বাঙালি মুসলিমকে নিয়ে আমরা সবাইই কমবেশি কথা বলেই থাকি। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলেবুড়ো সব বয়সের মানুষই বাঙালি মুসলিমের পক্ষে অথবা বিপক্ষে বিতর্কে শামিল হন। কখনও নিরেট যুক্তির খাতিরে তথ্য উপস্থাপন, আবারও কখনও উত্তপ্ত বিতর্ক। বাঙালি মুসলিমের এই আইডেনটিটি ক্রাইসিস যেন শেষ হওয়ার নয়।
ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই দুই বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত গবেষণা প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ লিখি। সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্য আমি একমাত্র বাংলাদেশি সাংবাদিক হিসেবে তৃতীয় স্থান অধিকার করি। বাঙালি মুসলমানের আইডেনটিটি ক্রাইসিস নিয়ে লেখা ওই প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের ভাগ করো ও শাসন করো নীতি, বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, লাহোর প্রস্তাব ও সাম্প্রতিক সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঠাঁই পেয়েছে। আর এখন আবার লিখতে বসেছি- আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থের পর্যালোচনা বা রিভিউ।
প্রকৃত অর্থে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ হলো নামপ্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক আহমদ ছফার লেখা এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রথম প্রকাশ ১৯৮১ সালে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই এই লেখকের লেখা বইগুলোকে অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচনা করে থাকেন। পাঠক হিসেবে আহমদ ছফার বইগুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিকতার বাইবেল হিসেবেও আমরা অভিহিত করতে পারি। কেননা আহমদ ছফা এমন অনেক ঘটনা গল্পাকারে তুলে ধরেছেন, যা অন্তত দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূর্ত রূপ ধারণ করেছে। কাজেই প্রাবন্ধিক হিসেবে আহমদ ছফাকে হেলাফেলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
যদিও তার লেখায় তত্ত্বের কচকচানি থাকার কারণে অনেক কচি পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু বুদ্ধিমান পাঠকরা তার বইগুলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাইবেল হিসেবে মনে করে থাকেন। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’আহমদ ছফারই অন্যতম সুবিখ্যাত গ্রন্থ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তপ্ত কথাবার্তার সময় হরহামেশাই আহমদ ছফাকে রেফারেন্স হিসেবে টানা হয়ে থাকে। তবে তরুণ পাঠকদের আহমদ ছফার বই পড়ার দিকে টানার শটকার্ট একটা রাস্তা অবশ্য আছে। আর সেই রাস্তা বলে দিয়েছেন লেখক কে এম রাকিব। প্রথম আলোর অন্যতম ক্রোড়পত্র অন্যআলোতে এ-সংক্রান্ত একটি নিবন্ধে তিনি লেখেন, ‘আহমদ ছফার ব্যাপারে তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আহমদ ছফার রচনাবলি নিষিদ্ধ করা। নিষিদ্ধ হলে আমার ধারণা, তরুণেরা হুমড়ি খেয়ে ছফা পাঠ করবে। তরুণরা যাতে আহমদ ছফার প্রতি আরও মনোনিবেশ করেন, সেজন্য অন্য আলোতে নিজের ওই লেখায় কিঞ্চিৎ ব্যাঙ্গ করে কথাটা তুলে ধরেছেন (আহমদ ছফা কেন পড়বেন?, ২৮ জুলাই ২০২১)।’
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের হেদায়েত আলী ও আছিয়া খাতুনের পরিবারে তার জন্ম। প্রাবন্ধিক হিসেবে সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে পরিচিত হলেও গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী ও অনুবাদেও বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন আহমদ ছফা। কীর্তিমান ও প্রথিতযশা এই লেখক সাংবাদিকতাও করেছেন। দৈনিক গণকণ্ঠের উপদেষ্টা এবং সাপ্তাহিক উত্তরণ ও উত্থানপর্বের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুধু সাহিত্যেই তার অবাধ বিচরণ থেমে থাকেনি, জ্ঞানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও ঘুরে বেড়িয়েছেন এই লেখক। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থের শেষ ব্লার্বে তাকে ‘সব্যসাচী বিরলপ্রজ লেখক’ অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। ‘গাভী বিত্তান্ত’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘অলাতচক্র’, ‘ওঙ্কার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘ফাউস্ট’ প্রভৃতি গ্রন্থ লেখেন তিনি। একুশে পদকসহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন খ্যাতিমান এই প্রাবন্ধিক। আহমদ ছফা প্রয়াত হন ২০০১ সালের ২৮ জুলাই।
‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান মানস চিত্রিত করেছেন। কীভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জন্য ঘোষিত নাস্তিকও আস্তিকে রূপান্তর হয়ে যান, সেই বর্ণনাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আহমদ ছফার লেখার সঙ্গে বাংলাদেশের বিগত শাসনামলের রাজনীতির বাস্তব একটি উদাহরণ হলো হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের হজ করার প্রসঙ্গ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই দুজনের ছবি যখন ভাইরাল হলো, তখন সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন দুজনেই ভিন্ন দুটি দলের নেতা। ইনু জাসদের আর মেনন ওয়ার্কার্স পার্টির। দুটো সমাজতন্ত্র শিবিরের। আর সমাজতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস ‘ঈশ্বরে অবিশ্বাসী’ হওয়ার কারণে তার ভাবাদর্শ ‘শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বেও’ সেই প্রভাব দেখা যায়। যদিও কার্ল মার্কসের জন্ম একটি ইহুদি পরিবারে। মার্কসের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবহের জের ধরে অনেক বাঙালি মুসলিমের মধ্যে যেহেতু সমাজতন্ত্রকে ‘ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বস্তুবাদী দর্শন’ বলে চিত্রিতের প্রবণতা রয়েছে, সেহেতু এদেশের সমাজতান্ত্রিক নেতাদেরকেও সেভাবেই চিত্রিত করা হয়। সে অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের হজ করার খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থে বাঙালি মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ও অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনা করেছেন আহমদ ছফা। প্রবন্ধটিতে লেখক দো-ভাষী পুঁথিগুলোর কথা তুলে ধরে লেখেন, দো-ভাষী পুঁথিগুলোতে দেখা যায় ভিনধর্মের একটি পরিবার রাতারাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলছেন। ইসলামের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে তারা এহেন কাজ করছেন। আমির হামজার গল্প তুলে ধরার পর ব্যাঙ্গ করে আহমদ ছফা লেখেন, ‘হিন্দু-সমাজের বীরেরা যদি পাতাল বিজয় করে বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারেন, আমির হামজা দৈত্যের দেশে গমন করে তাদের শায়েস্তা করে আসতে পারবেন না কেন? ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে মুহম্মদ হানিফার মূল কাণ্ড কিছু নেই বলেই তো সুবিধে। কল্পনা যেভাবে ইচ্ছে বিচরণ করতে পেরেছে। হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ যদি বৃন্দাবন ষোলশত গোপবালা নিয়ে লীলা করতে পারেন, মুহম্মদ হানিফার কি এতই দুর্বল হওয়া উচিত যে এ কয়টা ব্রাহ্মণকন্যাকে সামলাতে পারবেন না! (পৃষ্ঠা: ২৪-২৫)।’
আহমদ ছফার লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি নিয়ে বলতে গিয়ে প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র অন্য আলোতে বলা হয়েছে, ‘কিছুদিন পরপরই বাঙালি, বাংলাদেশি, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে চক্রাকারে যে বিতর্ক ঘনিয়ে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেই বিতর্কের প্রথম লেখা আহমদ ছফার ‘বাঙালির মুসলমানের মন’। লেখাটির সঙ্গে আপনি দ্বিমত হতে পারেন, বেশ কিছু পদ্ধতিগত ভুলও প্রমাণ করতে পারবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক মন বুঝতে ছফার দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবিলা না করে পারবেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার চেহারা-সুরত বোঝার জন্য ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর মতো বই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভয়াবহ সংকীর্ণ ও একমাত্রিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ছফা এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেগুলো প্রচলিত বস্তাপচা চিন্তাকাঠামোকে অস্বস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটা শক্তিশালী প্রবণতার ধারক ও বাহক ছফা (আহমদ ছফা কেন পড়বেন?, ২৮ জুলাই ২০২১)।’ এ ছাড়া ডেইলি স্টারে বাংলা ভাষায় লেখা এক প্রবন্ধে আহমদ ছফাকে ‘নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবীদের একজন বলে অভিহিত করেন লেখক আহমাদ ইশতিয়াক (আহমদ ছফা: জীবন ও সাহিত্যের বাস্তবতায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা, ৩০ জুন ২০২২)।
ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ইংরেজি প্রবন্ধে জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের উদ্ধৃতি দিয়ে গল্পকথক হিসেবে লেখক আহমদ ছফার মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন তারই শিষ্য সলিমুল্লাহ খান। লেখক সলিমুল্লাহ খান লেখেন, ‘the figure in which the righteous man encounters himself’ (দ্য অরিজিন অব দ্য ওম: আহমেদ ছফা’স অরা, ২৮ জুলাই ২০২২)।
পাঠক হিসেবে প্রশ্ন উঠতেই পারে আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো কোনটি? আমি মনে করি ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তার মধ্যে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র’, ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’, ‘ব্রাটান্ড রাসেল’, ‘শিক্ষার দর্শন’, ‘ভবিষ্যতের ভাবনা’, ‘বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শ’ বাহাত্তর’, ‘দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক’-সহ আরও অনেক। এসব প্রবন্ধে মুক্তচিন্তা ও বৃদ্ধিবৃত্তিকতা উপজীব্য হয়ে উঠেছে। বাঙালি মুসলমানের জন্য (যারা ইসলাম প্র্যাকটিস করেন এবং তা নাও করেন- সবার জন্য) বইটি চিন্তার খোরাক। বিশেষ করে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শিরোনামে নামপ্রবন্ধটি এই প্রজন্মের সেইসব মুসলিম তরুণদের অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচনা করি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা অনর্থক বিতর্ক করে সময় ও পরিবেশ নষ্ট করছেন। ভিন্ন মত বা ধর্মাবলম্বীদের কটাক্ষ করে যারা উত্তপ্ত কথাবার্তা নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে থাকেন, তাদের জন্য আহমদ ছফার লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি পড়া উচিত। হিংসায় লিপ্ত একটি সমাজে সাম্প্রদায়িক চর্চা ও মেরুকরণ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, গ্রন্থটি পাঠেই সেটা উপলব্ধ হয়।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.