বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনা
সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী পদ এবং দেশ দুটোই ছাড়তে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গতকাল সোমবার হেলিকপ্টার যোগে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা (৭৬)। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও।
এদিকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর পরই অসংখ্যা মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়েন। এ সময় আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে লুটপাটও।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সরকারপ্রধানের নাম শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেন বিশ্বে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান এই নারী শাসক। ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা দেশ শাসন করেছেন তিনি। মাঝখানে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম, ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ ও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেন তিনি। এর আগে ১৯৯৬ সালেও ১ মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা।
দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রিত্ব করা শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯-২০২৪) সব মিলিয়ে ২১ বছর ধরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা শাসন করেছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার মতো এমন প্রধানমন্ত্রীর এমন পতন ও দেশ ছাড়ার ঘটনা বিস্ময়করও বটে। অনেক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেনের পর অভ্যুত্থানের মুখে প্রথম কোনো শাসক মসনদ ছেড়ে এভাবে পালিয়ে গেলেন।
তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে লড়াকু গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবে পরিচিতিও পেয়েছিলেন তিনি। সমালোচকরা মনে করেন, ক্ষমতার শেষদিকে শেখ হাসিনা ক্রমান্বয়ে একগুঁয়ে ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে ভিন্নমতের কাউকেই তিনি গ্রাহ্য করতেন না। এমনকি দলের নেতাকর্মীদেরও। একের পর এক রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসবই ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা শুধু চারজনকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করতেন। তারা হলেন- সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সজীব ওয়াজেদ জয়। এই চারজন মিলে গণভবনে একটি বলয় গড়ে তুলেছিলেন যাকে বলা যেতে পারে ‘গ্যাং অব ফোর’ বা চারজনের সংঘ। এ ছাড়া ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, দলের নেতাকর্মীদেরকেও ভরসা করতেন না। প্রকৃত অর্থে শেখ হাসিনা নিজের রাজনৈতিক সত্ত্বাটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন।
চলতি বছর জানুয়ারিতে নজিরবিহীন এক নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের পরও এই নির্বাচন করে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন।
যেভাবে ক্ষমতায় আসেন
পৈর্তৃক সূত্রে বাংলাদেশে রাজনীতির উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ই একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হারান তিনি। বিদেশে থাকায় দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান।
ক্ষমতার পালাবদল ও টানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে। ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছিল দলটি।
আশির দশকে তখন জেনারেল এরশাদের শাসন চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাতে হাত ধরে গণঅভ্যুত্থানে নামেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করেন। এর ফলে দ্রুতই গণতন্ত্রকামী জাতীয় প্রতীকে পরিণত হন তিনি।
কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। অপেক্ষা করতে হয় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। অবশেষে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। দুই দশকের বেশি সময় পর তার হাত ধরেই ক্ষমতায় ফেরে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগ।
প্রথম মেয়াদে অন্তত দুটি কারণে প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা-
১. ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি;
২. পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা দূর করতে শান্তি চুক্তি করা।
তবে একই সময়ে বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক চুক্তি সই ও খুবই ভারতপন্থী মনোভাবের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০১ সালে বিএনপির কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ।
২০০৯ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হয়েছিল।
শেখ হাসিনা একজন পরীক্ষিত রাজনীতিক। বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। হামলার শিকার হয়েছেন কয়েকবার। ২০০৪ সালে ঢাকায় তাকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। প্রাণে বাঁচলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার কান। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর জন্য আইনি লড়াইও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে।
শেখ হাসিনার অর্জন ও সাফল্য
একসময় বাংলাদেশ খুবই দরিদ্র একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে ধীরে ধীরে সেই পরিচয় ঝেড়ে ফেলতে শুরু করে বাংলাদেশ। বিশেষত ২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নজর কাড়ে সবার।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। গত এক দশকে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত দুই দশকে আড়াই কোটির বেশি বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনার আমলের অর্থনৈতিক অর্জনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশের ক্রমবিকাশমান পোশাকশিল্প। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
সেই সঙ্গে দেশজুড়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। নিজস্ব অর্থায়ন, ঋণ ও উন্নয়ন সহায়তার অর্থে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু।
হাসিনাকে নিয়ে বিতর্কের কারণ
ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম এত গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
আন্দোলন দমনে কঠোর পথ বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আন্দোলনকারীদের সরাসরি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। নিহত হন কয়েক শ’ মানুষ। এরপর হাজার হাজার মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়, করোনা-পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যাপক ধস নেমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০১৬ সালের পর বিদেশি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।
সমালোচকরা বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে চারপাশ থেকে এমন ভরাডুবি। এ ছাড়া কয়েক দশকের অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের জেরে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্য চুকিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন শেখ হাসিনা, এমনটাই মত বিশ্লেষক ও সমালোচকদের অনেকের।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়নের অভিযোগ বেশ পুরোনো। অথচ এই শেখ হাসিনা একসময় বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করে এসেছেন।
অধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে (২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে) বাংলাদেশে অন্তত ৬০০ গুমের ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।
শেখ হাসিনার আমলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর একের পর এক আটক, নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
আটক, নজরদারি, হয়রানির শিকার হন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকরাও। গণমাধ্যমকে চেপে ধরতে শেখ হাসিনার সরকার কঠোরতর আইন করে।
পতনের নেপথ্যে
নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’- শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল বড় একটি অভিযোগ। চলতি বছরের শুরুতে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হয়। তবে সমালোচকরা মনে করেন, এই নোবেলজয়ী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
চলতি বছর নির্বাচনের আগে বিএনপির বহু জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটক করা হয়। আটক হন দলটির হাজারো নেতাকর্মী। এসব কর্মকাণ্ডকে শেখ হাসিনার ভিন্ন মত দমনের কৌশল হিসেবে ধরা হয়।
তবে এসব অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে এসেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে কখনোই অনুমতি দেওয়া হয়নি।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.