ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষকেরা সবচেয়ে বেশী শোষিত,বঞ্চিত এবং নিপীড়িত হয়েছে। মধ্যযুগ বা তার পূর্ব থেকে উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের সমৃদ্ধির পেছনে কৃষকদের অবদান থাকলেও কৃষকদের সমৃদ্ধি কখনোই হয়নি। কৃষকদের মাধ্যমে সব সময় লাভবান হয়েছেন রাজা-বাদশাহ,জমিদার,ভূস্বামীগণ।উপমহাদেশের অধিকাংশ কৃষক ছিল ভূমিহীন। তারা কোন জমিদার বা ভূস্বামীর জমি বর্গা চাষ করে জীবনযাপন করতো। কিন্তু অন্যের জমি চাষ করে ভূমিহীন কৃষক বা বর্গাচাষীরা পেতো উৎপন্ন ফসলের মাত্র অর্ধেক বা আরও অনেক কম। অথচ ফসল ফলানোর জন্য বীজ থেকে শুরু করে সকল প্রকার শারীরিক শ্রম দিতে হতো বর্গাচাষীদের কিন্তু সবটুকু লাভ নিয়ে যেতো জমির মালিকেরা। বছরের পর বছর এটা হয়ে আসলেও এক সময় এই শোষণের বিপক্ষে দাঁড়ায় শোষিত বর্গাচাষীরা। ভূমিহীন কৃষকদের দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে জমির মালিকেরা আর দুই ভাগ পাবে কৃষকেরা। তিন ভাগের একভাগ অর্থাৎ তেভাগা থেকে এই আন্দোলনের নাম হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬ সালে এই আন্দোলন শুরু হয়ে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের সাথে কৃষকসমাজ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। শুরুতে জমিদারশ্রেণী পুলিশ,লাঠিয়াল বাহিনী,মামলা -মোকদ্দমা দিয়ে দমনের চেষ্টা চালালেও তাদেরকে হার মানতে হয় নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য দাবির কাছে। ১৯৪৬ সালে এই আন্দোলন শুরু হয়ে বছরব্যাপী চলে অনেক তাজাপ্রাণের মাধ্যমে অধিকার আদায় হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে শেষ হয়।
পটভূমি
পরাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক শক্তির অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নীতি ছিল শোষণ,অন্যায় আর অবিচারের। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যেসব দোসর ছিলেন সেসব জমিদার-জোতদার-মহাজনেরা নিজ দেশের মানুষদের উপর অন্যায়, অবিচার আর শোষণের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন যারা শোষক তাদের কোন দেশ ও জাতিভেদ নেই। শোষক মাত্রই শোষক,সে যেখানেই থাকুক। এ সকল দেশীয় জমিদার, জোতদার,মহাজনের কারণেই দেশে ঘটে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, পঞ্চাশের মন্বন্তর। প্রতিটি দুর্ভিক্ষে কৃষক হারায় বাপের সম্পত্তি, আর অন্যদিকে বাড়ে জমিদারের জমিদারী। কৃষক পরিণত হয় জমিদারের বর্গাদারে। বাংলার ইতিহাস বাংলার কৃষকদের রক্ত,ঘাম আর জলে লেখা ইতিহাস। তারা যেমন যুগযুগ ধরে নিপীড়িত হয়ে এসেছে তেমনি তারা প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। প্রগতিশীল মানুষদের আজও নাড়া দিয়ে যায় সত্তর বছর আগে সংগঠিত পাকা ফসলের ‘ন্যায্য’ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই,যে লড়াই পরিচিতি পেয়ে তেভাগা আন্দোলন নামে।
ব্রিটিশদের নিকট থেকে ভারতের মুক্তি আন্দোলন যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখন বাংলার মাটি রঞ্জিত হয় কৃষকের তাজা রক্তে। ১৯৪৬ সালে সংগঠিত প্রসিদ্ধ তেভাগা আন্দোলনের সংগঠক ছিল কৃষকসভা। মোঘল আমলে বাংলায় জমির মালিকানা ছিল কৃষকের, সে সময় কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ বা তার থেকেও কম খাজনা দিতো। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হয় তখন জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের নিকট। জমিদাররা ব্রিটিশদের খাজনা দিতো জমির পরিমাণ আর জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে, উৎপন্ন ফসলের সাথে খাজনার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকের মাঝখানে সৃষ্টি হয় জোতদার নামক মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণীর। জোতদারেরা জমিদারদের নিকট থেকে বছর ভিত্তিক জমির ইজারা নিয়ে কৃষকদের চাষ করতে দিতো। কৃষকদের নিজ খরচে ফসল চাষের সকল ব্যয় বহন করতে হতো কিন্তু জমির মালিকানা না থাকার কারণে তাদের কে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের নিকট। জোতদার ও জমিদারেরা মিলে ভূমিহীন কৃষকদের নিপীড়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। খাজনা আদায়ের জন্য ভূমিহীন কৃষকদের দাসের মতো ব্যবহার করতে শুরু করে জমিদাররা। এক সময় তারা ফসলের পরিবর্তে খাজনা হিসেবে টাকা নেওয়া শুরু করে। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে মহাজনদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে খাজনা পরিশোধ করে।
ফলে তারা দিনে দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। দিনে দিনে জমিদার জোতদারদের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময় কৃষকেরা এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয় কৃষকসমাজ। তারা দাবি করে যেহেতু তারা ফসল উৎপাদনের সমস্ত খরচ বহন করেন তাই তারা ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন,জমিদাররা পাবেন এক ভাগ। কৃষকদের এই আন্দোলনের নাম হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার উদ্যোগে অবিভক্ত বাংলার ভূমি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব করে ‘ফ্লাউড কমিশন’। এই কমিশন তাদের রিপোর্টে ফজলুল হকের সরকারকে প্রস্তাব করে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে জমির মালিকানা সরাসরি কৃষকদের দিতে এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের দুইভাগ তাদের প্রদান করতে। ফ্লাউড কমিশনের এই সকল প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য কৃষকসমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জমিদারগণ সেই সময় হাট বাজার থেকে জনসাধারণের কাছে ‘তোলা’ বা ‘কর ‘ তুলতো, এন বিরুদ্ধে সাধারণ ফুঁসে উঠতে থাকে।
উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা আন্দোলনের সুতিকাগার। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের উদ্ভব হওয়ার কারণ ছিল উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত সহস্র বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আন্দোলনকে সার্থকতার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার মরণপন সংগ্রাম করেন সেই নেতারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী। তারা হলেন দিনাজপুরের হাজী মো. দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ন রায়, হেলেকেতু সিং প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। তার মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মোঃ দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন।
আন্দোলনের ব্যাপকতা ও বিভিন্ন দিক
১৯৪০ সালের ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, অবিভক্ত বাংলায় মোট ৭৫ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৩০ লক্ষ পরিবারের জমিতে কোন মালিকানা ছিল না,তারা হয় দিনমজুরের কাজ করত, নয়ত তারা বর্গাচাষ করত। মোট আবাদির জমির ৩৪ ভাগ আবাদ করত সেই সময়ের এই ভূমিহীন কৃষকেরা কিন্তু তাদের এই বর্গাচাষের কোন নিরাপত্তা ছিল না। জমিদারেরা যে কোন সময় তাদের জমি কেড়ে নিতে পারতো। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে এই ভূমিহীন কৃষকেরা খাবারের অভাবে দলে দলে রাস্তাঘাটে মৃত্যুবরণ করে। ফ্লাউড কমিশন তেভাগার ন্যায্যতা স্বীকার করলেও ব্রিটিশ সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে গড়িমসি করে। ফলে ১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কাকদ্বীপ, রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, যশোরে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে।
দিনাজপুরে কৃষকসভার পক্ষ থেকে স্লোগান তোলা হয় — ১। নিজ খেলানে ধান তোলো, ২। আধি নাই-তেভাগা চাই, ৩। কর্জ ধানের সুদ নাই। দিনাজপুরের কৃষক আন্দোলনের নেতা ছিলেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের রূপনারায়ণ রায়। ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসেবে এক বড় জোতদারকে হারিয়ে আইনসভায় নির্বাচিত হন। বাংলার ২৬টি জেলার মধ্যে ২৩টি জেলাতেই তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান গরিব কৃষকরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময়েও কৃষকসভার সংগ্রামী ঐক্য অটুট ছিল।
১৯৪৬ সালে খুলনার মৌভোগে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কৃষ্ণবিনোদ রায়। খুলনার কৃষকদের এই সম্মেলনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করার প্রস্তাব তোলা হয় এবং সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। মূলত এই সম্মেলন তেভাগা আন্দোলনের চূড়ান্ত সূত্রপাত ঘটে। কৃষক সমিতি গঠন, মহিলাদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত করা, আন্দোলন চালানোর জন্যে তহবিল গঠন এবং রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ক্লাস ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সংগ্রামী কৃষকেরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধতা গড়ে তোলেন। দক্ষিণের সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে তেভাগা আন্দোলন। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর তিন মাসের প্রস্তুতি পর ১৯৪৬ সালের নভেম্বরের শেষে পাকা ধান কাটার সময় এল। প্রস্তুতি অনুযায়ী কৃষক সভার ভলান্টিয়ার বাহিনীর প্রত্যক্ষ পাহারায় বর্গাদাররা ধান কেটে নিজেদের খোলানে তুলে নিল। জোতদারের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে তার তিনভাগের একভাগ বুঝে নিতে বলা হল। জোতদাররা সাড়া না দেয়ায় গ্রামবাসীকে সাক্ষী রেখে তাদের ভাগ আলাদা করে রেখে দেয়া হলো। বর্গাদার পুলিশের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষটি ঘটে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার রামপুর গ্রামে। এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়ে বর্গাদার বিদ্রোহ। রামপুর গ্রামে প্রখ্যাত কৃষক নেতা কমরেড সুশীল সেনের উপস্থিতিতে ভলান্টিয়াররা ফুলঝরি নামের বর্গাদারের জমিতে ধান কাটতে গেলে পুলিশ বাঁধা দেয়। পুলিশের আঘাতের বিরুদ্ধে গাইন হাতে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন একজন রাজবংশী তরুণী বিধবা দ্বীপশরী বর্মনী। অন্য কৃষক কর্মীরা তাকে অনুসরণ করে। দ্বীপশরী গাইনের আঘাতে হাবিলদারের দাঁত ভেঙে যায়। পুলিশ হটে যেতে বাধ্য হয়। বর্গাদারদের এ বিজয় পুরো আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে দেয়। ঘটনার পনের দিনের মধ্যে তখনকার দিনাজপুর জেলার ত্রিশটি থানার বাইশ টিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে।
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ বর্গাদার নিজেদের খামারে ফসল তোলেন। হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৩ ডিসেম্বর সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি কমরেড মুজফফর আহমেদ ও বঙ্গীয় কৃষকসভার সভাপতি কৃষ্ণবিনোদ রায় সহস্রাধিক কৃষকসভা কর্মীকে গ্রেপ্তারের নিন্দা করে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। ১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরির বন্দরের তালপুকুর গ্রামে পুলিশ গুলি করে বর্গাদার সমিরুদ্দীনকে হত্যা করলে খেতমজুর সাঁওতাল শিবরাম মাঝির নিক্ষিপ্ত তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় হত্যাকারী পুলিশ। অন্য পুলিশরা গুলি করে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে সাহসী কৃষক স্বেচ্ছাসেবক শিবরামকে। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ একজন বর্গদার, অন্যজন খেতমজুর।
৯ জানুয়ারি বর্তমান নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার কৃষককর্মী তন্নারায়ণকে সন্ধ্যাবেলায় অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে জোতদার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাহিনী। ২০ জানুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমায় খাঁপুরে প্রতিরোধকারী কৃষকদের ওপর পুলিশ ১২১ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে তৎক্ষণাৎ এবং হাসপাতালে মিলিয়ে মোট ২২ জন কৃষক মৃত্যুবরণ করে।তেভাগা আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মধ্যে ছিলেন অজিত বসু, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, কংসারী হালদার, নুর জালাল, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পান্ডার প্রমুখ। তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকছিল আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা।তৎকালীন দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমায় তেভাগা আন্দোলন সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। জোতদারেরা জমি থেকে নিজেদের অর্ধেক ধান কেটে নেওয়ার সাথে কৃষকদের অর্ধেক থেকেও অনেক অংশ কেটে নিয়ে যেত। স্থানীয় কৃষকেরা এ সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলে কিন্তু জমিদারেরা পুলিশ ও নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে কৃষকদের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু কৃষকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পুলিশ পিছু যায়। ঠাকুরগাঁও এ নারী-পুরুষেরা গেরিলাদের মত দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে জমি থেকে ধান কেটে নিয়ে যেতে কিন্তু অনেক সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে নিহত হতো। এভাবে প্রচুর পরিমাণ কৃষক নারী-পুরুষ নিহত হন কিন্তু তাদের সংগ্রাম থামেনি এবং জমি থেকে তাদের ধান তোলাও বন্ধ হয়নি। তেভাগা সংগ্রামে কাকদ্বীপের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে আজও। বুধাখালি নামক স্থান থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান গজেন মালী নামে এক কৃষকনেতা। সুন্দরবনের অনুন্নত ও উপেক্ষিত এই জনপদে জমিদারদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করতো। কিন্তু তেভাগার আহ্বানে বহুদিনের ঘুমন্ত জনশক্তি জেগে ওঠে। ১৯৪৬ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত থেকে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় এবং তেভাগা আন্দোলন ও কৃষকদের প্রতিরোধ ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিল।
অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, হুগলির বড়া কমলাপুর, ডুবেরভেড়ি প্রভৃতি অঞ্চল তেভাগা আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। সুন্দরবনের অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন ছিল অনেক বেশী তীব্র। এ অঞ্চলের জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনী কৃষকের কাছে থেকে ফসলের ভাগ নেওয়ার জন্য যাওয়ার সাহস করতে পারেনি।কৃষকদের মামলার জালে ফাঁসানো হলেও কৃষক নেতাদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা হয়নি পুলিশের। হেমন্ত ঘোষাল, কংসারী হালদার, অশোক বসু প্রমুখ নেতারা দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে থেকে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করে তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সহায়তা করেছেন। তেভাগা আন্দোলনের চাপে এবং কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব দেখে মুসলিম লীগ সরকার ১৯৪৭ সালে ২২ জানুয়ারি জনসাধারণের অবগতির জন্য ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’ ১৯৪৭ প্রকাশ করে। ১৯৪৬ সালের ১২ই মার্চ আইনসভায় এক ভাষণে বিরোধীদলের কমিউনিস্ট দলের সদস্য জ্যোতি বসু সরকারি দমননীতির নিন্দা করে বলেছিলেন, ‘‘কৃষিজমির বর্গাদারকে তাঁর উৎপাদিত ধানের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ দেওয়ার আইনসিদ্ধ অধিকার সরকার কর্তৃক পরিত্যাগ করার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং বিশ্বাসঘাতক নীতির তীব্র নিন্দা করছি আমি।’’ তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান জোতদার-জমিদারদের চাপের কারণে খসড়া বর্গাদার বিল তিনি আর কার্যকর করেননি। তখন দেশ বিভাজন হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই জ্বলে উঠে দাঙ্গার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ । যদিও তেভাগার দাবির সত্যিকারের রূপ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। চব্বিশ পরগনার সংগ্রামী কৃষক নেতা কমরেড হেমন্ত ঘোষাল আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন“গ্রামে গ্রামে প্রচারাভিযান সংগঠিত হল, বলা হল, তেভাগার লড়াইয়ে নামতে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে- পরিবারপিছু একজন যুবক, একটি টাকা ও একটি লাঠি দিতে হবে। অদ্ভুত সাড়া পাওয়া গেল- ২০ দিনের মধ্যে ১২০০ জওয়ান ছেলে, ১২০০ টাকা ও ১২০০ লাঠি সংগৃহীত হল।… পরিবারের শক্ত, সমর্থ পুরুষটিকে লড়াইয়ে পাঠিয়েই তারা ক্ষান্ত হল না, ঘাঁটি আগলানোর জন্য ২০ দিনের মধ্যেই ১৫০০ জনের সংগঠিত নারী প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তুলল।”
নারীদের ভূমিকা
তেভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল নারীদের জোরালো অংশগ্রহণ। এই আন্দোলনের সাথে জড়িত নারী নেত্রী ইলা মিত্রের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার এই নারী নেত্রীকে তেভাগা আন্দোলনের জন্য সহ্য করতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে পুলিশ তাকে আটক করে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেওয়ার জন্য তাকে বিবস্ত্র করা থেকে শুরু করে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ পর্যন্ত করা হয় এমনকি তার পায়ের মধ্যে পেরেক ঢুকানো হয়। তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িত নারীরা লাঠি হাতে ফসল পাহারা দিয়েছেন,পুলিশের সাথে লড়াই করেছেন, অনেক সময় শাঁখ, কাঁসা বাজিয়ে পুলিশ আসার বিষয়ে সতর্ক করেছেন পুরুষ যোদ্ধাদের।
তেভাগা আন্দোলনের ফলাফল
তেভাগা আন্দোলনের ফলের জমিদারি প্রথা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলুপ্তি ঘটে এবং কৃষকেরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পায়,মুক্তি ঘটে শত শত বছরের শোষণ, অবিচার আর অন্যায়ের হাত থেকে। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন পরবর্তীতে মেহনতি মানুষের উপর অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ,নির্যাতন থেকে অনেকাংশে মুক্তি দেয়।
সাহিত্যে তেভাগা আন্দোলন
তেভাগা আন্দোলন নিয়ে অনেক বই,কবিতা,সিনেমা, নাটক ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। ১৯৪৬ সালে খুলনার মৌভোগে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে কবি বিষ্ণু দে রচনা করেন ‘ মৌভোগ কবিতা’। চন্দনপিঁড়ির ‘অহল্যাে মা’ বিখ্যাত হয়ে অনেক গানে। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে গণসংগীতশিল্পী বিনয় রায় করেন,‘আর কতকাল, বল কতকাল, সইব এ মৃত্যু আসান’ গানটি। তেভাগার শহিদেরা অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে।শিলচর জেলে বন্দি কৃষক মাধবীনাথের মৃত্যু হয়,তারর স্মরণে ভাটিয়ালির একটি বিশেষ ঢঙে হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন — ‘আমরা তো ভুলি নাই শহীদ একথা ভুলবো না/তোমার কলিজার খুনে রাঙাইলো কে আন্ধার জেলখানা।’
১৯৪৮-এ বড়া কমলাপুরে কৃষক-পুলিশ যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। ১৯৫০-এর দশকেই রচিত হয় সাবিত্রী রায়ের উপন্যাস ‘পাকা ধানের গান।’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে ১৯৫৩ সালে নির্মিত পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। এ ছবির নৈপুণ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত।
metformin uk – purchase januvia generic order acarbose 25mg sale