আজিমুল্লাহ খাঁঃ সিপাহী বিদ্রোহের পশ্চাতে একজন দূত

0

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস পড়তে গেলে মঙ্গল পাণ্ডের সাথে সাথে আরো একজন মানুষের নাম চলে আসে। তিনি আর কেউ নন আজিমুল্লাহ খাঁ। উপমহাদেশীয় ইতিহাসে তাকে সিপাহী বিদ্রোহের দূত বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশদের চোখে তিনি নিতান্তই একজন ধূর্ত, রক্তপিপাসু, নৃশংস প্রতারক হিসেবেই চিহ্নিত হন। বিপ্লবের কাহিনীর পিছনের অংশ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে তার প্রতিভা, কূটবুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টির দিক দিয়ে জেমস বন্ডের মতো স্পাইয়ের থেকে ভয়ংকর ও কৌশলী এবং বুদ্ধিদীপ্ত।

জন্ম ও বাল্যকাল

রূপকথার কাহিনীর মতো আজিমুল্লাহ খাঁর জীবন। ১৮৩০ সালে কানপুরে নিতান্তই এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হয়। দুমুঠো ভাত জুটয়ে খাবার মতো অবস্থা তাদের ছিলনা। ছোট বেলায় যখন তার খেলার সময় তখন কিনা অর্থাভাবে তাকে এক ইংরেজ সাহেবের বাড়িতে বয়ের কাজে ঢুকতে হয়। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন বেশ চটপটে ও পরিশ্রমী। খুব সহজেই ইংরেজ সাহেবমেমদের সংস্পর্শে এসে তাদের মন জয় করতে সমর্থ হন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই তিনি নিজেকে আরো যোগ্য করে তোলেন। খুব তাড়াতাড়িই তিনি ইংরেজি এবং ফরাসী ভাষায় কথা বলতে শিখে যান। ফলে বিত্তবানদের সাথে তার মেলামেশা বেড়ে যায়। খুব সহজেই তিনি উচ্চ সমাজের সাথে চলাচলের আদব কায়দা রপ্ত করে ফেলেন।

স্কুল শিক্ষক থেকে প্রধানমন্ত্রী আজিমুল্লাহ খাঁ

তিনি ছোটবেলা থেকেই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। সুতরাং এই বাবুর্চিখানায় কাজ করে তার পোষাবে না ভেবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, বড় হতে গেলে শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। তিনি কানপুরের একটা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে সরকারী চাকুরী নিয়ে চারদিকে ব্যাপক যশ-খ্যাতি লাভ করেন। ফলে খুব সহজেই তৎকালীন জমিদার নানা সাহেবের কানে তার নাম পৌঁছে যায়। একসময় তাদের মধ্যে পরিচয় ঘটলো। দিনেদিনে নানা সাহেবের সাথে তার ঘনিষ্ঠতাও বৃদ্ধি পায়। নানা সাহেবের উপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। তার পরামর্শ ছাড়া নানা সাহেব কোন কিছুই করতেন না। প্রথমে সেক্রেটারি এবং পরে তাকে নানা সাহেব প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

জমিদার নানা সাহেব
জমিদার নানা সাহেব source: Wikipedia.com

আজিমুল্লাহ খাঁ ইংল্যান্ডে

উত্তরাধিকারী সংকটে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানা সাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেন। নানান চেষ্টা করেও যখন কিছুতে কিছু করা গেলনা তখন ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ উচ্চ আদালতে মামলাটা লড়ার জন্য নানা সাহেব আজিমুল্লাহ খাঁকে প্রতিনিধি করে বিলেতে পাঠালেন। লন্ডনে আসতেই আজিমুল্লাহকে নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। মণিমুক্তায় সজ্জিত ভারতীয়কে দেখতে লন্ডন পার্ক ও ব্রাইটে ভিড় জমে গিয়েছিল। তিনি ব্রিটিশ সমাজ সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তার সুন্দর চেহারা, সুমধুর কণ্ঠ ও চিত্তাকর্ষণ আলাপের ভঙ্গিগুণে তিনি আলাদাভাবেই ব্রিটিশ সমাজে স্থান করে নিতে সক্ষম হন। জানা যায় যে, অনেক তরুণীও নাকি তার পিছনে ঘুরঘুর করেছিল। এমনকি তিনি ভারতে ফিরে আসার পরও অনেক তরুণী তাকে প্রেমপত্র লিখত। পরবর্তীতে যখন সিপাহী বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে  আজিমুল্লাহ খাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় তখন এসব প্রেমপত্র উদ্ধার হয়। যাহোক তিনি এসবের মধ্য দিয়েই তার কাজ হাসিল করবার জন্য ছিলেন উন্মুখ। কিন্তু নানান যুক্তিতর্ক, অর্থ ব্যয় ও গোপনীয় তৎপরতা চালিয়েও তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে কাজটি উদ্ধার করতে পারেননি এবং ব্যর্থ হয়েই বিলেত থেকে ভারতে ফিরতে হয়।

কোম্পানি বিদ্বেষী থেকে বিদ্রোহী

কোম্পানি যখন সাফ সাফ জানিয়ে দিল যে, নানা সাহেবকে কোন পেনশন দেয়া হবে তখন আজিমুল্লাহ খান চরম ব্যথিত ও হতাশ হন। এবং ব্রিটিশদের প্রতি চরম মাত্রায় ক্ষুব্ধ হন এবং এ দেশ থেকে তাদের হটিয়ে প্রতিশোধ নেবার চিন্তায় লিপ্ত হন। ঠিক একই সময়ে আজিমুল্লাহর মতো আরেকজন লন্ডনে বসে একই কথা ভাবছিলেন। তিনি হচ্ছেন রঙ্গ বাপুজি। তিনিও বিলেত গিয়েছিলেন সাতারার রাজার পক্ষ থেকে পেনশনের টাকা সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু তিনিও কিছুতে কিছু করতে পারলেন না। পরবর্তীতে এই দুই হতাশের মন থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিশাল প্রতিহিংসা। এই প্রতিহিংসা ছিল ব্রিটিশদের উৎখাতের প্রাথমিক পরিকল্পনা। রঙ্গ বাপুজি সাতারা ফিরে এলেও আজিমুল্লাহ গেলেন অন্য পথে। তিনি নেমে পড়লেন ইংরেজ শক্তির দুর্বলতা খুঁজতে। ইংরেজ শাসনের কোন স্তম্ভে ভাঙ্গন ধরেছে তাই খুঁজতে তিনি নেমে পড়লেন বিশ্ব ভ্রমণে।

কনিস্ট্যান্টিপোলে আজিমুল্লাহ
কনিস্ট্যান্টিপোলে আজিমুল্লাহ source: alamystock.com

কনিস্ট্যান্টিপোলে আজিমুল্লাহ খাঁ

আজিমুল্লাহ খাঁ প্রথমে গেলেন তুরস্কের তৎকালীন রাজধানী কনিস্ট্যান্টিপোলে। দেখা করলেন মুসলিম বিশ্বের খলিফার সাথে। বলাকান অঞ্চলে সেবাস্তপালের যুদ্ধে ইংরেজরা তখন রাশিয়ার হাতে দারুণ মার খাচ্ছিল। আজিমুল্লাহ আর দেরি না করে সরাসরি রাশিয়ায় চলে গেলেন যুদ্ধে ইংরেজদের করুণ দশা দেখবার জন্য। আজিমুল্লাহর মনে ছিল আরেক ভাবনা। তিনি ভাবছিলেন যে এশিয়ার বিষয়ে রাশিয়াকে কি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করা যায় কিনা কিংবা কোন আক্রমণাত্মক বা রক্ষণাত্মক চুক্তি করে ব্রিটিশদের দুর্বল করা যায় কিনা। অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক পর্যন্ত আজিমুল্লাহর এই কূটনৈতিক বিচক্ষণতার কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বাস্তবেও হয়ত তাই হয়েছিল নাহলে কেন ভারতে বিদ্রোহ শুরু হবার সাথে সাথেই সবাই বলাবলি করছিল যে, নানা সাহেব রাশিয়ার সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।

রাশিয়ার কাছে পযর্দুস্ত ব্রিটিশরা
রাশিয়ার কাছে পযর্দুস্ত ব্রিটিশরা source: historty.com

আজিমুল্লাহ রাশিয়ায় থাকাকালে লন্ডন টাইমসের সাংবাদিক মিঃ রাসেলের সাক্ষাৎ পান। তখন রাশিয়ানদের সাথে ইংরেজ ও ফরাসী যৌথ বাহিনীর লড়াই চলছিল। কিন্তু ইংরেজ ফরাসী মিলিত বাহিনী রাশিয়ানদের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়। আজিমুল্লাহ তখন ইংরেজ শিবিরে ফিরে আসেন। এবং সাংবাদিক রাসেলকে নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ ময়দানে যান। আজিমুল্লাহর সাথে ছিল বিদ্রোহের আরেক কাণ্ডারি ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আলী খাঁ। মোটামুটি এক মহা পরিকল্পনা নিয়েই ১৮৫৪ সালে আজিমুল্লাহ ভারতে ফিরে আসেন। আর যার সুপরিকল্পিত বাস্তবায়ন হয় ১৮৫৭। মহম্মদ আলী পরবর্তীতে বলেছিলেন যে, “রুশ এজেন্টদের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য পাবার আশ্বাস পেয়েই আজিমুল্লাহ খাঁ আর আমি ভারতব্যাপী বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলবার সংকল্প করেছিলাম।” এরপর তিনি নাকি মিশরেও যান এবং পাশাপাশি ফরাসী এজেন্টের মাধ্যমে চন্দন নগর থেকেও কিছু সাহায্যের আশ্বাস মেলে।

 ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা source: bd.blogspot.com

নানা সাহেবের প্রতিনিধি হয়ে যে আজিমুল্লাহ বিলেতে গিয়েছিল এবার সেই আজিমুল্লাহ ফিরে এলেন ব্রিটিশ রাজত্ব ধ্বংসের মহা-পরিকল্পনা নিয়ে। নিজের দেশ থেকে বিদেশীদের হাত থেকে মুক্ত করার প্রথম সংগ্রামের দূত হয়েই কাজে নেমে পড়েন। এরপর সব ইতিহাস।

তথ্যসূত্রঃ

১. মহাবিদ্রোহের কাহিনী ;সত্যেন সেন।

২. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Azimullah_Khan

৩. https://www.hudsonhousemysteries.wordpress.com/2012/05/27/azimullah-khan-behind-the-scenes-leader-of-the-1857-rebellion/amp/

৪. https:cbkwgl.wordpress.com/2014/03/04/payam-e-azadi-azimullah-khan/amp/

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More