দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি আলাদা হয়ে আছে অন্যদের থেকে। বিশেষ করে এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান অন্য দেশের জন্য যেমন চিন্তার বিষয় তেমনি প্রতিরক্ষার প্রশ্নে এর তাৎপর্যও ব্যাপক।
দেশভাগ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মত দুটি বড় ঘটনা দ্বারা এদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন হলেও সে সব ইতিহাস এখন বেশ পুরনো। তেমন পুরনো হয়েছিলো এদের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলির পারস্পারিক দ্বন্দ বা স্টেটের সাথে তাদের মুখোমুখি অবস্থান। যুদ্ধ মিটে গেছে সেই ৭১ সালে আর শান্তি চুক্তি ৯৭ সালে। কিন্তু বর্তমান সময়গুলিতে পাহাড়ে তীব্র অসন্তোষ এবং বিভিন্ন স্লোগান বা দাবী যেগুলি কিনা রাষ্ট্র-যন্ত্রের জন্য অস্বতিকর আমাদের সেই পুরনো বিষয় নিয়ে আবারো ভাবতে বাধ্য করছে। একদিকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের মারমুখী ভূমিকা আর পাহাড়ি সেটালার বিবাদ তার উপর রাষ্ট্রের নীরব ভূমিকা আমাদের নতুন চিন্তার পথে দিকে যেতে বাধ্য করছে। সুতরাং তার প্রেক্ষিতেই আজকের লেখা।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের হিসেব মোতাবেক বর্তমানে দেশের উপজাতির সংখ্যা ২৭ । (১)
বিগত সময়ে আমরা এই পরিসংখ্যান ব্যুরোকে নিজেদের প্রয়োজনেই এদের সংখ্যা বাড়াতে কমাতে দেখেছি। তেমন দেখছি কাউকে কাউকে বেমালুম ভুলে যেতে। সেসব কথা আজ থাক। আজ বরং আমরা মিযো নামের একক ক্ষুদ্র জাতিদের নিয়েই আলোচনা করি, যাদের নিয়ে বাংলায় আলোচনা হয়নি বললে হয়তো ভুল হবে কিন্তু যা হয়েছে তা যৎসামান্য। কিন্তু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের পলিটিক্যাল ভ্যালু আমাদের একসময় ভাবতে বাধ্য করেছিলো তাদের সম্পর্কে। বিশেষ করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, বহুমুখী সশস্ত্র তৎপরতা এবং পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার ফলে একাত্তরে আমাদের পাক বাহিনীর সাথে লড়তে হয়েছিলো মিযোদের সাথেও। সুতরাং বর্তমান সময়ের অস্থিরতা বুঝতে আমাদের এই অতীত জানা বা পর্যালোচনা ব্যাপক গুরুত্বের দাবী রাখে এবং ভূমিকা রাখে পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণ বুঝতেও।
যাইহোক বিস্তৃত ইতিহাস আলোচনায় আমারর দক্ষতা বা আগ্রহ কোনটাই নেই। সেসব ইতিহাসবিদের কাজ। দার্শনিক হেগেলের ভাষায় “নির্বোধরা ইতিহাস টেনে নিয়ে যায় আর বুদ্ধিমানরা ইতিহাসের গতিপথ অনুসরণ করে।” সুতরাং আজ আমরা ইতিহাসের সেই অস্থির গতিপথটিই অনুসরণ করবো।
মিযোদের নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তাদের বেশ পিছনে। উৎসের দিক দিয়ে মিযোদের যোগসূত্র মঙ্গোল জাতির সাথে। শান্তিপ্রিয় এই উপজাতিটিকে ধরা হয় মঙ্গোলদের কোন একটি শাখার ভগ্নাংশ। প্রথম কোথা থেকে কিভাবে এসেছিলো সেই নৃতাত্ত্বিক আলোচনা বাদ দিলে তাদের মুল আবাস হল লুসাই পাহাড়ের আশেপাশে। অবস্থানের দিক থেকে তারা বেশ ছাড়ানো ছিটানো স্বভাবের। বাংলাদেশ বার্মা আর ভারত এই তিন দেশেই তাদের বাস। সুতরাং সেই ইংরেজ আমল থেকেই তারা রাজনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৩৫ সালে দি স্টেটস অ্যাক্ট অব ইন্ডিয়া জারি করে তাদের গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলের অধীনে দিয়া দিয়া হয়। (২)। ধারনা করা হয় তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এটি করা হয়েছিলো।
১৯৪৫ সালের আগ পর্যন্ত এই এলাকায় রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পঁয়তাল্লিশ সালের দিকে এই ঘোষণা উইথড্রো করলে মিঃ চ সাংগ্রপ এর নেতৃতে মিযো ইউনিয়ন এবং লালমাভিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড মিযো ফ্রিডম অর্গানাইজেশন।
এর মধ্যেই হয়ে যায় দেশভাগ। সুতরাং পক্ষ বেছে নিতে হয় সবাইকে। প্রথমে মিযো ফ্রিডম অর্গানাইজেশন যোগাযোগ শুরু করে বার্মার সাথে (৩) কিন্তু বার্মা তাদের নিয়া তেমন উৎসাহ দেখায়নি। অপরদিকে মিযো ইউনিয়ন ছিল নিষ্ক্রয়। এরপর এক অভ্যন্তরীণ গোলাযোগে ভাগ হয় মিযো ইউনিয়ন। বিচ্ছিন্ন অংশ গঠন করে মিযো ইউনিয়ন কাউন্সিল। তারা বেশ জোরেশোরেই ভারতের সাথে যুক্ত হবার দাবী করে (৪)।
পরের ইতিহাসটা চিরায়ত ব্রিটিশ চরিত্রের ইতিহাস। মিযোদের ভাগ্য নিয়ে অনেক নাটকের পর অবশেষে সিধান্ত হয় তারা থাকবে ভারতের ইউনিয়ন হয়ে। তবে তা শর্তসাপেক্ষ দশ বছর পর চাইলেই আলাদা হতে পারবে।
পাঠক হয়তো ভাবছেন এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি কই? আছে দ্রুতই প্রবেশ করবো আমরা সেই অধ্যায়ে তবে সেটা ধাপে ধাপে। যাতে আমাদের বুঝতে কোন সমস্যা না হয় এই কৌশল।
১৯৬১ সালে ভারতীয় বাহিনীর একজন সাবেক হাবিলদার লালডেংগার নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গঠিত হয় মিযো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এম এন এফ নামে একটি সংগঠন। সাথে গঠিত হয় তাদের সশস্ত্র শাখাও(৫)। তখন সময়টা ছিল বেশ উত্তল। কমিউনিস্ট দুনিয়ার মহা-বিতর্কের কারণে সোভিয়েত আর চীন তখন বিপরীতমুখী অবস্থানে। সোভিয়েত শ্রমিক মালিক সাম্য অবস্থানের কিথা কথা বললেও চীন তখনো সরাসরি সশস্ত্র লাইনে। সুতরাং যেকোনো আর্মাড গ্রুপের জন্য তখন চীনা সাহায্য পাওয়া ছিল বেশ সহজ তার উপর যদি থাকে গায়ে বামপন্থি গন্ধ তাহলে তো কথাই নেই। সেটা এম এন এফের ছিলই সুতরাং তাদের চীনা সাহায্য পেতে বেগ পেতে হয়নি মোটেই। তার উপর ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্কের জন্য মিযো এই বিদ্রোহীদের চীন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দুটোই দিয়েছে বেশ আন্তরিকতার সাথে। (৬)
সে যাইহোক পাকিস্তানও ভারতকে শায়েস্তা করার এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায়নি মোটেই। তারাও সম্পর্ক গড়ে তোলে মিযো বিদ্রোহীদের সাথে। ফলে চট্টগ্রামের ভারতীয় সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল হয়ে উঠলো মিযো বিদ্রোহীদের অভয়ারণ্য। এম এন এফ এখানেই ঘাটি গড়ে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলো। আর বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গীয় রাজনীতিতেই তারা বেশ ভালোভাবেই প্রবেশ করলো।
এভাবে পাকিস্তানী সরকার লালডেংগা এবং মিযো বিদ্রোহীদের মদদ দেয়া শুরু করলো ভারতকে চাপে রাখতে। মাঝে অবশ্য ১৯৬৩ সালে লালডেংগাকে পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ করার অপরাধে গ্রেফতার করে ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু তার ফলে লাভ হয় লালডেংগারই ফিরে এসে তার কদর পাকিস্তানীদের কাছে আরও বেড়ে যায়। দ্রুতই মতিঝিলেই অফিস খুলে বসে মিযো ন্যাশনাল ফ্রন্টের অফিস।
আস্তে আস্তে ভারতের উপর চাপ বাড়াতে থাকে লালডেংগা এবং ১৯৬৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সাথে আলোচনায় সরাসরি স্বাধীনতার দাবী করে বসে তারা। ফলে ভারতের জন্য এই মাথা ব্যথাটি পরিণত হয় ক্যান্সারে। এ্যাকশন নেয়াটা যেন হয়ে দাঁড়ায় সময়ের দাবী। ১৯৭১ সালে ভারত যে কয়টি ডিপ্লোম্যাটিক কারণ বিবেচনায় আমাদের সাহায্য করছিলো তার মধ্যে এই মিযো বিদ্রোহী দমন ছিল অন্যতম।
মুক্তিযুদ্ধের সময়গুলিতে মিযো বিদ্রোহীদের অবস্থান ছিল পরিষ্কার। তারা সরাসরি বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলো। বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানী বাহিনী মেজর জিয়ার বিপরীতে নিজেরা না লড়াই করে মিযোদের মুখোমুখি করেছিলো।
একদিকে চিরশত্রু পাকিস্তান অন্যদিকে বিচ্ছিনতাবাদী মিযো বিদ্রোহীরা এই দুই শত্রুদের একই সাথে শিক্ষা দেয়ার লোভ ভারত সামলাতে পারেনি তাই মেজর উবানের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধাদের চট্টগ্রামে পাঠায় ভারত। নক্সাল বিদ্রোহীদের থেকে নাগা সকল বিচ্ছিনতাবাদীদের দমন করাই ছিল উবানের মুল দায়িত্ব (৭)
আবার লালডেংগায় ফিরে আসি। প্রথমে ছিলেন একজন হাবিলদার পরে হয়েছিলেন আসম সরকারের একজন সরকারি ক্লার্ক। শারীরিক কাঠামো বিবেচনায় একজন আদর্শ গেরিলা নেতাই ছিলেন লালডেংগা। অসীম সাহস আর নেতৃত্বগুণের জন্য একজন যোগ্য নেতা হতে সময় লাগেনি খুব বেশি। তার ব্যাপারে অনেক কথা প্রচলিত ছিল। কিছুটা সত্যি আর কিছুটা মিথ। একটা কথা ছিল লালডেংগার কোন স্থায়ী বন্ধু ছিলোনা। কিংবা দিনে দুইবার তিনি দেহরক্ষী বদল করতেন। আসমে তাকে নিয়ে উপন্যাসও লেখা হয়েছিলো যেখানে তাকে দেখানো হয়েছিলো দেবতা রূপে। বলা হয়েছিলো নবজাগরণের দেবতা(৮) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাঙ্গামাটিতেই সস্ত্রীক বসবাস করতেন। (৯) কেবল পাকিস্তান পতনের পর তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় দেশ ত্যাগ করেন।
লালডেংগার চরিত্রে বিপ্লবী ভাব থাকলেও তার বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী বহুল প্রচলিত। জাতিগত সাদৃশ্যের জন্য পাহাড়ি জনপদের মধ্যে তাদের বেশ আতিথেয়তা ছিল। পাহাড়িরা তাদের পথ দেখাতো। আবার সেই পাহাড়িদের মুরগি শুকর খেয়ে ফেলত মিযোরা। কখনো শোনা যায় পাহাড়ি মেয়েদেরও তারা নিয়ে যেত জোর করে (১০)
জাতিয়তাবদী লড়াইয়ে আদর্শের মিশ্রণ থাকলে যতটা সুযোগ নেয়া সম্ভব লালডেংগা তার সব টুকুই নিয়েছিলেন। বাংলার তৎকালীন বাম পুরোধার লালডেংগাকে বেশ সমীহা করতো। শুধু বামরা কেন জম্মু জাতিয়তাবাদের মহাপুরুষ শন্তু লারমার সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল গভীর(১০) এখন যদি কেউ বলেন শন্তু লারমা মিযোদের দেখেই সশস্ত্র অবস্থানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবেনা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় অনেক পালাবদলের পর লালডেংগা আবার ফিরে এসেছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে তিনি জিয়া সরকারের আমলে মিরপুরে একটি বাসায় থাকতেন(১১)
তবে যাইহোক সময়ের প্রয়োজনে আর রাজনৈতিক মেরুকরণে লালডেংগা সাথে মিযোরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমাদের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে বেশ শক্তভাবে। ইতিহাস পাঠ করলে নানা ভাবেই তারা চলে আসাকে
ও হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত লালডেংগা অস্ত্র ছেড়ে ডেমোক্রেসিতে গিয়েছিলেন। মিজোরাম রাজ্য হবার পর মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। এভাবেই সমাপ্ত হয়েছিলো মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট আর লালডেংগার গল্পটি। কিন্তু আমাদের পাহাড়ের রক্তক্ষরণের গল্পগুলি এখনো চলমান। বহু সমস্যার মাঝে আটকে আছে আমাদের আদিবাসীদের ভবিষ্যৎ। এতক্ষণ যাবত বলে আসা লালডেংগার গল্পটি হয়তো কারো কারো কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। হতেই পারে সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না কিন্তু এটাও সত্য যে বর্তমান পাহাড়ি সমস্যার সমাধান-কল্পে এটিই হতে পারে একটি কেস স্টাডি।
উৎস:
১। পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস রিপোর্ট ২০১১
২। দি স্টেটস এক্ট অব ইন্ডিয়া ১৯৩৫
৩। উবান, জেনারেল এস এস। ফ্যান্টমস অব চিটাগাং: ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, ঘাস ফুল নদী প্রকাশনী
৪। উবান, ঐ
৫। suhas chatterjee, making of mizoram: role of laldenga, new delhi
৬। মান্নান, প্রফেসর আব্দুল।”তাহলে এখন ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? “
৭। উবান, ঐ
৮। তালুকদার, মৃনাল। “মৌতাম “
৯। আহমেদ, মহিউদ্দিন।” অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ অবস্থার অবসান চাই” (প্রথম আলোঃ২-০৭-১৩)
১০। গেরিলা নেতা লালডেংগাঃ একটি ব্যক্তিগত কথন। সামহোয়ারইন ব্লগ
১১। রহমান, বিপ্লব।” একজন রিপোর্টারের ডায়রি”
১২। ফয়সাল বিন মাজিদ।” অশান্তির অপছায়া” (দৈনিক জনকণ্ঠঃ৩ এপ্রিল ২০১০)