রোজেটা পাথরঃ যে পাথর উন্মোচন করে দিয়েছিল প্রাচীন মিশরের অজানা ইতিহাস

0

১৭৯৯ সাল। সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপোর্টের সেনাবাহিনী মিশর দখলের জন্য ঘাটি গেড়ে বসেছে দেশটির রশিদ নামের শহরে। পশ্চিমারা এই শহরকে ডাকত রোজেটা নামে। নীলনদের প্রান্তে একটি দুর্গ খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন পিয়েরে বাউচার। খোঁড়াখুঁড়ির এক পর্যায়ে একটি পাথর সদৃশ কিছু একটা বাধার সৃষ্টি করে। সন্তর্পণে উত্তোলন করতে গিয়ে বাউচারের চোখ আটকে যায় ঐ পাথরে। তিনি লক্ষ্য করেন পাথরটির গায়ে অজানা কিসব চিত্র খোদাই করা। তার কিঞ্চিত আগ্রহ হল। এগিয়ে গেলেন তিনি। ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার কালো এই ব্যাসাল্ট পাথরটি ক্যাপ্টেনের উৎসাহ হঠাৎ করে বাড়িয়ে তুলল যেন। অনেকক্ষণ নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেও তিনি এর আগামাথা কিছুই ধরতে পারলেন না। তবে তিনি এটা বুঝতে পারলেন যে, এটি কোন সাধারণ পাথর নয়। তৎক্ষণাৎ তিনি এই পাথর সম্রাট নেপোলিয়নের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সম্রাটও যথেষ্ট আগ্রহভরে পাথরে কি খোদাই করা তা অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ। তবে নেপোলিয়ন ঠিক বাউচারের মতও বুঝতে পারলেন এটা কোন সাধারণ পাথর নয়, আর এর গায়ে উৎকীর্ণ রহস্যময় সংখ্যা তথা লিপির নিশ্চয়ই গূঢ়ার্থ আছে। তিনি তখন অবিকল ঐ পাথরের কিছু ছবি করিয়ে বিশ্বের নামীদামী ভাষাবিদদের নিকট পাঠিয়ে দেন, উদ্দেশ্য যদি কোন ব্যবচ্ছেদ হয়।রোজেটা পাথর

রোজেটা শহর থেকে কাকতালীয়-ভাবে এভাবেই আবিষ্কার হয় প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, মিশরীয় লিপি হায়ারোগ্লিফিকের অজেয় সত্তার। আর ইতিহাসে তাই এই পাথর পরিচিতি পায় রোজেটা পাথর নামে।

রহস্যময় পাথরঃ নেপথ্যে হায়ারোগ্লিফিক

পাথরের গায়ে খোদাইকর্ম করা হয়েছিল প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক ভাষায়। আবার একই সাথে ব্যবহার করা হয়েছে তিনটি ভিন্ন লিপি। প্রথম ধাপে ব্যবহার করা হয়েছে হায়ারোগ্লিফিক। যা তখন পর্যন্ত পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে ব্যবহার করা হয়েছে ডিমোটিক লিপি যা ঐ মিশরীয় ভাষারই পরবর্তী অপভ্রংশ। আর তৃতীয় ধাপে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রিক লিপি।

তিন ধাপে তিনটি লিপি

রোজেটা পাথরে যখন লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল তখনকার সমসাময়িক সময়ে মিশরে তিন শ্রেণীর জন্য তিনটি লিপি প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় নথিপত্র এবং ফারাওদের ব্যক্তিগত তথ্যাদির কাজে ব্যবহার করা হত হায়ারোগ্লিফিক লিপি। সাধারণ আমজনতার জন্য প্রচলিত ছিল ডিমোটিক লিপি। আর গ্রিক লিপি ব্যবহার করা হত রাজকীয় কর্মকর্তাদের কাজে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রোজেটা পাথর

হায়ারোগ্লিফিক পাঠোদ্ধারঃ এক সাধনার বাস্তবায়ন

এখন পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হচ্ছে রোজেটা পাথর। রোজেটা পাথর আবিষ্কৃত না হলে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে আজো আমাদের অন্ধকারে থাকতে হত।
১৮০১ সালে ফরাসিদের হটিয়ে দিয়ে ইংরেজরা মিশরে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করে। তারা রোজেটা পাথরের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রেখে দেয়।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে রোজেটা পাথর

এর অব্যবহিত পরেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ভাষাবিজ্ঞানীদের সমাগম ঘটতে থাকে মিউজিয়ামে। দিনরাত মৌজে মেতে থাকেন প্রথিতযশা সব পণ্ডিতগণ। উদ্দেশ্য, হায়ারোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার, ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো। কিন্তু কোনভাবেই কেউ মিলাতে পারছিল না আশ্চর্য পাথরের অজানা ভাষার। অবশেষে সাফল্য এসে ধরা দিল সেই ফরাসিদের হাতে। অবশ্য এর আগে থমাস ইয়ং নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক প্রায় সুরাহা করে দিয়েছিলেন এ রহস্যের।

থমাস ইয়ং ছিলেন ব্যক্তিগতজীবনে একজন চিকিৎসক। একাধারে তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা পদার্থবিদ, ভাষাবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ। প্রত্নতত্ত্ব তার অনেকগুলো আগ্রহের বিষয়ের একটি। মিশরীয় পুরাতত্ত্ব নিয়ে ব্যাপক জানাশোনার কাড়নে তিনি পুরোদস্তুর একজন ইজিপ্টলজিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৮১৪ সালের গোড়ার দিকে রোজেটা পাথর নিয়ে তিনি বিস্তর গবেষণা শুরু করে দেন। দিনরাত ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের পর সাফল্য শেষে তার হাতেই ধরে দেয় তবে আংশিকভাবে। তখনো নাটকীয়তা বাকি। তিনি একদিন সফলভাবে গ্রিক লিপির সাহায্যে আবিষ্কার করলেন যে, পাথরের উপরে ডিম্বাকৃতির যে ছিদ্র আছে তাতে খোদাই করা আছে রাজা পঞ্চম টলেমির নাম। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে নতুন কিছু খুঁজতে শুরু করলেন। তিনি বুঝার চেষ্টা করলেন কোন হায়ারোগ্লিফিক বর্ণগুলার মাধ্যমে টলেমির নাম খোদাই করা আছে। গভীর অধ্যবসায় আর বিরামহীন পর্যবেক্ষণের পর তিনি আলাদাভাবে কিছু বর্ণ ধরতে পারলেন। P, t,m,y এবং s এই বর্ণগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পান থমাস। কিন্তু তখনো হায়ারোগ্লিফিক পাঠ সম্পূর্ণ হয়নি। একটি সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল মাত্র। আর তারই উত্তরসূরি হিসেবে কাজটি সম্পূর্ণ করে অমর হয়ে যান ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জ্যাঁ শ্যাম্পিলিও।

শ্যাম্পিলিওর পূর্ণাঙ্গ পাঠোদ্ধার

থমাস ইয়ং এর অসমাপ্ত কাজে হাত লাগান ফরাসি পণ্ডিত শ্যাম্পলিও। তার ১৬ বছর বয়সেই তিনি ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। শুধু গ্রিক আর ল্যাটিন শিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি, একইসাথে বুৎপত্তি অর্জন করেন প্রাচ্যদেশীয় আরও ৬ টি ভাষায়।

পণ্ডিত শ্যাম্পলিও

যার মধ্যে কপটিক ভাষার জানাশোনা তাকে অমর করে দিয়েছে, যেটা ছিল প্রাচীন মিশরীয় ভাষার পরবর্তী সংস্করণ।
১৮২১ সালে শ্যাম্পিলিও থমাসের রেখে যাওয়া কাজে হাত দেন। ইয়ং যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করেন শ্যাম্পিলিও। তিনিই প্রথম ইজিপ্টিলজিস্ট যিনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যে, পাথরে খোদাইকৃত চিত্রগুলি আসলে বর্ণক্রমে না, সাজানো শব্দ-ক্রমে। তিনি এটা বার করেন, রোজেটা পাথরের হায়ারোগ্লিফিক চিত্র প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে রূপান্তর করা হয়েছে। প্রাচীন গ্রিকের অন্যতম উপশাখা কপ্টিক ভাষা জানা থাকার কারণে তিনি একে একে বের করেন পাথরের খোদাইকৃত নাম টলেমি এবং ক্লিওপেট্রা। আর এই শব্দ দুটোর মাধ্যমেই কপ্টিক আর গ্রিক ভাষার সমন্বয় করে পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হন বহুল আকাঙ্ক্ষিত হায়ারোগ্লিফিক! আর এরই সাথে উন্মোচিত হয় হাজার বছরের প্রাচীন মিশরের অজানা ইতিহাস।

কি লেখা ছিল রোজেটা পাথরে?

রোজেটা পাথরে খোদাইকৃত লেখায় আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই ছিল না। গ্রিক উপনিবেশের প্রতি মিশরীয়দের আস্থা অর্জন করতে পুরোহিতদের পক্ষ থেকে রাজা পঞ্চম টলেমির আনুগত্য প্রকাশের একটি ডিক্রি প্রোথিত ছিল। যেখানে তোষামোদ করা হয়েছে রাজা পঞ্চম টলেমির শাসনকে পুরোহিতদের পক্ষ থেকে যাতে করে সাধারণ জনগণ রাজার শাসনকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারে। ধারণা করা হয় ১৯৬ অব্দের দিকে এ ডিক্রি জারি হয়েছিল।

হায়ারোগ্লিফিক লিপি

প্রাচীন মিশরীয় ফারাও মেনেসের শাসনামলে চিত্রভিত্তিক লিপির গোড়াপত্তন হয়ে ৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দেবী আইসিসের মন্দিরে শেষবারের মত খোদাই করা হয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি। হায়ারোগ্লিফিক শব্দটি এসেছে গ্রিক হায়ারোগ্লিফ শব্দ থেকে। যার অর্থ উৎকীর্ণ পবিত্র লিপি। মিশর দখল কালে গ্রিকরা লক্ষ্য করে পুরোহিতরা মিশরীয় লিপির লিপিকর হিসেবে কাজ করছে। তাই তারা মনে করে এই লিপি বোধহয় ধর্মীয় দিক হতে সংশ্লিষ্ট। আর এ কারণেই হায়ারোগ্লিফ থেকে লিপির নামকরণ হয়ে যায় হায়ারোগ্লিফিক।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি

অক্ষরলিপি হিসেবে হায়ারোগ্লিফিকে ২৪ টি একক ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হত। স্বরধ্বনির ব্যবহার হলেও তা উহ্য থাকত। একই সাথে ছিল প্রায় ৮০ টির মত দ্বি-ব্যঞ্জনধ্বনি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মিশরীয় লিপির শুরুটা হত সাধারণত ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে। সময়ের পাঠচক্রে হায়ারোগ্লিফিকের বিবর্তন হয়েছে অনেক। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে হায়রাটিক লিপির রূপ পরিগ্রহ করে ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বে ডেমোটিক লিপিতে রূপান্তর হয়ে যায়।

 

তথ্যসূত্রঃ

Ancientegypt.co.uk
Discoveringegypt.com
Wikipedia, বিশ্বের সেরা পুরাকীর্তি -খন্দকার মাহমুদুল হাসান

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More