তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ। টগবগে ১৮ বছর বয়সী এক জোয়ান ছেলে। তিনি ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান। পিতা আব্বাস আলী মন্ডল এবং মাতা মোছাম্মৎ কায়সুন্নেসার কোল জুড়ে ধরণীতে এসেছিলেন ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিলো খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষে হাইস্কুলের নাইট শিফটে ভর্তি হন।
১৯৭০ সালে কর্মজীবন শুরু হয় সেনাবাহিনীর সিপাহি পদে যোগ দিয়ে। তাঁর আদিঅন্ত ছিল ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেই। সে সুবাদে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরপরই তাঁকে পাঠানো হল চট্টগ্রামের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে।
২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ এর কালো রাত। হানাদার বাহিনীর নৃশংস হামলার প্রেক্ষিতে কর্মস্থল হতে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে এবং পরেরদিনই মুক্তিযুদ্ধে ৪ নং সেক্টরের হয়ে অংশগ্রহণের নিমিত্তে চলে যান সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তের অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে।
অক্টোবরের শেষার্ধ, ১৯৭১ সাল। হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গলের সি কোম্পানীর হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার মিশনে যান। শ্রীমঙ্গল হতে দশ মাইল দক্ষিণে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি। মাত্র চারশো গজ দুরেই ভারত সীমান্ত যার মধ্যে বাঙ্কার করে আস্তানা গেড়েছে পাকবাহিনী।
হামিদুর রহমানের ইউনিটটি যুদ্ধ করছিলো মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনস্থ জেড ফোর্সে।
২৮ অক্টোবর, ১৯৭১ সাল। ভোর প্রায় চারটা তখন। মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি অবস্থান করলো। ইউনিটের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীদের হটিয়ে ধলই সীমান্ত দখল নেয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে ভোররাতেই আক্রমণ করা হবে।
হতে পারে মুক্তিবাহিনীর দলটি পাকবাহিনীর চেয়ে সংখ্যায় ছোট কিন্তু তাঁদের মূলশক্তি ছিল অদম্য সাহসিকতা, দুর্বার দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগী মনোভাব। সবকিছুর প্রস্তুতি শেষে তাঁরা এগোতে থাকলো যথেষ্ট সাবধানতার সহিত যাতে হানাদার বাহিনী মোটেও টের না পায় গতিবিধি সম্পর্কে।
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয় যুদ্ধে। পরিকল্পনা মোতাবেক সামনে দুই প্লাটুন সৈন্য আর পিছে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করা হবে কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। পাকিস্তানি বাহিনীর আগে হতেই পুঁতে রাখা মাইন বোমা সামনে এগোতে থাকা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার শরীর মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে ফেলে, বাকি কজন অপেক্ষায় ছিলেন মৃত্যুর সুধা পানের। দেশমাতার মৃত্তিকা তখন শহীদ-গাজীদের রক্তে রঞ্জিত। এ মুহূর্তে হতবিহব্বল হলে চলবে না কিছুতেই বরং লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে না গেলে সবাই শেষ, সাথে ধলই সীমান্ত দখলের আশাও। তবে সামনে আরেক বিপত্তি হয়ে দেখা দিলো পাকবাহিনীর অধীনে থাকা এলএমজির সাইসাই করে ছুটে আসা গুলির বর্ষণ যারজন্যে কিছুতেই সামনে এগোনো সম্ভব না। ইতিমধ্যে বেড়েই চলছে হতাহতের সংখ্যা।
যেভাবেই হোক, লাইট মেশিন গান পয়েন্টটা ধ্বংস করতেই হবে। দায়িত্বে থাকা লেফটেনেন্ট কাইয়ুমের মাথায় চিন্তার দাগ ফুটে উঠলো। তৎপর হয়ে টীমের তাঁরই সহযোদ্ধা সবচেয়ে সাহসী সিপাহি হামিদুর রহমানকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘ওই এলএমজিটা থামাতেই হবে। কাজটা তোমাকেই করে দেখাতে হবে।’
চুপ মেরে বসে থাকলে মৃত্যুর সাথে পরাজয় নিশ্চিত বিষয়টা আগে হতেও চিন্তা করছিলেন তিনি কারণ মা’কে কথা দিয়েছিলেন,
‘দেশকে শত্রুমুক্ত করে বাড়ি ফিরব।’
ব্যস, তাঁর ধ্যানজ্ঞানে তখন একটাই লক্ষ্য আর তা হল এলএমজিটাকে থামানো, যেকোনো উপায়ে, যাবে যাক তাঁর প্রাণ। মাটিতে ক্রলিং করে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন তিনি গান পয়েন্টের দিকে। মাটির নিচে পুঁতে রাখা মাইন বা সাইসাই করে ছুটে আসা গুলির ভয় তাঁকে কাবু করতে পারে নি, দুর্বার গতিতে ছুঁটে চলছেন সমানে। পৌঁছে দেখলেন এলএমজির পিছে দুইজন পাক সৈন্য। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হল দুইজনের সাথে তিনি একা ১৮ বছর বয়সী একজন তরুণ কি টিকতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে সব কিছুই মাটি, বৃথা যাবে তাঁর আত্মত্যাগ।
কিছুতেই এ হতে পারে না, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন দুই সৈন্যের উপর। শুরু হল দুইজনের সাথে একজনের ধ্বস্তাধস্তি। শেষমেশ জয়ী হলেন বাংলার এই দামাল ছেলে। নিষ্ক্রিয় হল গান পয়েন্ট। এ সুযোগে রেজিমেন্টের বাকি মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা বিপুল উৎসাহে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যান এবং পাকিবাহিনীকে পরাস্থ করে দখল করে নেন সীমান্ত এলাকা।
সবাই জয়োল্লাসে মত্ত কিন্তু হঠাৎ হামিদুর রহমানকে খুঁজতে গিয়ে পয়েন্টের পাশে দেখতে পান তাঁর নিথর দেহ। পাশেই ছিল তাঁর শিকার করা দুই পাকি হানাদারের মৃতদেহ।
সবার মতো তিনি জয়ের জীবন্ত সাক্ষী হতে পারলেন না। দিয়ে গেলেন জীবন, বিনিময়ে নিয়ে এলেন বিজয়। সোনার টুকরো ছেলেটা সেই গান পয়েন্টে দূর্বার হামলায় নিষ্ক্রিয় করার ফলে জয় লাভ করলো সেই সেক্টরের ইউনিট। ভারতীয় ভূখণ্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
২৮ অক্টোবর, ১৯৭১ ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। তাঁর সমাধিস্থল নীচু ভূমিতে হওয়ায় পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো। ২০০৭ সালের ২৭ শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশেষে ১০ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে ফিরে আসে দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান নিজের দেশে, যে দেশের প্রতিটা বালুকণায় ছিল তাঁর অস্তিত্বের উপস্থিতি। যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করা হয় এবং কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে ১১ ডিসেম্বর তাঁকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
দেশ ফিরে পেলো তাঁর সন্তানকে, নাম তাঁর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান।
buy terbinafine 250mg without prescription – buy diflucan purchase grifulvin v pill