পৃথিবীর সর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত গ্রহের সবচেয়ে বড় এবং রহস্যপূর্ণ এক স্থলভুমির সমাহার আর রহস্যময় সেই স্থানটি হল, এন্টার্কটিকার হিমশীতল বরফের রাজত্ব।
এন্টার্কটিকার বরফের রাজত্ব প্রায় ৫৪ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এবং একারণে এই মহাদেশ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম মহাদেশ। সুমেরুবৃত্তের প্রায় পুরোটা জুড়েই এই মহাদেশের বিস্তার, এর মানে হল প্রায় সারা বছরই এই স্থানের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীর নিচে থাকে। এমন প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে বসবাস করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার, কিন্তু অভিযাত্রী দল এবং বিজ্ঞানীগণ সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে লক্ষ্য করেন যে, দক্ষিণমেরুতে যে সকল প্রাণীর বসবাস, তারা খুব ভালভাবেই এই রূঢ় আবহাওয়ার সাথে খাপ-খাইয়ে নিয়েছে। এন্টার্কটিকার ভূচিত্র আনকোরা চোখে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই জায়গা পৃথিবীর আকর্ষণীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম। আর এই আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. এন্টার্কটিকার শুষ্ক অঞ্চলগুলো পৃথিবীর শুষ্কতম স্থান। এই উপত্যকাগুলোতে বাষ্প ও আর্দ্রতার পরিমাণ এতটাই কম যে, তুষার বা বরফও এই স্থানগুলোকে ধুলোবালির রাজত্ব থেকে মুক্তি দিতে অক্ষম।
২. এন্টার্কটিকা, গড়পড়তায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঝড়ো বায়ুপূর্ণ স্থান। এন্টার্কটিকার দক্ষিণে অনুসন্ধানকারী বিজ্ঞানীদলের রিপোর্ট অনুযায়ী এন্টার্কটিকার বিভিন্ন স্থানের বায়ু প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০০ মাইল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়।
৩. দ্য এন্টার্কটিক আইস শীট বা এন্টার্কটিকের বরফের পাত পৃথিবীর সবথেকে বড় একক বরফের পাত এবং এই পাত ৪ মাইল পর্যন্ত পুরু হয়। এই মহাদেশ পুরো গ্রহের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিষ্কার পানির বরফ ধারণ করে এবং পুরো পৃথিবীর হিসেবে তা প্রায় ৭০ শতাংশ।
৪. বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন যে, যদি এন্টার্কটিক আইস শীট গলে যায়, তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ১৬ ফিট পর্যন্ত উন্নীত হবে।
৫. দ্য রস আইস শেল্ফ- একটি ভাসমান বরফের চাই যা মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের প্রায় ১৯৭,০০০ বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত- এবং এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচাইতে বড় বরফের চাই এই রস আইস শেল্ফ।
৬. এন্টার্কটিকা তার সাদা বরফে আবৃত করে রেখেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পর্বতমালা- গ্যাম্বার্টসেভ, প্রায় ৭৫০ মাইল জুড়ে যার বিস্তৃতি। এই পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা প্রায় ৯,০০০ ফিট, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিমালয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।
৭. এন্টার্কটিকার আরেকটি ভৌগলিক বৈশিষ্ট, যা বরফের পুরু স্তরের নিচে ঢাকা পরে আছে তা হল ভস্টক লেক। ২.৫ মাইল পুরু জমে যাওয়া পানির নিচে অবস্থান করছে স্বচ্ছ পানির এই হ্রদটি। লেক অন্টারিও এর প্রায় সমান আকৃতির হ্রদ এই ভস্টক লেক এবং বরফের নিচে আবিষ্কৃত ২০০ টিরও বেশি জলীয় অংশের মধ্যে অন্যতম।
৮. গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গিরিখাত হলেও বিজ্ঞানীরা এন্টার্কটিকায় এমনই আরেকটি গিরিখাতের সন্ধান পেয়েছে যা আমেরিকার বৃহত্তম এই গিরিখাতের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠতে পারে। নামহীন এই গিরিখাতের সন্ধান মিলে ২০১০ সালের এক অভিযানের সময়। ৬ মাইলেরও বেশি প্রস্থ এবং ১ মাইলের বেশি গভীরতা সম্পন্ন এই গিরিখাতের বিস্তার ৬২ মাইল পর্যন্ত। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন যে, এই গিরিখাতের সত্যিকারের বিস্তার আরও অনেক দূরত্বে হতে পারে, কিন্তু তা আবিষ্কার করতে হলে এন্টার্কটিকায় আরও অনেক অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
৯. পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এরেবাস এন্টার্কটিকায় অবস্থিত- যার অপর পরিচয় একমাত্র “লাভা হ্রদ”, এন্টার্কটিকার এমন হিমশীতল পরিস্থিতির মধ্যেও যে হ্রদ বহুযুগ ধরে গলিত ম্যাগমা ধারন করে আসছে।
১০. এন্টার্কটিকার বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণার জন্যে এই মহাদেশে ৮০ টি গবেষণা কেন্দ্র অবস্থিত যা পরিচালনা করে ৩০ টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের গবেষকবৃন্দ। গ্রীষ্মকালে এই গবেষণাকেন্দ্রে অবস্থান করে প্রায় ৪০০০ জন লোক এবং দীর্ঘ ও রূঢ় শীতকালে লোকসংখ্যা নামে ১০০০ জনে।
১১. ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করা এমিলি মারকো পালমা হল এন্টার্কটিকায় জন্ম নেয়া প্রথম মানব সন্তান। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এন্টার্কটিকায় মাত্র ১০ জন মানব শিশু জন্মগ্রহন করেছে।
১২. পৃথিবী যেহেতু একটু কাত হয়ে আছে, সে কারণে মহাবিষুব থেকে জলবিষুব পর্যন্ত এন্টার্কটিকায় সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না, অর্থাৎ, পুরো শীতকাল জুড়ে এই মহাদেশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে।
১৩. বিপরীতক্রমে, গ্রীষ্মের সময় এন্টার্কটিকায় সূর্য অস্ত যায় না, অর্থাৎ এই সময়ে এন্টার্কটিকা বিষুবরেখাস্থ অঞ্চল সমূহ থেকে বেশি সূর্যের আলো পেয়ে থাকে।
১৪. ২০০০ সালের মার্চ মাসে রস আইস শেল্ফ থেকে ১৭০ মাইল দীর্ঘ এবং ২৫ মাইল প্রস্থের বরফের খণ্ড ভেঙে পরে। খণ্ডটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য কানেক্টিকাটের প্রায় সমান আয়তনের।
১৫. এন্টার্কটিকার ডীপ লেক এতটাই লবণাক্ত যে, তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট এর নিচে থাকা সত্ত্বেও সেই পানি বরফে পরিণত হয় না।