রমণে উদ্যত হন কিন্তু সেই সময় অটোমান সৈন্যরা গ্রিক এবং আলবেনিয়া সীমান্তে ব্যস্ত ছিল। এ সময় তার সাথে মেহমেদের সাথে জানিসারিসদের সাথে বিরোধ হয়। দ্বিতীয় মুরাদ পুনরায় সিংহাসনে বসেন এবং মেহমেদ অবসর নেন। দ্বিতীয় মুরাদ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সুলতান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যান।

কনস্টান্টিনোপল দখলের প্রস্ততি

১৪৫১ সালে মুরাদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মেহমেদ পুনরায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন। প্রথম দিকে তাকে ইউরোপীয়রা আমলে না নেননি। তাকে দেখে কারও মনে হয়নি যে তিনিও তার পিতার মতোই দক্ষ হয়ে উঠবেন। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ দৈহিক ভাবে ছোটখাটো ছিলেন কিন্তু তিনি অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন। নিজের উপস্থিতির মাধ্যমে চারপাশের মানুষের শ্রদ্ধা আদায় করে নেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল তার। সুলতান মেহমেদ নতুন নতুন সামরিক সরঞ্জামের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। হাঙ্গেরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার আরবান কামান তৈরি করে তাকে আরো বেশি উৎসাহী করে তোলেন এই বলে যে, এই কামানের গোলা শুধু বাইজেন্টাইন নয়, ব্যাবিলনের দেওয়ালও ফুটো করে দিতে পারবে। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ আরবানকে আরো দুইগুণ বড় কামান তৈরির নির্দেশ দেন। কামান তৈরি শেষ করার পর দেখা যায় এই কামান স্থানান্তর করার জন্য সাতশ সৈন্য এবয় পনেরো জোড়া ষাঁড়ের দরকার হয়।

কনস্টান্টিনোপল
কনস্টান্টিনোপল
Source: historycollection.co

কামানটি পরীক্ষা করে দেখা যায় সেটি এক মাইল ছুটে গিয়ে দেয়ালে ৬ফুট গভীর গর্ত করতে পারে। মহড়ায় উল্লসিত হয়ে সুলতান সেতু এবং রাস্তা মেরামত করার নির্দেশ দেন এই কামান যেন বসন্তে কনস্টান্টিনোপলের দেওয়ালের বাইরে স্থাপন করা হয়। ১৪৫২ সালের পুরো শীত জুগে সুলতান কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে তিনি পরীক্ষা করতে থাকেন নিজের কৌশল, পরিকল্পনা এবং আক্রমণের প্রস্তুতি। ছদ্রবেশে শহরে ঘুরে তিনি সৈন্যদের এবং সাধারণ মানুষদের মনোভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। নিজের সাম্রাজ্যে প্রতিটি প্রদেশ থেকে সৈন্য এনে থ্রেসে জড়ো করেন যাদের সংখ্যা দাঁড়ায় শত হাজারে। এদের মধ্যে জানিসারিস ছিল ১২হাজার। রাজ্যজুড়ে কারিগররা তৈরি করতে থাকেন বর্ম,বর্শা,শিরস্ত্রাণ, তরবারি, তীর-ধনুক এবং প্রকৌশলীরা বানায় চাকা। এই বিশাল বাহিনীর সামনে কনস্টান্টিনোপলের গ্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র সাত হাজার।

কনস্টান্টিনোপল অবরোধ

২ এপ্রিল ১৪৫৩ সালে সুলতান মেহমেদ কনস্টান্টিনোপলের দরজার কাছে পৌঁছান। এরপর কনস্টান্টিনোপলের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সুলতান কনস্টান্টিনোপলে সম্রাটের কাছে দূর পাঠান যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির জন্য। শহরের অধিবাসীদের সুলতান আত্মসমর্পণ করতে বলেন বিনিময়ে নিরাপত্তা ও সম্পত্তি লাভের কথা বলেন কিন্তু তারা সেটা প্রত্যাখান করে। এরপর এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ শুরু হয় গোলাবর্ষণ। শহরের দেয়াল ফুটো করার জন্য সুলতান মানব শক্তির চেয়ে গোলন্দাজের ওপর নির্ভর করেছেন বেশি। কিন্তু বিশাল বিশাল গোলার আঘাতে কোন কোন অংশ সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কার্যকর কোন ফাটল তৈরি করতে পারেনি বরং গ্রিকরা ক্ষতিগ্রস্থ দেয়াল দ্রুতই মেরামক করে নেয়। সুলতান সমুদ্রেও আশানুরূপ ফল পাচ্ছিলেন না। গোল্ডেন হর্ণের ওপর গ্রিকদের আধিপত্য পূর্বের মতোই ছিল। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ বুঝতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র স্থলপথে আক্রমণ করে ফল পাওয়া যাবে না কিন্তু সমুদ্র পথেও ব্যর্থ হন। সেই সময় সুলতানকে এক ইতালিয়ান সৈন্য অভিনব বুদ্ধি দেন। জমির উপর দিয়ে জাহাজ গুলো টেনে বসফরাস থেকে গোল্ডেন নিয়ে আসার বুদ্ধি দেন। সুলতানের প্রকৌশলী সেই বুদ্ধি মোতাবেক সমুদ্রপৃষ্ঠে ২০০ ফুট উচ্চতায় উপত্যকা থেকে পোতাশ্রয় পর্যন্ত ঢালু রাস্তা নির্মাণ করেন। সেই রাস্তার উপর উপর দিয়ে তৈলাক্ত কাঠের গুড়ির সাহায্যে গ্রিক সৈন্য এবং পাহারাদের সামনে চোখের সামনে গোল্ডেন হর্ণে সত্তরটি অটোমান জাহাজ পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। গোল্ডেন হর্ণে গ্রিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। ফলে পোতাশ্রয় এবং স্থল উভয় দিকে কনস্টান্টিনোপল দূর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু নৌ-পথের এই সহসা বিজয় স্থলপথে বিজয় সৃষ্টি করতে পারেনি।

অটোমান সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্থান
অটোমান সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্থান
Source: YouTube

কনস্টান্টিনোপলের পতন, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্থান

প্রায় সাত সপ্তাহ অবরোধ করে রাখার পরও আধুনিক অস্ত্রাদি নিয়েও কোন তুর্কি সৈন্য শহরের দেয়ালের ওপরপা ফেলতে পারেননি। এ অবস্থায় প্রধান উজির হালিল দূল মারফত সম্রাটের নিকট বার্ষিক মোটা অঙ্কের করের বিনিময়ে শান্তির প্রস্তাব দেন অথবা শহর খকলি দিতে হবে। কিন্তু সম্রাট সেটি প্রত্যাখান করেন। ফলে সুলতান মাহমুদ গর্জে ওঠেন। আত্মসমর্পণ ব্যতীত গ্রিকদের আর কোন সুযোগ দেওয়া হবে না বলে জানান। সুলতান মে মাসের ২৯ তারিখ ভয়ংকর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সৈন্যদের উৎসাহিত করার জন্য শহরের সম্পত্তি তাদের মাঝে সমবণ্টন করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। সৈন্যরা উৎসাহিত হয়ে রাত জেগে পরিখা নির্মাণ করেন। তুর্কিদের উল্লাস দেখে গ্রিকদের প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। ১৪৫৩ সালে ২৯ মে শুরু হয় সুলতানের আক্রমণ। বাদকেরা যুদ্ধের দামামা বাজান, অন্যদিকে গ্রিকরা গির্জার ঘন্টা বাজিয়ে জানান দেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। গ্রিক পুরুষরা যুদ্ধ করার জন্য ছুটে আসেন, মহিলারা হাতে পাথর তুলে নেন। এর মধ্যে তিনবার দেয়ালে আক্রমণ সফল হয়। প্রথমে অস্থায়ী সেনাদল দুই ঘন্টা যুদ্ধ করে শত্রুকে ভয় পাইয়ে দেয়। এরপর আনাতোলিয়ার  সুদক্ষ সেনাবাহিনী দেয়াল ফুটো করে ভিতরে প্রবেশ করেন কিন্তু গ্রিক সম্রাট তাদের কঁচুকাটা করেন, যারা বেঁচে ছিলেন তাদের পরিখার কাছে ফেরত আসতে বাধ্য করেন। কিন্তু এরপর একদল তুর্কি সেনা দেয়ালের উত্তর দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে টাওয়ারে চড়ে বসে। সেই সময় গ্রিক সেনাপতি জিউসের বুকের বর্ম ভেদ করে গুলি ঢুকে গেলে তিনি মারাত্মক আহত হন। তিনি যন্ত্রণা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার পর গ্রিক সৈন্যরা মনোবল ভেঙে যায়। জানিসারিসরা গ্রিকদের কঁচুকাটা করে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়। বিজয়ী সেনাদল সুশৃঙ্খল ভাবে শহরে প্রবেশ করে নরহত্যা শুরু করে।

১৪৫৩ সালে ২৯ মে কনস্টান্টিনোপলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কবর রচিত হয় আর অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপে প্রকৃত অর্থে সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যা বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

সুলতান মেহমেদের নাম হয় বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ।

Source Featured Image
Leave A Reply
31 Comments
  1. grandpashabet

    অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় (শেষ পর্ব) – ইতিবৃত্ত

    https://on-news.ru/exclusive/ne-videli-snegouborochnykh-mashin-i-dvo

  2. child porn

    অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় (শেষ পর্ব) – ইতিবৃত্ত

    http://cinesoku.net/archives/34273.html

  3. MarcelZor says

    https://indiaph24.store/# india pharmacy

  4. StevenJeary says

    buying prescription drugs in mexico online: Online Pharmacies in Mexico – mexican drugstore online

  5. MichaelLIc says

    https://canadaph24.pro/# cheap canadian pharmacy

  6. RickyGrila says

    canadian king pharmacy canadian 24 hour pharmacy my canadian pharmacy

  7. Tproed says

    order semaglutide pill – buy DDAVP generic order DDAVP generic

  8. RickyGrila says

    online shopping pharmacy india Generic Medicine India to USA top 10 online pharmacy in india

  9. MichaelLIc says

    https://indiaph24.store/# п»їlegitimate online pharmacies india

  10. StevenJeary says

    canadian pharmacies: Large Selection of Medications from Canada – canadian compounding pharmacy

  11. RickyGrila says

    canadian drug pharmacy canadian pharmacies canadianpharmacymeds com

  12. RickyGrila says

    legit canadian online pharmacy Licensed Canadian Pharmacy buy prescription drugs from canada cheap

  13. MichaelLIc says

    https://canadaph24.pro/# canadian pharmacy meds review

  14. RickyGrila says

    world pharmacy india п»їlegitimate online pharmacies india online pharmacy india

  15. Iehbkm says

    buy terbinafine for sale – order fulvicin 250 mg sale buy grifulvin v generic

  16. RickyGrila says

    Online medicine home delivery indian pharmacy online shopping pharmacy india

  17. StevenJeary says

    canadian online pharmacy reviews: Prescription Drugs from Canada – buying drugs from canada

  18. RickyGrila says

    best online pharmacies in mexico mexican pharmacy mexican rx online

  19. RickyGrila says

    buying prescription drugs in mexico mexican pharmacy mexican pharmaceuticals online

  20. MarcelZor says

    http://indiaph24.store/# indian pharmacy online

  21. StevenJeary says

    buying prescription drugs in mexico online: Online Pharmacies in Mexico – medicine in mexico pharmacies

  22. RickyGrila says

    buying from online mexican pharmacy Mexican Pharmacy Online mexican pharmacy

  23. RickyGrila says

    Online medicine home delivery indian pharmacy п»їlegitimate online pharmacies india

  24. MichaelLIc says

    http://mexicoph24.life/# mexican rx online

  25. RickyGrila says

    reputable indian online pharmacy Generic Medicine India to USA mail order pharmacy india

  26. RickyGrila says

    mexican border pharmacies shipping to usa mexico pharmacy mexican border pharmacies shipping to usa

  27. RickyGrila says

    medicine in mexico pharmacies mexico drug stores pharmacies mexican online pharmacies prescription drugs

  28. MichaelLIc says

    https://canadaph24.pro/# trusted canadian pharmacy

  29. RickyGrila says

    top 10 online pharmacy in india indian pharmacy indian pharmacies safe

  30. RickyGrila says

    buying prescription drugs in mexico online Mexican Pharmacy Online mexican pharmacy

  31. RickyGrila says

    purple pharmacy mexico price list Mexican Pharmacy Online reputable mexican pharmacies online

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More