শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ আমরা তোমাদের ভুলবো না!

4

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শেষের পথে, তখন পাকিস্তানি বাহিনী বুঝে ফেলে– যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই আসন্ন পরাজয়ের জ্বালা মেটানোর জন্য তারা এদেশের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিলো দেশের খ্যাতনামা সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া । এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার মূল হোতা ছিলো মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। তারই তৈরি করা তালিকা  অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদরআলশামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে নিজ নিজ বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁদেরকে বন্দী করে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্মম নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের অনেকের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছে। বহু লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি, আবার অনেকের লাশ খুঁজেই পাওয়া যায় নি। এই ঘৃণ্য, পরিকল্পিত ও নৃশংস গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।

বাংলাপিডিয়া-র তথ্য অনুযায়ী একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলী ছিলেন। এঁদের অনেকের সম্পর্কেই আমরা কমবেশি জানি। তবুও বর্তমান প্রজন্মকে নিজেদের অতীত ইতিহাস ভুলতে না দেয়ার দায়বোধ থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলায়। ১৯৪৮ সালে তিনি পাবনা জেলা স্কুল থেকে মেধাতালিকায় শীর্ষস্থানসহ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আবারো মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেন। ঐবছর-ই তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫৫ সালে শীর্ষস্থানসহ এমবিবিএস পাশ করেন ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। প্রচণ্ড মেধাবী এই মানুষটি ১৯৬০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস (এডিনবরা) থেকে কার্ডিওলজিতে এমআরসিপি ডিগ্রি এবং ১৯৬২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস (লন্ডন) থেকে ইন্টারনাল মেডিসিনে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতো অল্প বয়সে দুইটি বিষয়ে এমআরসিপি ডিগ্রি রয়েল কলেজের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা!

উচ্চশিক্ষা শেষে ইউরোপের উন্নত জীবনযাত্রার হাতছানি দূরে ঠেলে দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এরইমধ্যে মেডিসিনের উপর তাঁর বেশ কিছু গবেষণাপত্র ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এবং ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত হয়। শুধু অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবেই নয়, চিকিৎসক হিসেবেও উপমহাদেশ জুড়ে তাঁর প্রচুর সুখ্যাতি ছিলো! দূর-দূরান্ত থেকে জটিল অসুখে আক্রান্ত অসংখ্য রোগী তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে আসতো। ১৯৭০ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি Pakistan best professor award”-এর জন্যে মনোনীত হন। কিন্তু বাঙালিদের উপর পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদস্বরূপ তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানের এই বিরল সম্মাননা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করলে ঢাকা শহরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ২৭ মার্চ কার্ফিউ স্থগিত হওয়ার পর লোকজন যখন ঢাকা ছেড়ে হন্যে হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তিনি উল্টো ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফিরে আসেন। দেশত্যাগ করে সপরিবারে বিদেশে চলে যাওয়ার অনেক সুযোগ থাকলেও দেশের চরম সঙ্কটকালে দেশপ্রেমিক এই চিকিৎসক ঢাকা ছেড়ে যান নি। যুদ্ধের পুরো ৯ মাস তিনি কখনো টাকাপয়সা দিয়ে, কখনো চিকিৎসা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম সাহায্য করে গেছেন। আর এসব কারণে পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর রোষানলে পড়েন তিনি।

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র একদিন বাকি! বিকাল ৪টায় কাদামাখা একটি সাদা মাইক্রোবাস এবং সেনাবাহিনীর একটি জিপ তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবনের সামনে এসে থামে। রাজাকার-আলবদর এবং পাক আর্মির সম্মিলিত বাহিনী তাঁর বাসাটি ঘিরে ফেলে এবং বন্দুকের নলের মুখে জিম্মি করে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন ভোরে বধ্যভূমিতে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে তাঁকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এর দু’দিন পর ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে শহীদ এই চিকিৎসকের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ১৯৭২ সালে তাঁর নামানুসারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী  সময়ে বাংলাদেশ অনেক খ্যাতনামা চিকিৎসকের জন্ম দিয়েছে এবং এখনো জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু একজন “ডাঃ ফজলে রাব্বি” হারানোর ক্ষতি কখনোই পূরণ হবার নয়। মাত্র ৩৯ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি শুধু পেশাগত সাফল্যের শীর্ষেই আরোহণ করেন নি, সেই সঙ্গে গণমানুষের হৃদয়ও জয় করে নিয়েছিলেন।

“নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।“

 

তথ্যসূত্রঃ

উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক (জীবন কোষ)।।

Leave A Reply
4 Comments
  1. Cvqjev says

    semaglutide 14 mg for sale – buy glucovance without a prescription buy generic desmopressin online

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More