আতলিত-ইয়াম: জলের অতলে হারিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক মানব বসতি

0

আতলিত, ইসরায়েল এর উপকূল থেকে দূরে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া প্রাচীন নিওলিথিক এক গ্রাম আতলিত ইয়াম। কার্বন-ডেট এর মাধ্যমে জানা গেছে যে, গ্রামটির বয়স ৮৯০০ থেকে ৮৩০০ বছরের মাঝামাঝি কোন এক সংখ্যা!  অতীতের গ্রামটির বর্তমান অবস্থান এখন ৮-১২ মিটার পানির নীচে। কিন্তু কিভাবে এই গ্রামের স্থান হল সমুদ্রের নিচে? রাতারাতি একটি মানবপূর্ণ বসতি কিভাবে জন-মানবহীন পরিত্যক্ত স্থানে পরিণত হল? আর এর পেছনের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা কতটুকু জানতে পেরেছেন? তাই নিয়ে আজকের আয়োজন।

পৃথিবীর প্রাচীনতম কৃষি-পশুপালন-সমুদ্র ভিত্তিক জীবিকা ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায় লেভানটিন উপকূলবর্তী আতলিত-ইয়াম গ্রাম থেকে। খ্রিস্টপূর্ব সাত সহস্র বছরেরও আগে বিদ্যমান এই গ্রাম চূড়ান্ত “প্রি-পটারি নিওলিথিক বি” যুগের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এই গ্রাম ভূমধ্যসাগরের বে অব আতলিতে, কারমেল উপকুলের ওরেন নদীমুখে  ৮-১২ মিটার পানির নীচে ১০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।

জলের অতলে হারিয়ে যাওয়া আতলিত-ইয়াম
জলের অতলে হারিয়ে যাওয়া
আতলিত-ইয়াম

প্রাচীন এই গ্রাম পানিতে তলিয়ে পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে আড়াল হয়ে যায় বরফ যুগের শেষের দিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে। ধরে নেয়া হয় যে, তৎকালীন সময়ের তট রেখা বর্তমান তট রেখা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। ক্যামেল উপকূলে ডুবন্ত বসতি এবং জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এর সন্ধান পাওয়া শুরু হয় ১৯৬০ সাল থেকে। প্রাচীন এই গ্রাম সারা পৃথিবীর নজরে আসে ১৯৮৪ সালে মেরিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এহুদ গালিলি এর হাত ধরে, যখন তিনি জাহাজ ডুবি নিয়ে গবেষণা করতে আসেন। তারপর থেকে সমুদ্রের নীচে খননকাজ চালিয়ে  আয়তাকার বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ, কুঁড়ে ঘর, সমাধি এবং কুয়া আবিষ্কৃত হয়। বসতির মাঝখানে ৭ টি স্মৃতিস্তম্ভরূপ বিশালাকার পাথর মিঠা পানির ঝর্ণার চারপাশে অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো রয়েছে, সম্ভবত সেই স্থানে পানি সংক্রান্ত কোন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হত। ৭ টি স্তম্ভ স্বরূপ বিশালাকার পাথরগুলোর এক একটির ওজন প্রায় ৬০০ কেজি এবং ১-২ মিটার পর্যন্ত উঁচু। এছাড়াও আরেকটি স্থাপনা রয়েছে যেখানে মোট ৩ টি ডিম্বাকার পাথর রয়েছে ( ১.৬-১.৮ মিটার উঁচু), যার মধ্যে দুইটি পাথর এন্থ্রোপোমরফিক আকৃতির।

পাথুরে কুয়া
পাথুরে কুয়া
Source: Stuff You Should Know

এই স্থানে আরেকটি পাথুরে কুয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে যার গভীরতা প্রায় ৫.৫ মিটার। কুয়ার ভেতরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা পশুর হাড়, পাথর, কাঠ, অগ্নি পাথর, এবং হাড়ের তৈরি জিনিস খুঁজে পেয়েছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, যখন কুয়ার পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন কুয়াটি ব্যবহৃত হয়েছিল ময়লা ফেলার ভাগাড় হিসেবে। সম্ভবত এই কুয়া খনন করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৯ হাজার বছরের শেষের দিকে এবং স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য এই কুয়া ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আতলিত-ইয়াম এ পাওয়া প্রাচীন বস্তুগুলো থেকে প্রাগৈতিহাসিক জনবসতিগুলোর জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। গবেষকেরা সেই স্থানে ১০০ টির বেশি জাতের গাছের উপস্থিতির চিহ্ন এবং বন্য ও গৃহপালিত উভয় জাতের পশুর হাড়গোড় খুঁজে পেয়েছেন! একই সাথে ৬০০০ এর বেশি সংখ্যক মাছের কাঁটা পাওয়া গেছে!

শুধু এগুলোই পাওয়া গেছে তা না। তখনকার মানুষজনদের দেহাবশেষ থেকে প্রতিনিয়ত ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে আসার কারণে ঘটা এক ধরনের কানের রোগ সম্পর্কেও ধারণা পেয়েছেন গবেষকের। এর থেকে ধারণা করা যায় যে, আতলিত-ইয়াম এর বাসিন্দাদের বেশিরভাগ মাছ ধরার পেশায় যুক্ত ছিল এবং পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরার কারণেই তাদের কানে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এরাই প্রথম প্রাচীন প্রথাগত পেশার বাইরের পেশার সাথে যুক্ত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আতলিত-ইয়াম এর  কয়েকটি ঘরের ভিতরে এবং তার পার্শ্ববর্তী স্থানে ১০ টি সমাধি পাওয়া গেছে যেখানে মরদেহগুলোকে বাঁকা করে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে পাওয়া একটি নারী ও শিশু কঙ্কাল পরীক্ষা করে জানা গেছে যে, সেই সময়েও যক্ষ্মা রোগের অস্তিত্ব ছিল। শিশু কঙ্কালের হাড়ের আকার এবং যক্ষ্মার প্রতিক্রিয়া থেকে ধারণা করা যায় যে, মায়ের কাছ থেকে শিশুটির শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করেছিল এবং জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই শিশুটি মৃত্যুবরণ করেছিল।

আতলিত-ইয়াম
আতলিত-ইয়াম
Source: Alchetron

পানির নিচে তলিয়ে যাবার কারণ

প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি রহস্য হল আতলিতের পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া। কিভাবে তলিয়ে গেল প্রাচীন এই গ্রামটি? তলিয়ে যাওয়ার কারণ এবং কারণের পেছনের তথ্য প্রমাণের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং তর্কের শেষ নেই। ইটালিয়ান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ জিওফিজিক্স অ্যান্ড ভল্কেনোলজি, পিসা এর মারিয়া পারেচির গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ৮,৫০০ বছর আগে এক অগ্ন্যুৎপাতের কারণে এটনা পর্বতের পূর্ব পার্শ্বদেশ ভেঙ্গে পড়ার কারণে সমুদ্রে ৪০ মিটার উঁচু সুনামির সৃষ্টি হয়, যা ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় শহর এবং এলাকাগুলোকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রাস করে ফেলে। কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণায় জানা যায়, আতলিত-ইয়াম এর জনগণ প্রায় একই সময়ে গ্রাম ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যায় এবং হাজার হাজার মাছের দেহাবশেষ সুনামি ঘটার প্রমাণ বহন করে।

তবে অন্যান্য গবেষকেরা প্রস্তাব করেছেন যে সুনামির দ্বারা পুরো একটি বসতি ধ্বংসের দৃঢ় কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরেকটি কারণ হিসেবে আবহাওয়া পরিবর্তনকে ধরে নেয়া যায়। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আতলিত-ইয়াম প্লাবিত হয় যা সেখানকার মানুষদের বাধ্য করে গ্রাম ত্যাগ করার জন্য। তবে কারণ যাই হোক না কেন, সেখানকার মাটি এবং লবণাক্ত পানির নিচে বালি যুক্ত পলির কারণে প্রাচীন আতলিত-ইয়াম এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত অবস্থায় বিরাজমান।                   

Source Feature Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More