১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এমনই একটি ঘটনা যা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রেরণার উৎস, গর্বের ধন। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য গল্প, বেদনার নীলফুল নির্মাণ করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া রঞ্জিত হয়েছিল এদেশের বীর সন্তানদের রক্তে, পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি অনেক ত্যাগ, রোমাঞ্চ জাগানিয়া মুক্তিকামী লড়াই। অপারেশন জ্যাকপটের মত অতি সামরিক আক্রমণ যখন গেরিলারা সম্পন্ন করেছিল নিখুঁতভাবে তেমনি দা কুড়াল, তীরধনুক নিয়ে অতি সাধারণ কিন্তু দোর্দণ্ড আক্রমন করেছিল ঐ একই মুক্তির কাতারের মানুষ। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুর সেনানিবাসে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওপর বাঙালি-ওরাঁও-সাঁওতাল সম্মিলিত শক্তি এক অভূতপূর্ব আক্রমণ করে বসে খুব সাধারণ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে। দা-কুড়াল, তীর ধনুক দিয়ে বাঙালি-আদিবাসীর এমন প্রতিরোধ পৃথিবী কখনো প্রত্যক্ষ করেছিল কিনা তা বলা ভার। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃতপ্রায় সেই প্রতিরোধ আক্রমণের গল্প শোনাব আজ।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাক দেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে ১ মার্চ কোন কারণ না দেখিয়েই অধিবেশন স্থগিত করে বসেন ইয়াহিয়া খান। আশু প্রহসনের গন্ধ পেয়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তান টালমাটাল হয়ে যায়, প্রতিবাদ যাত্রা, মিছিল মিটিং এ সয়লাব হয়ে যায় বাংলার রাজপথ। ইয়াহিয়ার দুরভিসন্ধি স্পষ্ট বুঝতে পেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। ২ মার্চ ঢাকায় এবং এর পরদিন সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন তিনি। ঢাকায় স্বতস্ফূর্ত হরতাল পালনের পরেরদিন অন্যান্য অঞ্চলেও সোল্লাসে হরতাল পালিত হতে থাকে। এ হরতালের ঢেউ আছড়ে পড়ে রংপুরেও। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে একটি মিছিলে সেদিন শংকু মজুমদার নামের এক কিশোর এক কাণ্ড করে বসে। এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর বাসার নেমপ্লেট উর্দুতে লেখা দেখে সে নেমপ্লেটটি উপড়ে ফেলে। প্রতিবাদে ঐ অবাঙালির বাসা থেকে মিছিলে গুলি ছুড়া হয়, মৃত্যু হয় শংকুর। এ ঘটনার পরই রংপুর উত্তাল হতে থাকে। তার পরদিনও থেমে থেমে বিহারি বাঙালি সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
লেফটেন্যান্ট আব্বাসের মৃত্যু অতপর
কিশোর শংকু নিহত হওয়ার পর সেনা সদস্যদের বাইরে বের হতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এমন এক অস্থিরমতি সময়ে রংপুর সেনানিবাসে এক ঝটিকা সফরে আসেন ১৪ পদাতিক ডিভিশনের ডি ও সি মেজর জেনারেল খাদেম। এক রূদ্ধশ্বাস বৈঠক শেষে খাদেম চলে যাওয়ার পর ক্যান্টমেন্টে তাজা রসদ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ মাছ-মাংস, শাকসবজি ছাড়া সৈনিক অফিসারদের দমবন্ধ লাগছিল, তাছাড়া সৈনিক এবং অফিসারদের একই মেন্যুর খাবার অফিসারদের ইগোতেও কিছুটা বাঁধছিল। এর একটা বিহিত করতে ২৪ মার্চ সকালে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি অফিসার লেফটেন্যান্ট আব্বাসের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র একটি দল তাজা রসদ আনতে দামোদরপুর গ্রামে পৌছায়। পাক সেনাদের আগমনের খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী অচিরেই গাড়ির চারপাশ ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করে, অকস্মাৎ শাহেদ আলী নামের এক তরুণ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাতে লেফটেন্যান্ট আব্বাসকে হত্যা করে বসে। ঘটনা সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করে, সবাই বুঝতে পেরেছিল খুব শীঘ্রই ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

Source: Jugantor
দুঃসাহসিক অভিযান পরিকল্পনা
২৫ শে মার্চ রাতের গণহত্যার খবর চেপে থাকেনি। পুরো দেশজোড়া পৌছার সাথে উত্তাল রংপুরেও এ খবর পৌছে যায়। আওয়ামীলীগ ও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গোপণে ক্যান্টনমেন্টের উপর নজরদারি রাখতে থাকে। এরইমাঝে ক্যান্টনমেন্টের এক বাঙালি সেনা একটি চাঞ্চল্যকর খবর ফাঁস করে দেয়। এই সৈনিকের বরাতে আওয়ামীলীগ ও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নেতারা জানতে পারেন যে ২৫ শে মার্চের পর পাকিস্তানি সেনারা অধিকাংশ সময়ই বাইরে বাইরে অবস্থান করছে। তারা পরিকল্পনা করলেন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের সাহায্যে গ্রামবাসীদের সাথে করে সেনানিবাস দখল করে নিবেন। দুসাহসিক এই অভিযান সফল করতে শুরু হয় তোড়জোড়, গোপনে জনসংযোগ করতে লাগলেন নেতারা। গ্রামের তরুণদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া পাওয়ার পর ঘটল আরেক অসাধারণ ঘটনা৷ ওরাঁও সম্প্রদায়ের নেতা বুদু ওরাঁও, ওরাঁও যুবকদের সাথে করে এ আক্রমণে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তার দেখাদেখি এ অঞ্চলের সাওঁতালরাও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয়।
যেভাবে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে
ওরাঁও এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ আগে থেকেই পাকিস্তানিদের প্রতি ছিল বিরাগভাজন। প্রায়ই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মচারী এসে তাদের বাড়িঘরে হানা দিত। সেনানিবাস আক্রমণের কিছুদিন আগে দুইজন খ্রিষ্টান ফাদারকে সেনাবাহিনী বিনা কারণে আটক রাখে। ফাদার লিন থিন নামের এক যাজককে পাক বাহিনী অনাহারে রাখে, সাথে ওরাঁও নেতা ভাক্টর লাকড়াকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। ভাক্টর লাকড়া ছাড়া পাওয়ার তার সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা বর্ণনা করেন। এছাড়া লাথান লাকড়া নামের আরেক আদিবাসী নেতাকেও একই কায়দায় অসম্মানের সাথে নির্যাতন করে পাক সেনাবাহিনী। এসব ঘটনায় আদিবাসীদের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এ অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে আদিবাসী পাড়ায় প্রচারণা চলতে থাকে জোরসে, প্রবীণ আদিবাসী নেতা অরুণ খালখো এ প্রচারণায় নেতৃত্ব দেন।
২৮ মার্চ, ১৯৭১!
২৮ মার্চ বিকেলের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি দৃশ্য দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়ে৷ এক বিশাল গ্রামবাসীর স্রোত ধেইধেই উত্তেজনা নিয়ে সামনে আগাচ্ছে, হাতে তাঁদের দেশীয় অস্ত্র। মিছিলের পর মিছিল, চোখেমুখে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা আর কন্ঠে শিহরিত শ্লোগান দখলদারদের ব্যারাক যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল৷ আদিবাসী যুবকদের যুদ্ধসাজ দেখে পাক সৈন্যরা যারপরনাই অবাক হল, হাতে তীর ধনুক আর মুখে কালি মাখা মুক্তিকামী এ জনতাকে কিভাবে সামাল দিবে তা ভেবে পাচ্ছিল সেনানিবাসের নির্দয় সৈন্যরা। তাদের বুঝতে বাকি রইল না গ্রামবাসী ও আদিবাসীদের সাথে করেই নাশকতা (?) পরিকল্পনার ছক আঁকছে বাঙালিরা। তটস্থ পাকিস্তানিরা মুহূর্তেই সেনানিবাসের গেটে গেটে এমপি চেকপোস্ট বসিয়ে দেয়। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে জানিয়ে দেয়া হয় সম্ভাব্য আক্রমণের কথা। অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রস্তুত করে সেনানিবাসের চারদিকে অবস্থান নেয় মেশিনগান সংবলিত জিপ। সেনা অফিসাররা দূরবীক্ষণ দিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তারা ভেবে পাচ্ছিল না এই গোবেচারা মানুষগুলোর শক্তির উৎস কোথায়। বিপরীত পাশে মুহূর্মুহূ পাকিস্তান বিরোধী শ্লোগান নিয়ে ধেয়ে আসছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এমপি চেকপোস্টের বাইরে সাঁই সাঁই করে আঘাত করতে থাকে আদিবাসী যুবকদের তীর। খালি গা, কালো মাথার এ মানুষগুলোকে হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিল তাদের পরিণতি কী। তবুও মুক্তির ঝড় উড়ে আসলে তা থামায় সাধ্য কার!

Source: The New Nation
মেশিনগান করে ১০ টি জিপ সেনানিবাসের প্রান্তে সতর্ক অবস্থায় অবস্থান নেয়৷ মেশিনগানগুলোর সাথে স্থাপন করা হয় এমুইনিশন চেইন। জিপগুলোর সাথে যোগ করা হয় কিছু যুদ্ধট্যাংক। সৈনিকরা রাইফেলে বেয়নেট স্থাপন করে অপেক্ষা করতে থাকে পরবর্তী নির্দেশের। আর অপেক্ষা করতে চাইল না পাকিস্তানিরা, জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই বিরামহীন গুলি আসতে থাকে গ্রামবাসীর উপর৷ মেশিনগানের গুলিতে পলকের ভেতর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাধারন মানুষগুলো৷ মাঠের ঘাস লাল রক্তে আর্দ্র হয়ে যায়, কেউবা মুমূর্ষু অবস্থায় গোঙা তে থাকেন। নিষ্ঠুর সৈন্যরা মৃতদেহের উপরেও ছুড়তে থাকে অবিরাম গুলি। তাঁদের পাশবিকতার থামল মেশিনগান বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে। ফলাফল হিসেবে রাস্তায় পড়ে থাকতে লাগল অসংখ্য লাশ। কিন্তু তখনো যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। ধানখেতে আশ্রয় নেয়া আদিবাসী যুবকদের তীরন্দাজ বাহিনী সেনানিবাসের দিকে তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে অগ্রসর হতে থাকে। আবার আক্রমন করে সেনারা। সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধারা লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। ওরাঁও নেতা, বুদু ওরাঁও তখনো অদম্য শক্তি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। গণি উকিল এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত পরবর্তীতে প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধ করার নিশ্চয়তা পেয়ে বুদু ওরাঁও পিছু হটেন। তীরন্দাজ ওরাঁও রা তখন ঝোপঝাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই ফাঁকে মাহাদে ওরাঁও নামের আরেক নেতা সেনানিবাসের দিকে তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে শহীদ হন। সেদিন প্রায় পাঁচ-ছয়শো মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারন গ্রামবাসী নিহত হয়৷ যুদ্ধের পর আরো বেপরোয়া হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।
আশেপাশের সব গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার সাথে নিহতের সব প্রমাণ মুছে দিতে মৃতদেহকে একত্রিত করে বাংলার দীঘি নামক জায়গায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনেক লাশ পুঁতে দেয়া হয় মাটিতে। মৃতদেহ তদারক করতে আসা এক পাকিস্তানি অফিসার দম্ভ করে বলেছিল “ঠিক হ্যায়, বাঙালি সাব খতম হো গিয়া”। ঘাঘট নদীর তীরে বধ্যভূমিতে চেপে রাখা হয় শহীদদের লাশ। এ অভিযানের পর অনেক ওরাঁও ও সাঁওতাল ভারতে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। বহু ওরাঁও ও সাঁওতাল যুদ্ধের পর ভারতেই থেকে যান। যারা এসেছিলেন তারাও পচাত্তরের পর পাড়ি জমান ওপারে। ২৮ মার্চের বিস্মৃতপ্রায় এ প্রতিরোধ আক্রমণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অমলিন থাকবে গৌরবের সাথে। সেদিনের সে ঘটনায় ঠিক কতজন গ্রামবাসী, সাঁওতাল ও ওরাঁও সম্প্রদায়ের মানুষ শহীদ হয়েছিলেন তার তালিকা বের করা সম্ভব হয়নি।
হয়তো বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তাঁদের কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়।এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের মাঝে তাঁদেরটাও আছে।
তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানদের ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে।গভীর বেদনায় বলে আহারে আহারে।