বারাঙ্গনারাও যে বাংলা থিয়েটার জগতকে আলোড়িত করতে পারেন, সেটাই দেখিয়ে দিয়েছেন আলোচিত অভিনেত্রী বিনোদিনী। গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাতে গড়া রত্ন এই নটী বিনোদিনী।
সেকালে বাঙালি নারীরা মঞ্চে উঠে অভিনয় করবেন- এমনটা ভাবা ছিল দুঃসাধ্য। নাটকের প্রয়োজনেই তখন বারাঙ্গনাদের নটী হিসেবে মঞ্চে ডাক পড়তো। তেমনই একজন নটী ছিলেন বিনোদিনী দাসী। ১৮৬৩ সালে ১৫৪ নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় ছোট্ট এই মেয়ের। ছেলেবেলায় সেই মেয়েকে সবাই আদর করে ডাকতো ‘পুঁটি’ বলে। মা-দিদিমার সঙ্গে বেড়ে ওঠা।
কর্কশ জীবনের গতিপথ চেনার আগেই দিদিমা তাকে তারই একজন খেলার সাথীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। পুঁটির স্বামীকে নিয়ে গেল বাড়ির লোকজন। এরপর ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলে ভীষণ একা হয়ে পড়েন নটী বিনোদিনী।
মাত্র ১২ বছর বয়সে নটী বিনোদিনীর অভিনয় জীবন শুরু। মাসিক ১০ টাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘শত্রুসংহার’ নাটকে প্রথম অভিনয়। এই নাটকে মহাভারতের দ্রৌপদীর এক সখীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘শত্রুসংহার’ নাটকের পার্ট করতে করতেই ডাক পেলেন ‘হেমলতা’ নাটকের মহড়ার জন্য। এই নাটকে অবশ্য পার্শ্ব-অভিনেত্রী নন, সরাসরি নায়িকার চরিত্রে প্রমোশন পেলেন নটী বিনোদিনী। স্বস্তিকা (জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৯) সংখ্যায় ‘বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে নটী বিনোদিনী’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বিকাশ ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘…সময়টা ১৮৭৪-এর ২ অথবা ১২ ডিসেম্বর। এখন যেখানে মিনার্ভা- সেখানেই ছিল এই গ্রেট ন্যাশনাল। স্বত্বাধিকারী: ভুবনমোহন নিয়োগী। সখীর পার্ট করতে করতেই পরের নাটক ‘হেমলতা’র রিহার্সাল শুরু হলো। এ নাটকে বিনোদিনীর নায়িকার ভূমিকায় প্রমোশন হলো।’
১৮৭৫ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পর পর লাহোর ও লক্ষ্ণৌ শহরে দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ ও ‘নীলদর্পন’ নাটকের মুখ্য দুটি চরিত্রে এবং ‘সতী কি কলঙ্কিনী’, ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘সধবার একাদশী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটকে অভিনয় করেন নটী বিনোদিনী। তখনও নটী বিনোদিনী হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। ছিলেন বিনোদিনী দাসী। পরে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্রের পাদস্পর্শে এসে তিনি হয়ে ওঠেন ‘নটী বিনোদিনী’।
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিনোদিনী শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দেন। এবারে তার মাসিক বেতন বেড়ে হলো ২৫ টাকা। এখানেই প্রথম অভিনয় করেন বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে। এতে একই সঙ্গে আয়েশা, তিলোত্তমা ও আসমানী- এই ৩ চরিত্রে অভিনয় করে বেশ সাড়া ফেলেন তিনি। এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের আরেকটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘কপালকুণ্ডলা’ নাটকে একই সঙ্গে কপালকুণ্ডলা ও মতিবিবি চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের প্রশংসা কুড়ান। তখন নটী বিনোদিনীর জনপ্রিয়তার সূর্য মধ্যাকাশে গনগন করছে। নাট্য প্রাঙ্গণে দর্শকদের মুখে মুখে একটাই নাম- নটী বিনোদিনী। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য অবলম্বনে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ নাটকে একই সঙ্গে সাতটি চরিত্রে অভিনয় করে আরও বেশি আলোচনায় আসেন তিনি। দর্শকরা সপ্রশংস। থিয়েটারের কুশীলবরা অভিভূত। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখতো আর ভাবতো- একজন নারী একই সঙ্গে একই সময়ে এতগুলো চরিত্রে অভিনয় করে কীভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের আরেকটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে কুন্দনন্দিনী এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকে কাঞ্চন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পুরাণ নির্ভর নাটকেও অভিনয় করে দর্শকের মনে জায়গা করে নেন তিনি। সীতা, প্রমীলা, দ্রৌপদী, রাধিকা, উত্তরা, দময়ন্তী, গোপা, চিন্তামণি প্রভৃতি চরিত্রকে যেমন জীবন্ত করে তুলেছেন, তেমনই কাঞ্চন, কামিনী, মনোরমা, কুন্দনন্দিনী, বিলাসিনী, কানফরমা, রঙ্গিনী প্রভৃতি সামাজিক চরিত্রে তার অভিনয় গুণে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হতো। মঞ্চের সামনে বসে দর্শক নিবিষ্ট চিত্তে এসব চরিত্রে তার অভিনয় দেখতো। সামাজিক চরিত্রের পাশাপাশি ঐতিহাসিক চরিত্রকেও নটী বিনোদিনী সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৭ সালে আগস্ট পর্যন্ত বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় করেন বিনোদিনী। মূলত এরপরই নটী বিনোদিনী তার প্রকৃত গুরুর সান্নিধ্যে আসেন। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে অভিনয়ের মিনতি নিয়েই গেছিলেন তিনি। গিরিশচন্দ্রও তাকে ফিরিয়ে দেননি। সমাদরে ঠাঁই দিয়েছেন নিজের থিয়েটারে। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি গিরিশচন্দ্রের আশ্রয়ে অভিনয় করেন। তার সবশেষ অভিনয়: ‘বেল্লিকবাজার’ নাটকে রঙ্গিণী চরিত্রে, ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি।
পুরোদস্তুর অভিনয় জীবনে নটী বিনোদিনী ৫০-৬০টিরও বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটারে তার অভিনয় নৈপুণ্য দর্শক মহলে যেমন সাড়া ফেলেছে, তেমনই বাঙালি নারীকে থিয়েটারে আসার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বিকাশ ভট্টাচার্য নিবন্ধে লিখেছেন: ‘বহু বিচিত্র চরিত্রের নানা প্রকাশে বিনোদিনী সে যুগে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছেন। সাধারণ দর্শক থেকে বিদগ্ধ দর্শক, রুচিশীল দর্শক থেকে প্রমোদলোভী দর্শক সবাই তার অভিনয়ে মুগ্ধ হতেন (স্বস্তিকা)।’
শুধু তাই নয়, স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ তার নাটক দেখে আপ্লুত হয়েছেন। এছাড়া দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান দর্শকরাও তার অভিনয়ের প্রশংসা না করে থাকতে পারেননি। নটী বিনোদিনীকে নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি হতো। ১৮৭৮ সালের ৯ মার্চ ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজে ‘মৃণালিনী’ নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় সম্পর্কে লেখা হয়েছিল: ‘Saturday’s performance of Mrinalini was favourably received by the audience…Srimati Binodini as Monorama in her ascension to the funeral pyre of her husband, carried us to the old days of sattee; and her last farewell address, together with the blaze of the lonely funeral pyre, contributed not a little to the solemnity of the seen.’
১৮৮৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় তার অভিনয়ের প্রশস্তি তুলে ধরে লেখা হয়: ‘The actor who took the part of Chaitanya seems to be gifted with considerable historic ability.’
থিয়েটার জুড়ে বিশ্বাসঘাতকতা আর কদর্য রাজনীতিতে যখনই নটী বিনোদিনী ভেঙে পড়েছিলেন ঠিক তখনই ‘চৈতন্যলীলা’ (১৮৮৪) নাটক দেখতে আসেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তার আশীর্বাদে যেন জীবনে নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেলেন, সম্বিত পেলেন নটী বিনোদিনী। এই অভিনয় দেখে রামকৃষ্ণ এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে স্বয়ং গ্রিনরুমে গিয়ে বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেন।
বারাঙ্গানার ঘৃণা ও দুঃখ ভরা জীবন কাটিয়ে উঠে বাংলা নাট্যজগতে নিজে সঁপে দিয়ে নটী বিনোদিনী যেমন আত্মসম্মান খুঁজেছিলেন, তেমনই থিয়েটারে অন্য নারীদের জন্যও হয়ে উঠেছেন প্রেরণার উৎস। অবশ্য বাঙালি সমসাময়িক নাট্যকর্তারা তার মূল্যায়ন করেননি। আত্মম্ভরিতা আর স্বেচ্ছাচারিতায় মদমত্ত বাংলা নাট্যসমাজ তাকে শুধু অবজ্ঞাই করে গেছেন। অথচ এই নটী বিনোদিনীই একদিন নিজের দেহ বিক্রি করে গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে পাওয়া ৫০ হাজার টাকা থিয়েটারকে দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন- নিজের নামে থিয়েটার হোক। কিন্তু প্রতারণা আর ছলনা ছাড়া কিছুই পেলেন না তিনি।
তথ্যসূত্র:
১. বিনোদিনী দাসী, নটী বিনোদিনী রচনাসমগ্র (সম্পাদনা : আশুতোষ ভট্টাচার্য, সাহিত্য সংস্থা, ১ বৈশাখ ১৩১৪);
২. ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪, হিন্দু পেট্রিয়ট;
৩. ৯ মার্চ ১৮৭৮, ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ;
৪. বিকাশ ভট্টাচার্য, ‘বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে নটী বিনোদিনী’, স্বস্তিকা (জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৯);
৫. ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও গিরিশচন্দ্র।