নেহেরুর সম্মুখনীতি, দালাই লামার ভারতে আশ্রয়লাভ, আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক ভারতীয় কূটনৈতিক তৎপরতা প্রভৃতি চৈনিকদের নিশ্চিত করে যে, ভারত সুপরিকল্পিতভাবে তিব্বতকে নিজের আয়ত্তে আনার প্রয়াস চালাচ্ছে। দুশ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের হাতে নিষ্পেশিত ভারতীয়দের প্রতি প্রাথমিকভাবে সহানুভূতিশীল চৈনিক নেতৃত্ব, তাদের মতে, নব্য-সাম্রাজ্যবাদী ভারত সরকারকে শাস্তি দিতে ও তাদের আগ্রাসনের সমাপ্তি ঘটাতে বদ্ধপরিকর হয়। আগ্রাসী মনোভাবের জন্যে নিন্দিত চীনের সে সময়ের সর্বময় নেতা মাও জেডং-এর ভাষ্যমতে – “ক্রমাগত আগ্রাসনের অভিযুক্ত হবার থেকে বিশ্বকে চীনের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়াই শ্রেয়।“ চৈনিক নেতৃত্ব যুদ্ধের কয়েকটি লক্ষ্য স্থির করে:
- চীনের দাবিকৃত অঞ্চল হতে ভারতীয়দের সমূলে উৎপাটন।
- তিব্বতের উপর চিরস্থয়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
- চীনের বিপক্ষে সম্ভাব্য সোভিয়েত-ভারত-মার্কিন জোটকে প্রতিহত করা।
- বিশ্বকে চীনের ক্ষমতা ও সংকল্প সম্পর্কে জানান দেওয়া।
লক্ষ্য অর্জনে চৈনিক নীতিনির্ধারকরা পরিকল্পনা করেন একই সাথে ইস্টার্ন থিয়েটার বা পূর্বে ম্যাকমাহন লাইন বরাবর এবং ওয়েস্টার্ন থিয়েটার বা পচ্শিমে আকসাই চিনে আক্রমণ করে সকল ভারতীয় সেনাদের চীনের দাবিকৃত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে এবং একতরফা যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে ভারতকে আলোচনায় বাধ্য করতে। মাও জেডং-এর মতে- দীর্ঘমেয়াদী শান্তির জন্য কঠোর পদক্ষেপ ছিল অপরিহার্য, যদিও এই পরিকল্পনায় চীন ছিল আগ্রাসক।
অপরদিকে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভকারী এবং বিশ্ব দরবারে সমাদৃত, নিজেদের শক্তি ও চৈনিকদের দুর্বলতা নিয়ে মোহাচ্ছন্ন ভারত সম্মুখ সমরের জন্য নগণ্য প্রস্তুতি নেয়। পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে তাদের ধারণা ছিল যে, অগ্রসরমান চৈনিক সৈন্যদের দিকে কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুঁড়লেই তারা পচ্শাৎপসরণ করবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৬২ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর আদেশে ভারতীয় সেনারা ম্যাকমাহন লাইনের উত্তরে ঢোলা নামক স্থানে অবস্থান নেয় যা ছিল চীনের অধিভুক্ত অঞ্চল। ভারতের এরূপ বেপরোয়া আচরণের উদ্দেশ্য ছিল চীনের সংকল্প ও অভিসন্ধি সম্পর্কে ধারণা লাভ এবং প্রয়োজনে সীমান্তে চৈনিক সেনাদের সরবরাহ ব্যাবস্থা বিঘ্নিত করা। হিমালয়ের প্রতিকূল আবহাওয়ায় দুই দেশ যেন এক ভয়ংকর দাবার আসরে মেতে ওঠে যা ১০ই অক্টোবর চীন ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়। এই সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই বেশকিছু সংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং ভারতীয়রা বাধ্য হয় পিছু হটতে। ভারত সরকার অনেক দেরিতে হলেও বুঝতে পারে যে সীমান্তে তাদের এই পদক্ষেপ ছিল চরম ভুল। নেহেরু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন, কিন্তু ১৮ই অক্টোবর নাগাদ সীমান্তে চীনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে চীন অতি শীঘ্রই এক অপ্রস্তুত ভারতকে আক্রমণ করবে।
১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর চীনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) যুগপৎ ইস্টার্ন থিয়েটারে নামকা চু নদীর তীরএ এবং ১০০০ কি:মি: দূরে ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে আকসাই চিনের চিপ চ্যাপ ভ্যালীতে আক্রমণ করে, উদ্দেশ্য নামকা চু নদীর উভয় তীর দখল এবং চিপ চ্যাপ ভ্যালী হতে ভারতীয় সৈন্যদের উৎখাত করা।
২০শে অক্টোবর মধ্যরাতে তিন রেজিমেন্ট চৈনিক সৈন্য নামকা চু নদীর উত্তর তীরে অবস্থান নেয়। দক্ষিণ তীরে অবস্থানকারী সংখ্যা ও শক্তি উভয়ের নিরিখে তুচ্ছ এক ব্যাটেলয়ান ভারতীয় সৈন্যের ধারণা ছিল আক্রমণকারীরা দু-তীর সংযোগকারী পাঁচটি সেতুর যেকোন একটি ব্যবহার করে পার হবে। কিন্তু চৈনিকরা রাতের আধারে ভারতীয় সৈন্যদের অগোচরে নদী পার হয়ে ঠিক তাদের পিছনে অবস্থান নেয় এবং সব ধরনের যোগাযোগের মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেদিন ভোরে উত্তর থেকে চালানো মর্টার হামলায় বিধ্বস্ত ভারতীয় সেনাদের উপর চৈনিক পদাতিক বাহিনী পিছন থেকে আচমকা আক্রমণ করে। হতভম্ব ভারতীরা আর কোন উপায় না দেখে নামকা চুর তীর ত্যাগ করে ভুটানে পলায়ন করে। নামকা চু দখলের পর চৈনিকরা নেফার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। ২২শে অক্টোবর ম্যাকমাহন লাইনের উপর ওয়ালং-এ ভারতীয়রা আক্রান্ত হয়। ভারতীয়দের নিঁখুত মর্টার হামলার কারণে প্রাথমিক ভাবে চৈনিকরা কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও একের পর এক আক্রমণের মাধ্যমে তারা ভারতীয়দের পিছু হটতে বাধ্য করে। ২৩শে অক্টোবর একটি সংকীর্ণ স্থানে বেশ কিছু সংখ্যক চৈনিক সৈন্য একত্রিত হলে ভারতীয়রা তাদের উপর মর্টার ও মেশিন গান সহযোগে আক্রমণ চালায়, সেদিন সন্ধ্যায় চৈনিক সৈন্যদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করার আগ পর্যন্ত ভয়াবহ সংঘর্ষ চলতে থাকে। ভারতীয়রা কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ত্যাগ করলে অরুণাচল প্রদেশের অন্তর্গত তাওয়াঙ সাময়িকভাবে চৈনিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
অপরদিকে ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে বিতর্কিত অঞ্চলের অধিকাংশই ইতোমধ্যে চৈনিক নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। তারা ১৯ শে অক্টোবর রাতেই পুরো ওয়েস্টার্ন থিয়েটার জুড়ে অবশিষ্ট ভারতীয়দের বিতাড়নের লক্ষ্যে সামরিক অভিযান শুরু করে। ২০শে অক্টোবরের মধ্যেই জনসন লইনের পূর্বে চীনের দাবিকৃত ভারতীয় নিয়ন্ত্রণাধীন সকল পোস্ট যথা: চিপ চ্যাপ ভ্যালী, গালওয়ান ভ্যালী, প্যাংমং লেক প্রভৃতি চৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এসকল পোস্টে ভারতীয় সেনারা যথাসাধ্য প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও, ভারতীয় কতৃপক্ষের সহায়তার অভাবে অধিকাংশ সৈন্য নিহত বা ধৃত হয়। ২৪শে অক্টোবর, নিকটস্থ একটি বিমানপোত রক্ষার্থে রেজাং লা নামক শৈলশিরায় ভারতীয়রা আপ্রাণ লড়াই করে। কিন্তু সুপরিকল্পিত ও সুসজ্জিত চৈনিক আক্রমণের সামনে অপ্রস্তুত ভারতীয়দের পক্ষে পশচাৎপসরণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না এবং অতিশীঘ্রই তারা সংগঠিত হতে সকল বিচ্ছিন্ন সম্মুখ পোস্ট ত্যাগ করে। ফলে সমগ্র ওয়েস্টার্ন থিয়েটার অনায়াসেই চৈনিকদের আয়ত্তে চলে আসে।
২৪শে অক্টোবর নাগাদ চৈনিক সেনাবাহিনী বিতর্কিত অঞ্চলের অধিকাংশ নিজেদের দখলে এনে সংঘাতপূর্ব নিয়ন্ত্রণরেখার প্রায় ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রবেশ করে। অপরদিকে ভারতীয় সেনারা সংঘবদ্ধ হয়ে সুরক্ষিত স্থানে অবস্থান নেয়, যা আক্রমণ করা ছিল চৈনিকদের পক্ষে বিপজ্জনক। চৈনিক প্রধানমন্ত্রী ঝোউ এনলাই তার সেনাবাহিনীকে আর অগ্রসর হতে নিষেধ করেন এবং আকসাই চিনে বর্তমান নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে নেবার ও উভয়পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহারের শর্তে, নেহেরুকে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে আলোচনায় বসার আহবান জানান। ঝোউ নেফায় ম্যাকমাহন লাইন ও তিব্বতে ম্যাকডোনাল্ড লাইন, যা আকসাই চিনকে চীনের অন্তর্গত করে, মেনে নেবার প্রস্তাব করেন। প্রাথমিকভাবে নেহেরু শান্তি পুনরুদ্ধারে আন্তরিক হলেও, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে ভারতীয় জাতীয় সংসদ ‘বহিরাগত শত্রুদের ভারতের পবিত্র ভূমি হতে বিতাড়নের’ অঙ্গীকার করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। ভারতের এহেন পদক্ষেপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সমর্থন জানালে ১৪ই নভেম্বর নেহেরু ঝোউ-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং এরই সাথে অবসান ঘটে চার দিনের তীব্র যুদ্ধের পর তিন সপ্তাহব্যাপি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির।
এরপর ছিল ভারতীয়দের পালটা জবাবের পালা। ১৪ই নভেম্বরই ভারতীয় সেনারা ইস্টার্ন থিয়েটারে ওয়ালং-এ অবস্থানকারী চৈনিকদের উপর সে লা নামক সুউচ্চ সুবিধাজনক স্থান হতে আকস্মিক আক্রমণ করে এবং চৈনিকরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। উচ্চতার কারণে সে লা আক্রমণ করা ছিল নির্বুদ্ধিতা, তাই চৈনিকরা ১৭ই নভেম্বরই সে লা-র কাছাকাছি থেমবাং নামক স্থান দখল করে ভারতীয়দের সরবরাহ ব্যাবস্থা বিনষ্ট করে দেয়। পিএলএ ভারতের অভ্যন্তরে আসামের তেজপুর পর্যন্ত ঢুকে পরলে, ভারতীয় মুদ্রা রিসার্ভ ধবংস করে সেখান থেকে সাধারণ জনগণকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৮ই নভেম্বর ভোরে, ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে বিশেষ করে চুষুলে অবস্থানকারী ভারতীয়দের উপর পিএলএ ভয়াবহ আক্রমণ করে। ঘন কুয়াশা এবং বিচ্ছিন্ন যোগাযোগের কারণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক ভারতীয় অবস্থান চৈনিকদের দখলে চলে যেতে থাকে। আক্রমণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চীন তার দাবীকৃত সীমানা পর্যন্ত জয় করতে সক্ষম হয়। পুনরায় ভারতীয়রা অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে পিছু হটে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।
১৯শে নভেম্বর, উভয়পক্ষে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতির পর চীন উপলব্ধি করে তাদের সকল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তারা একক ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং আকসাই চিন ব্যতিত ভারত হতে বিজিত সকল স্থান হতে সৈন্য প্রত্যাহার করে। এখানে উল্লেখ্য ভারতের সাহায্যার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিমানবাহী রণতরী প্রেরণ করে যা যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। চীন যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সুকৌশলে আমেরিকার জড়িত হওয়া রোধ করে।
প্রায় এক মাসব্যপি চলা যুদ্ধে দুদেশের কেউ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেনি। তাছাড়া কোন পক্ষের দ্বারাই বিমানবাহিনী বা নৌবাহিনী ব্যবহৃত হয়নি। এ যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হিমালয়ের উচ্চতায় লড়াই-এর জন্য।
১৯৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতীয়দের প্রায় তিন হাজার সৈন্য নিহত হয়, প্রায় দেড় হাজার সৈন্য ধৃত ও চার হাজার সৈন্য নিখোঁজ হয়। তাছাড়া ভূরাজনৈতিক নেতিবাচক প্রভাবের নিরিখে ভারত এ যুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে পরাজিত হয়।