হুমায়ূন পেছন দিকে তাঁকালেন, তাঁর তাবুতে আগুন জ্বলছে। আগুন ছুটে যাচ্ছে জেনানা তাঁবুর দিকে। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল। সম্রাট হুমায়ূনের ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে আযান দিচ্ছেন, আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। মহাবিপদের সময় আযান দিতে হয়। আজ মুগলদের মহাবিপদ।
সম্রাট ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। মুহূর্তেই ঘোড়া পানিতে তলিয়ে গেল। সম্রাট নিজেও তলিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন কে যেন বলছে, আমি আপনাকে বাতাস ভর্তি একটা মশক ছুঁড়ে দিচ্ছি। আপনি মশক ধরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করুন।
তুমি কি আমাকে চেনো?
আপনি মুঘল সম্রাট হুমায়ূন
তোমার নাম কি?
আমি নাজিম। ভিস্তিওয়ালা নাজিম। আপনি মশক শক্ত করে ধরে ভাসতে থাকুন। [বাদশাহ নামদার, হুমায়ূন আহমেদ]
মনে আছে ভাগ্যাহত মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের কথা? শেরশাহ এর সাথে যুদ্ধে প্রায় মরতে বসা সম্রাটকে মশক দিয়ে বাঁচিয়েছিল এক ভিস্তি, নিজাম ভিস্তিওয়ালা। সম্রাট খুশি হয়ে সেদিন বলেছিলেন যদি তিনি তার সিংহাসন ফিরে পান তবে একদিনের জন্য হলেও নিজাম ভিস্তিওয়ালাকে রাজ সিংহাসনে বসাবেন। আশ্চর্যের কথা হলো হুমায়ূন তার কথা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে সিংহাসন পূনরূদ্ধার করে নিজাম ভিস্তিকে সম্রাট বানিয়ে এক নজিরবিহীন কাণ্ডের অবতারণা করেন তিনি।
কারা এই ভিস্তিওয়ালা?
বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানীর বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হত খাল, নদী বা কুয়ার উপর৷ একই পদ্ধতি ছিল কলকাতা শহরেও৷ নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হত৷ ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ পানির জন্য সাধারণত শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির উপর নির্ভর করতে হত। শহরে যেসব কুয়া ছিল তাতেও ছিল সুপেয় পানীর অভাব। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকেরা তাই এক বিশেষ পেশাজীবি শ্রেণীর লোকদের মাধ্যমে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন। তাঁদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার এক মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। এদেরকে বলা হত ভিস্তি বা সুক্কা। ভিস্তি আবে ভিস্তি হাঁক দিয়ে প্রতি বাড়ি গিয়ে তাঁরা পানি দিয়ে আসত।
১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০ টি ভিস্তি পল্লীর উল্লেখ করেছিলেন। ঢাকার ভিস্তিরা থাকত সাধারণত পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি। স্থানীয়রা ভিস্তিদের বলত সাক্কা। কালক্রমে এই সাক্কা সিক্কাতে পরিণত হয়ে সিক্কাটুলি পাড়ায় রূপ নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ভিস্তিওয়ালাদের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা ছিল সুন্নি মুসলিম। মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে রাস্তা পরিস্কার রাখার দায়িত্বে তাঁদের প্রত্যক্ষ করা যেত। দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান খ্যাত বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণীদের মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হত নবাব ভিস্তি। কলকাতায় একজন ভিস্তি ১০ থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে এক মশক পানি সরবরাহ করে দিত।
বাংলা সাহিত্যে ভিস্তিওয়ালা
বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সব কবি সাহিত্যিকদের রচনায় ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়৷ এ তালিকায় আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী হাশেম খান। শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে,
“রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মত ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর৷ মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা”
সুকুমার রায় তাঁর ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়? ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।
লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?”
এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিস্কার কবিতায়ও ভিস্তিওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক, একুশ লাখ ভিস্তি
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
ভিস্তিদের বিলুপ্তি
ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ পানির অপ্রতুলতার প্রতি খেয়াল রেখে নবাব খাজা আবদুল গণি ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠার জন্য দুই লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। তাঁর এই বদান্যতায় ১৮৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভায় গড়ে উঠে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহের আধুনিক সুবিধা। আরো পরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসীর নিরাপদ পানির চিন্তা দূরীভূত হয়। আর এরই সাথে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় ভিস্তিদের বর্ণাঢ্য পেশাদারি জীবনের৷ আবেদন কমতে থাকে একেকজন সুক্কা বা সাক্কাদের। তারাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিজেদের জড়িয়ে নেয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ঢাকার রাস্তায় শেষবারের মত এক ভিস্তিকে দেখা গিয়েছিল। তবে কলকাতায় আজো এই ভিস্তিওয়ালাদের চোখে পড়ে।
ezetimibe (zetia)
zofran works quickly
prandin pills – empagliflozin 25mg canada order jardiance 25mg generic