জিলট মুভমেন্ট: মুসলিম স্পেনে গোঁড়া খ্রিষ্টানদের বিদ্রোহ

0

নবম শতকে মুসলিম স্পেনের দ্বিতীয় আবদুর রহমানের শাসনামলে গোঁড়া খ্রিষ্টানরা মুসলিম বিরোধী আন্দোলন নামে। সব ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া সত্বেও তাদের এ বিদ্রোহের সুনির্দিষ্ট কারন পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় মুসলিম শাসনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা এ আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ইতিহাসে জিলট মুভমেন্ট বা ধর্মান্ধ আন্দোলন  নামের এ বিদ্রোহের ফলাফল হিসেবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে চূড়ান্তভাবে স্পেন থেকে মুসলিমরা বিতাড়িত হয়৷ মুসলিম স্পেন সাম্রাজ্যের তাৎপর্যপূর্ণ এ ধর্মান্ধ আন্দোলনের আগাগোড়া জানাব আজ।

মুসলিম বিজয়ের পর স্পেনের খ্রিষ্টানগণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ধরণের স্বাধীনতা ভোগ করত। তাদের নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে অনেকেই রাজকীয় বিভিন্ন পদে নিয়োগও পেত। খলিফা হিশামের উদার আচরণে প্রভাবিত হয়ে স্পেনের অনেক খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করে৷ বাদবাকি যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তারাও আরবদের কৃষ্টি কালচারের প্রতি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে এবং আরবীয় ভাবধারার অনুকরণ করতে থাকে। স্পেনে এদেরকে বলা হত মোজারব। সেভিল, কর্ডোভা ইত্যাদি শহরে মোজারবদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে  গোঁড়া খ্রিষ্টানগণ শংকিত হয়। স্পেনের খ্রিষ্টান সমাজে নতুন এ পরিবর্তন তারা ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তারা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে মুসলিম ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও কুৎসা রটাতে থাকে৷ ধীরে ধীরে তাঁদের এ প্রচারণা একটি আন্দোলনে রূপ নেয়৷ ইতিহাসে এ আন্দোলন পরিচিত পায় জিলট মুভমেন্ট বা ধর্মান্ধ আন্দোলন। উল্লেখ্য এ আন্দোলনে উদার খ্রিষ্টানরা অংশ নেয়নি।

মুসলিম ওয়াল, মাদ্রিদ। স্পেনে মুসলিমদের স্মারক
মুসলিম ওয়াল, মাদ্রিদ। স্পেনে মুসলিমদের স্মারক Source: Wikimedia

যে কারণে সংঘটিত হয়েছিল জিলট মুভমেন্ট

মুসলিম স্পেনের শাসকগণ খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতা দেওয়ার কারণে অনেক খ্রিষ্টান তাদের নিজ ধর্ম ত্যাগ না করে আরবীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুসলমানদের উন্নত জীবনযাপনের সংস্পর্শে এসে তাদের আচার আচরণে পরিবর্তন হতে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে মুসলিম স্পেনে আরবীকরণ হতে থাকে। এই আরবীয় প্রভাব খর্ব করে দিতে স্পেনের গোঁড়া খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। হিশামের উদার আচরণে স্পেনের খ্রিষ্টানদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকলে খ্রিষ্টধর্মের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এতে শংকিত হয়ে গোঁড়া খ্রিষ্টানগণ ধর্মান্ধ আন্দোলনে নেমে পড়ে। এছাড়া  গোঁড়া খ্রিষ্টানদের নেতারা রাজ্যে এই বলে প্রচার করে যে, যারা মুসলমানদের হাতে লাঞ্চিত বা নিহত হবে তারা বেহেশতে চলে যাবে। শাহাদাত বরণের এ স্পৃহা অধিক মাত্রায় খ্রিষ্টানদের এ আন্দোলনে প্রবেশ করায়৷ গোঁড়া খ্রিষ্টানরা আবার আরবদের দখলদার মনে করত। মুসলিমবিরোধী নীতি গ্রহণ করে প্রবল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা এ আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। সর্বোপরি মুসলিমদের প্রতি অহেতুক বিদ্বেষ এবং খ্রিষ্টীয় যাজকদের স্বার্থে আঘাত লাগলে জিলট মুভমেন্ট শুরু হয়।

আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ

সেন্ট জুলিয়াস গির্জার যাজক ইউলোজিয়াস এবং এলভারোর নেতৃত্বে স্পেনে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্ধ আন্দোলন শুরু হয়। ইউলোজিয়াস ও এলভারো এবং তার শিষ্যরা প্রকাশ্যে রাজপথে,  মসজিদে ঢুকে ইসলাম ও মুহাম্মদ (স) কে নিয়ে কুৎসা রটাতে থাকে। ধর্মান্ধ আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল ইউলোজিয়াস এবং ফ্লোরা নামের এক নারী৷ ফ্লোরার বাবা ছিল মুসলমান এবং মা একজন খ্রিস্টান। ফ্লোরা গোপণে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তার ভাই ও বাবা তাকে কাজির কাছে নিয়ে যায়। কাজি তাকে চাবুক মারার আদেশ দিলে অপরাপর খ্রিষ্টানরা এ ঘটনায় ক্ষেপে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ আন্দোলন আরো জমে উঠে। সাম্রাজ্যের আমির দ্বিতীয় আবদুর রহমান তাদের এহেন কাজ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার আদেশ দিলে তারা এতে কর্ণপাত না করে উপরন্তু প্রচার করতে থাকে মুসলমানদের হাতে কেউ অপমানিত হলে সে স্বর্গে চলে যাবে।  

মানচিত্রে কর্ডোভা, এখানেই ছিল জিলট মুভমেন্টের প্রাণকেন্দ্র
মানচিত্রে কর্ডোভা, এখানেই ছিল জিলট মুভমেন্টের প্রাণকেন্দ্র Source: Wikipedia

এমন এক সময়ে পবিত্র রমজান মাসে পারফেকটাস নামের এক খ্রিষ্টান হযরত মুহাম্মদ (স) কে নিয়ে কটুক্তি করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়৷ এ ঘটনায় খ্রিষ্টানগণ আরো উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদে স্বেচ্ছা আত্মাহুতি দিতে থাকে। কর্ডোভা ও টলেডোতে স্বেচ্ছা আত্মাহুতির পরিমাণ বাড়তে থাকলে আবদুর রহমান সরকার বিপাকে পড়ে যায়। এ সময় রাজ্যের উদার খ্রিষ্টানগণ এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। আবদুর রহমান এ আন্দোলন দমন করার জন্য রাজ্যে একটি ধর্মীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় প্রতিনিধিত্ব করেন আমিরের সেক্রেটারী এন্টনি গোমেজ৷ বিশপগণ মত প্রকাশ করেন যে, অপর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বাইবেলের চেতনা পরিপন্থী এবং ঘৃণা থেকে দূরে থাকা পূণ্যের কাজ।তবুও গোঁড়া খ্রিষ্টানগণ শান্ত না হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এতে দ্বিতীয় আবদুর রহমান ক্ষিপ্ত হয়ে ফ্লোরা ও মেরিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ফলে এ আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থিমিত হয়ে পড়ে।  দ্বিতীয় আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম মুহাম্মদের রাজত্বকালেও এ আন্দোলন আবার দানা বাঁধে। ৮৫৯ সালে ইউলোজিয়াস, অলভারো ও লিওসহ ৪৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দিলে এ আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।

মুসলিম স্পেনের ধর্মান্ধ খ্রিষ্টানদের এ আন্দোলন সফলভাবে দমানো গেলেও খ্রিষ্টানদের মুসলমানদের প্রতি মনোভাব অপরিবর্তিত থেকে যায়। যার খেসারত দিতে হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। পুঞ্জীভূত ঘৃণা এবং নতুন খ্রিষ্টান প্রজন্মের জাতীয়তাবোধ আর দুর্বল মুসলিম শাসকদের খামখেয়ালি আচরণে তার কয়েকশো বছর পরই স্পেনের সাম্রাজ্য হারায় মুসলমানরা, যার প্রেরণা ছিল ঐ নবম শতকের জিলট মুভমেন্ট বা ধর্মান্ধ আন্দোল।      

Source Feature Image
Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More