জর্ডানের “ডেড সি” (Dead sea) র নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। যাই হোক নাম আগে শুনে থাকুন বা নাই থাকুন, নামটা নিশ্চয়ই অদ্ভুত ঠেকছে আপনার কাছে। এই নামটাই এমন যে শোনা মাত্রই আমাদের মনে একটা কৌতূহল তৈরি হয়, কেন এর নাম ডেড সি? তাহলে আর দেরি কেন? চলুন জেনে নিই এই ডেড সি নিয়ে কিছু অবাক করা তথ্য!
অনেককাল আগে ফেদেরা নামে এক রাজা ছিল। সমুদ্রের পাশেই ছিল তার রাজ্য। সর্বগ্রাসী সমুদ্রকে সন্তুষ্ট করতেই প্রতি ছয় বছরে উৎসর্গ করা হতো চারজন প্রজাকে। উঁচু পাহাড় থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলা হতো সমুদ্রের পানিতে। এমনি একবছর চারজন প্রজাকে বাছাই করা হল। প্রথম তিনজনকে উৎসর্গ করা হল কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো চতুর্থ-জনের বেলায়। সে এতই মোটা ও ভারি ছিল যে রাজার একার পক্ষে কিছুতেই ঠেলে ফেলা সম্ভব হচ্ছিল না। কিছু সহযোগীকে ডাকা হল। তারা লোকটিকে এত জোড়েই ধাক্কা দিল যে রাজা নিজেই পা ফসকে গেলেন। তিনি পাহাড়ের একটি পাথর আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং প্রচণ্ড ঘামতে লাগলেন। অবশেষে পাথরটি ছুটে গেলে সরাসরি সমুদ্রের পানিতে পড়ে গেলেন। শাস্তি হিসেবে সমুদ্রের দেবতা পসাইডন তাকে পানির নীচে পাঁচ ঘন্টা জীবিত রেখেছিলেন। এরপর থেকেই এই সমুদ্র পরিচিতি পায় ডেড সি বা মৃত সাগর নামে।
এমনি কিছু লোককথা, উপকথা, গল্প ও কৌতুক প্রচলিত রয়েছে জর্ডানের ডেড সি বা মৃত সাগরকে ঘিরে। এর সম্পর্কে আরেকটি প্রচলিত ধারণা হল এর পানিতে মানুষ কখনও ডুবে যায় না আবার কোন প্রাণী বাঁচেও না। কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এই মৃত সাগরে যার কারণে মানুষ ইচ্ছে করলেও ডুবতে পারে না? কেন কোন প্রাণীই বাঁচতে পারে না এই পানিতে? কেনই বা এর নাম দেওয়া হল মৃত সাগর? আমরা ডেড সি বা মৃত সাগরের নাম শুনেছি। কিন্তু এর পেছনের রহস্য কি সবাই জানি? আসুন জেনে নেয়া যাক রহস্যে ঘেরা এই মৃত সাগরের ২৫টি বিস্ময়কর তথ্য।
১। এটিকে মৃত সাগর বা ডেড সি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল এটি আসলে কোন সাগরই নয়। মূলত মৃত সাগর একটি লবণাক্ত পানির হ্রদ।
২। এটি পৃথিবীর গভীরতম লবণাক্ত পানির হ্রদ। এর গভীরতা ১০০৪ ফুট বা ৩০৬ মিটার।
৩। যদি পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রের সাথে তুলনা করে মৃত সাগরের গভীরতা মাপা হয় তাহলেও এর গভীরতা নিছক ফেলে দেওয়ার মত নয়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর সমুদ্রতটের ব্যবধান ১৪০১ ফুট বা ৪২৭ মিটার যা পৃথিবীর সর্বনিম্ন সমুদ্রতট।
৪। এই হাইপার স্যালাইন হ্রদটি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম লবণাক্ত হ্রদ। অনেকেই হয়তো ভাববেন মৃত সাগরই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত পানির হ্রদ। কিন্তু যেখানে কাস্পিয়ান সাগরের উপহ্রদ গ্যারাবোগেযকলের (garabogazkol) লবনাক্ততা ৩৫%, জিবুতির আসাল হ্রদের ৩৪.৮%, এন্টার্কটিকার ভান্ডা হ্রদের ৩৫%, এবং এন্টার্কটিকার ডন জুয়ান হ্রদের লবনাক্ততা ৪৪% সেখানে মৃত সাগরের পানিতে লবণের পরিমাণ শতকরা ৩৩.৭ ভাগ।
৫। যেহেতু মৃত সাগর বা ডেড সি কোন সাগর নয় বরং একটি হ্রদ, এর আয়তনও সাগরের তুলনায় ক্ষুদ্র। এর দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৯ মাইল বা ১৫ কিলোমিটার।
৬। এতক্ষণে এটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে এই হ্রদের লবনাক্ততা অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় ঢের বেশি। এটি অন্যান্য সাগরের তুলনায় ৯.৬ গুণ লবণাক্ত যার মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণ। তাই এই মৃত-সাগরকে সল্ট সিও বলা হয়ে থাকে।
৭। মৃত সাগরে প্রাণের অস্তিত্ব নেই। তীব্র লবণাক্ততাই এর মূল কারণ। অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি এই হ্রদের পানিকে প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। মূলত প্রাণীর অস্তিত্বহীনতার কারণেই এই হ্রদের নামকরণ করা হয় ডেড সি বা মৃত সাগর। যদিও ঘটনাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। বর্ষাকালে পানির পরিমাণ বাড়লে লবনাক্ততা হ্রাস পায়। তখন কিছু ব্যাকটেরিয়ার জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
৮। ডেড সি প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অনুপযোগী এটা যেমন ঠিক তেমনি এটাও ঠিক যে এই ডেড সিই বর্তমানে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম কেন্দ্রস্থল। এখানে পরাগ ও এলার্জি উৎপাদক দ্রব্যের উপস্থিতি খুবই কম। নিম্নাঞ্চল হওয়ায় এখানে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবও কম। তাছাড়া উচ্চ ভূমণ্ডলীয় চাপ, উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, সর্বোপরি বিভিন্ন ধরণের খনিজ পদার্থের বিপুল উপস্থিতি রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যার ফলে মৃত সাগরকে বর্তমানে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
৯। এই হ্রদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি পিচ উৎপাদনের অন্যতম আধার। মৃত সাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে পিচ নির্গত হয় যা মিশরের মমি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। অস্বাভাবিক রকমের পিচ উৎপাদন ক্ষমতার জন্য গ্রীকরা এর নাম দিয়েছিল লেক অফ এসফালটাইটস (asphaltites) বা পিচের হ্রদ।
১০। এর পানি কখনও হ্রদের বাইরে প্রবাহিত হয় না। এর তিনদিকেই ঘেরাও করা। একটি মাত্র পথ খোলা আছে যেখান দিয়ে অন্যান্য নদী বা ঝরনা থেকে পানি প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না।
১১। খাবারের লবণের তুলনায় মৃত সাগরের লবণের স্বাদ খুবই তিক্ত যা চর্মরোগ নিরাময়ে খুবই কার্যকরী। সোরিয়াসিস, সেলুলাইট, ব্রণ, ফুস্কুড়ি, খুশকি দূর করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শরীরের ব্যথা ও মানসিক চাপ কমাতেও এই লবণের জুড়ি নেই।
১২। প্রকৃতি নিজেই একটি বিস্ময়। তাইতো মৃত সাগর একটি বিস্ময় হয়েও অবস্থান করছে আরেকটি বিস্ময়কর সৃষ্টি “গ্রেট রিফট ভ্যালি” এর মাঝে। এই হ্রদটি হচ্ছে গ্রেট রিফট ভ্যালির সবচেয়ে গভীরতম স্থান। দীর্ঘতম উপত্যকা হিসেবে গ্রেট রিফট ভ্যালির বেশ সুপরিচিতি রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪০০০ মাইল যা ২০টি দেশের উপর দিয়ে চলে গেছে।
১৩। এই হ্রদটিই হচ্ছে পটাশিয়ামের প্রাথমিক উৎস যা সারা পৃথিবীর কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
১৪। মৃত সাগর অঞ্চলের ৬১৮ একর জমি জুড়েই রয়েছে খেজুর গাছের সমাবেশ।
১৫। স্থানীয় জনপদের সিংহভাগই নির্ভর করে কৃষিকাজের উপর। শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ অর্থই আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে।
১৬। বছর জুড়েই বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এই হ্রদ। তার মধ্যে অ্যারাবিয়ান ব্যাবলার পাখিটি অন্যতম।
১৭। মৃত সাগরে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫০ মিলিলিটারেরও কম। স্বল্প বৃষ্টিপাত ও তপ্ত আবহাওয়ার কারণে এর জলবায়ু সারাবছরই শুষ্ক থাকে।
১৮। মৃত সাগর হচ্ছে একটি প্রাগৈতিহাসিক হ্রদ। ২ থেকে ৩.৭ মিলিয়ন বছর পূর্বেই এর ইতিহাসের সূচনা হয়।
১৯। রাণী ক্লিওপেট্রা, যিনি সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি নিজেও রূপচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে মৃত সাগরকেই বেছে নিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে মৃত সাগরের তীরেই প্রসাধনী কারখানা গড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
২০। বিভিন্ন ধর্মে মৃত সাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাইবেলে বলা আছে মৃত সাগর একদিন জীবিত হবে। লবনাক্ততা কমে স্বাদু পানিতে পরিণত হবে এবং প্রাণের সঞ্চার ঘটবে।
২১। এরিস্টটলের বিভিন্ন রচনায় ডেড সি বা মৃত সাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
২২। বাইবেলে বলা হয়েছে, রাজা ডেভিড মৃত সাগরের তীরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২৩। এখানকার খনিজ ও লবণ সুগন্ধি ও প্রসাধনী তৈরীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২৪। অনেক বছর আগে ডেড সি বা মৃত সাগর পরিচিত ছিল “স্টিংকি সি” নামে।
২৫। আমরা জানি মৃত সাগরে কেউ ডুবে না। আমরা এও জানি মৃত সাগরে লবণের পরিমাণ বেশি। যার কারণে এর ঘনত্বও বেশি। এর ঘনত্ব ১.২৪ লিটার। লবণে রয়েছে ১৪% ক্যালসিয়াম, ৪% পটাশিয়াম, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম যা পানির প্লাবতা বৃদ্ধি করে। এই প্লাবতার কারণেই মৃত সাগরে মানুষ বা অন্য কিছু ডুবে যায় না।
প্রকৃতির অনন্য বিস্ময়কর সৃষ্টি এই মৃত সাগরের অবস্থান জর্ডানে। এর পশ্চিমে রয়েছে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন এবং পূর্বে জর্ডান। প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।