ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ড:
১৭৯১ সালে সংবিধান-সভা বাতিল করার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে নতুন সংবিধান রচনা করা হয় । বুরবোঁ কবলিত শাসনব্যবস্থাকে নির্মূল করে নতুন চিন্তাচেতনায় সমাজ বিনির্মান করার জন্য জাতীয় সম্মেলনকে লক্ষ স্থির করতে হয় ।
এই বিপ্লব ছিলো নতুন চিন্তাচেতনা ও মতামত প্রতিষ্ঠার বিপ্লব ।বুরবোঁ রাজবংশের স্বেচ্ছাচারিতা এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো যে করের বোঝায় সাধারণ জনগণ অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণী স্বাভাবিক মত প্রকাশেও অক্ষম ছিলো । বাস্তুল দুর্গ পতনের সাথে সাথে এই বিপ্লব নতুন মাত্রা পায় । বাতিল হয়ে যায় সংবিধান-সভা । বুরবোঁ শ্রেণীর স্বার্থে স্থিত হয় জাতীয় সম্মেলন । ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত করে ষোড়শ লুইকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় । যদিও তাঁর প্রাণদণ্ডের ন্যায় চরম ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলো না জ্যাকোবিন দল । তবে জিরন্ডিস্ট দলের একগুঁয়েমির কারণে এহেন চরম দণ্ড কার্যকর করা হয় ।
জন-নিরাপত্তা সমিতি :
সংকটকালীন সময়ে জাতীয় সম্মেলনের নেতারা উপস্থিত অনুযায়ী বিপ্লব রক্ষার্থে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে । ঘোষণা করা হয় জরুরি অবস্থা । রদ করা হয় সংবিধান । আইনসভার সদস্যদের দ্বারা কয়েকটি সমিতি গঠন এদের হাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় । এই কমিটিগুলোর মধ্যে প্রথমটির নাম জন-নিরাপত্তা সমিতি ও দ্বিতীয় কমিটির নাম সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি । প্রথম সমিতির ৯ জন সদস্য জাতীয় সম্মেলন দ্বারা নির্বাচিত হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করত । দ্বিতীয় সমিতি পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলার কাজ দেখে । প্রতি-বিপ্লবী সন্দেহে বহু লোককে এই দুই সমিতি গিলোটিনে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে প্রতি-বিপ্লব দমন করা হয় ।
সন্ত্রাসের রাজত্বের জন্য প্রতিষ্ঠিত দুইটি সমিতির নিয়ন্ত্রণ ক্রমে রোবসপিয়ের বা Robespierre ও তার সহযোগী সাঁ জ্যুস্ত বা Saint Just এর হাতে চলে যায় । এই দুই প্রধানের তৃতীয় সহকারী ছিলেন ক্যুথন বা Cuthon । এই ত্রিমূর্তির স্বেচ্ছাচারী শাসনের চাপে বহু লোক সন্ত্রাসে প্রাণ হারায় । ঐতিহাসিক ডোনাল্ড গ্রীযারের মতে, সন্ত্রাসের বলি হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লোক । এ রাজত্বের শেষ দিককে বলা হয় মহাসন্ত্রাস । ১৭৯৩ সালের আগস্ট থেকে ১৭৯৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এই মহাসন্ত্রাস চালু ছিলো । মহাসন্ত্রাসের ফলে একদিকে যেমন প্রতি-বিপ্লব দমন করা হয়, অন্যদিকে বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায় । এসময় বৈদেশিক যুদ্ধে ফ্রান্স সাফল্য লাভ করে । মহাসন্ত্রাসের ফলে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের হাত থেকে বিপ্লব রক্ষা পায় । ঐতিহাসিক রাইকারের মতে, সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করে ।

জাতীয় সম্মেলনের সমাজতান্ত্রিক সংস্কার :
রোবসপীয়ারের নেতৃত্বে পুরাতন রাজ-কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে সাম্যবাদী চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হয় । সন্ত্রাসের শাসন ন্যাশনাল কনভেনশনের জ্যাকবিন দলের সদস্যরা মূল্যবান সংস্কার প্রবর্তন করেছিলেন । লেফেভারের মতে, ফরাসি বিপ্লবের ফলে মহত্তম অধ্যায় সৃষ্টি হয় এই পর্যায়ে । গণহত্যার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার কাজে কনভেনশন কাজ করে । কোব্বানের মতে, সন্ত্রাসের ফলে গোটা ফ্রান্সে বিপ্লবের পর কেন্দ্রীয সরকারের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় । ফেডারেলিস্টদের দমন করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কতৃত্ব বেড়ে যায় ।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইন দ্বারা কনভেনশন আদেশ দেয়, পুলিশ বিভাগ ভিন্ন সকল শ্রেণির কর্মচারী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সাধারণ নিরাপত্তা সমিতির নির্দেশ মেনে চলবে । অবাধ্য কর্মচারীদের জন্য প্রাণদণ্ডের বিধান রাখা হয় । এই আইন কার্যকর করার ফলে আপাতত ন্যাশনাল কনভেনশন সফলতা পায় এবং এই আইন কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতীয় সম্মেলন ফ্রান্সে ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব’ সম্পূর্ণ করে ।
জাতীয় সম্মেলনের পতন : থার্মিডরীয় প্রতিক্রিয়া
সন্ত্রাসের রাজত্বের মাত্রাহীন নিষ্ঠুরতা জাতীয় সম্মেলন ও জ্যাকোবিন দলের জনপ্রিয়তা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । মাদাম রোল্যান্ড, ড্যান্ডন প্রমুখ বিপ্লবীদের গিলোটিনে হত্যা করার ফলে জাতীয় জীবনে হতাশা সৃষ্টি হয় ।
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই জাতীয় সম্মেলনের সদস্যরা রোবসপীয়ের ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের গ্রেফতারের আদেশ দেয় । রোবসপীয়েরকে আত্মপক্ষ সমর্থনে সভাকক্ষে কথা বলতে দেওয়া হয় নি । প্যারিস ক্যামিউন রোবসপীয়ের সমর্থক জড় করতে ব্যর্থ হয় । পরবরর্তী সময়ে রোবসপীয়ের, সাঁ জ্যুস্ত, ক্যুথন ও ১৮ জন শীর্ষস্থানীয় জ্যাকোবিন দলের নেতাদের গিলোটিনে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় । এর একদিন পর আরও ৭০ জন প্যারিস ক্যামিউনের নেতার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় ।
রোবসপীয়েরের পতনের ফলে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে । জাতীয় সম্মেলন সন্ত্রাস রদ করার জন্য বিপ্লবী পরিষদ, গণনিরাপত্তা সমিতি ভেঙে দেয় । ফ্রান্সের জনমত সন্ত্রাসের বিপক্ষে গেলে, কনভেনশনের আদেশে সন্ত্রাস সম্পর্কিত সকল ব্যবস্থার লোপ করা হয় । তখন জাতীয় সম্মেলনে প্রধান্য বিস্তার করতে থাকে মধ্যপন্থী জিরোন্ডিস্ট দল । এর মধ্য দিয়ে জাতীয় সম্মেলন বৈপ্লবিক চরিত্র হারিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ।
থার্মিডরীয় প্রতি-বিপ্লবের ফলে জ্যাকবিন দলকে দমনের জন্য পাল্টা সন্ত্রাস আরম্ভ হয় । যদি জ্যাকোবিন দলের সন্ত্রাসকে “লাল সন্ত্রাস” বলা হয়, তবে এই প্রতি-বিপ্লবী সন্ত্রাস ছিলো “শ্বেত সন্ত্রাস” । এই সন্ত্রাসের ফলে জ্যাকোবিন ও সাঁকুলেৎ শ্রেণী নিহত হয় । দোকানের কর্মচারী ও বেকার যুবকদের সাহায্যে এক প্রতি-বিপ্লবী বাহিনী গঠন করা হয় যার চলতি নাম ছিলো মাস্কাদিন (Masscadin) । মাস্কাদিনদের মধ্যে এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গ্রামাঞ্চলে জ্যাকোবিনদের হত্যা করে । কিছুকাল পরে ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ থেমে যায় ।

ডাইরেক্টরীর শাসন (১৭৯৫-১৭৯৯)
রোবসপীয়েরের পতনের পর জাতীয় সম্মেলন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন সংবিধান গ্রহণ করে । এই সংবিধান অনুযায়ী যে নতুন সরকার গঠিত হয় তা ইতিহাসে ডাইরেক্টরীর শাসন নামে সমধিক পরিচিত ।
- এই নতুন সংবিধানে সরকারের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এক সমিতির হাতে দেওয়া হয় । নিম্ন পরিষদ ৫০ জন সদস্যের নামের একটি তালিকা উচ্চকক্ষে পাঠাতো । উচ্চকক্ষ সদস্যরা তার মধ্য থেকে ৫ জন সদস্যকে ডাইরেক্টর হিসেবে ৫ বছরের জন্য নির্বাচন করে । ডাইরেক্টর ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করতো । আইনসভা থেকে পাশকৃত আইন যথাযথ প্রয়োগ করা ছিলো তাদের দায়িত্ব ।
- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয় । এ আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হয় পাঁচশতের পরিষদ আর উচ্চকক্ষের নাম হয় প্রবীনদের পরিষদ । ডাইরেক্টরীর আইনসভার নির্বাচনে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার স্বীকৃত না হয়ে বরং সম্পত্তির ভিত্তিতে নিম্নকক্ষের সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা হয় । এর ফলে প্রকৃত গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয় । ধনী বুর্জোয়া শ্রেণী পুনরায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় । আইনসভার দুই কক্ষ থেকে প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ আসন শূন্য হলে নতুন সদস্য দ্বারা তা পূর্ণ করার ব্যবস্থা করা হয় । নতুন আইনসভা গঠিত হলে যাতে উগ্রপন্থী জ্যাকোবিনরা ঢুকে না পড়ে এই কারণে ন্যাশনাল কনভেনশনের ৫০০ সদস্যকে আইনসভায় আসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় । সংবিধানটি গণভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয় । মাত্র দুই লক্ষ লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সংবিধানকে কার্যকর করা হয় । প্যারিসের একটি সেকশন ভোটদানে বিরত থাকে । মূলত, এই সংবিধানের ত্রুটি ছিলো এই যে এই সংবিধান পুনরায় বুর্জোয়াদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে । এই সংবিধানকে তাই থার্মিডরীয় প্রতিক্রিয়ার সন্তান হিসেবে ধরা যায় । ফলে প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে মীমাংসার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না । এই কারণে সংকট দেখা দিলে ডাইরেক্টরীগণ বলপ্রয়োগের দ্বারা আইনসভার বিরোধী কোনো সদস্যদের বহিষ্কারের নীতি নেন । সংবিধানের এই দূর্বলতাই পরে ডাইরেক্টরীর পতন ঘটায় ।
- দ্বিতীয়ত, গণভোট-রদের ফলে সাধারণ লোক ডাইরেক্টরীর সংবিধানকে অবৈধ বলতে থাকে । ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্যারিসের সেকশনগুলো থেকে জনতা আইনসভা আক্রমণের চেষ্টা করে । এই বিদ্রোহে সেকশনগুলোর পক্ষে গণতন্ত্রীরাও যোগ দেয় । ২৫ হাজার লোক যারা আগে জ্যাকোবিনপন্থী ছিলো, আইনসভা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে যুবক সেনাপতি নেপোলিয়ন তাদের বিদ্রোহের পর রুদ্ধ করে দেন ।
ডাইরেক্টরীর পতন
ডাইরেক্টরী এভাবে বাম ও দক্ষিণপন্থীদের দমন করে একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে স্থিতিশীলতা আনয়নের চেষ্টা করে । এই সময় সেনাপতি পিশেগ্রুর নেতৃত্বে পুনরায় রাজতন্ত্রী বিদ্রোহ ঘটে । ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বহু রাজতন্ত্রী নির্বাচনে নির্বাচিত হয় । পাঁচ জন ডাইরেক্টরের মধ্যে অন্তত দুজন ডাইরেক্টর রাজতন্ত্রের সমর্থন ফ্রুক্তিদরের সন্ত্রাস সংঘটিত হয় যা ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ডাইরেক্টর সেনাপতি নেপোলিয়নের সহায়তায় দমন করা হয় । কর্নোৎ ও বার্থেলোমি বহিষ্কৃত হন এবং আইনসভার ১১৮ জন নবনির্বাচিত সদস্যকে বহিষ্কার করা হয় । এই সময় থেকে ডাইরেক্টরী ক্রমশ জনসমর্থন অপেক্ষা সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে । এভাবে এই সরকারের পতনের পথ প্রশস্ত হয় ।
ডাইরেক্টরীর পতনের কারণ:
প্রথমত, মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থ সংকটের কারণে ডাইরেক্টরীর বহু পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় ।
দ্বিতীয়ত, স্বভাবত বুর্জোয়া শ্রেণীর লোক ডাইরেক্টর থাকায় সাঁকুলেৎ শ্রেণীর প্রতি সদয় হতে ব্যর্থ হয়েছেন ।
তৃতীয়ত, সর্বসাধারণে ভোটাধিকার না থাকা । প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট ।
চতুর্থত, ডাইরেক্টরদের কলঙ্কজনক চরিত্র ।
পঞ্চমত, সামরিক শক্তির উপর নির্ভরতা ।
ষষ্ঠত, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের আকস্মিক উদয় ও তাঁর বিস্ময়করন সফল সমভিব্যাহার ।
ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল
রুশ বিপ্লব ছাড়া মানব জাতির ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের ন্যায় সুদূরপ্রসারী বিপ্লব আর ঘটে নি । “দানবীয় ঝাঁটার” ন্যায় এই বিপ্লব বহু পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে আঘাত করে নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে ।
১/ লোপ হয় সামন্ত প্রথা: মধ্যযুগ থেকে ফ্রান্সে অভিজাত ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো । অভিজাতরা প্রায়ই ফ্রাঙ্কিশ বিজেতাদের বংশধর দাবি করতো এবং তারা বিশেষ অধিকার ভোগ করতো বলে জমিদারি, সামন্ত কর, সরকারি চাকরির একাধিপত্য ভোগ করতো । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট ফরাসি বিধানসভা সকল প্রকার সামন্ত কর, সামন্ত স্বত্ব বিলোপ করে । দেশত্যাগী সামন্ত বা এমিগ্রিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ।
২/ স্বাধীন কৃষক শ্রেণীর উদ্ভব: সামন্ত প্রথা বিলোপের ফলে ফ্রান্সে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে । স্বাধীন কৃষক শ্রেণী বাজেয়াপ্ত করা ভূমি ক্রয় করে সম্পদশালী হয়ে ওঠে । এরাই গ্রামাঞ্চলের প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত হয় । এদের উপর শোষণমূলক টাইদ বা ধর্ম কর, কর্ভি বা বেগার প্রভৃতি কর প্রথা থেকে মুক্ত হয় । ভূমিদাস শ্রেণী মুক্ত হয় ভূমি দাস প্রথা থেকে । ব্যানালিতে বা সামন্ত কর, ম্যানর প্রথা লুপ্ত হয় । ফলে বহুলাংশ স্বাধীন জীবিকা গ্রহণ করে ।
৩/ সাঁকুলেৎ শ্রেণীর স্বার্থ উপেক্ষিত: ফরাসি বিপ্লব সাঁকুলেৎ শ্রেণীর কোনো উপকারে আসে নি । ‘ল অব ম্যাক্সিমাম’ ও ‘ল অব মিনিমাম’ দ্বারা কিছুদিনের জন্য তাদের উন্নতির চেষ্টা করা হলেও থার্মিডিরীয় শাসনামলে এই আইনগুলো রদের ফলে সাঁকুলেৎ শ্রেণীর দুরস্থা বিদ্যমান থেকে যায় । লেফেভারের মতে, সাঁকুলেৎ শ্রেণী জীবিকার অধিকার ও কাজের অধিকার প্রভৃতি যে সকল দাবি জানায় থার্মিডরীয় ফরাসি বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া নেতারা এই সকল দাবি পূরণ করতে অনিচ্ছুক থাকায় সাঁকুলেৎ শ্রেণীর স্বার্থ উপেক্ষিত হয় ।
৪/ বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা: ফরাসি বিপ্লবকে ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি ছিলো মূলত বুর্জোয়াদের জন্য বিপ্লব । ফলে উপেক্ষিত থাকে সাঁকুলেৎ শ্রেণীর স্বার্থ । একচেঁটিয়া অধিকার ভোগ করতে থাকে বুর্জোয়া শ্রেণী ।
৫/ বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা লোপ: ফরাসি বিপ্লব ছিলো বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে । সুতরাং এই বিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উপর থেকে আস্থা কমে আসে ।
৬/ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা: জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো প্রণীত সামাজিক চুক্তি (Social Contract) গ্রন্থে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা হয় ।
৭/ মানবতাবাদী ও উপযোগবাদী সংস্কার প্রবর্তন: ফরাসি বিপ্লবের ফলে মানবতাবাদী ও উপযোগবাদী সংস্কার প্রবর্তন করা হয় ।
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইতালির কর্সিকা নামক দ্বীপের আজাসিও (Ajacio) নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা কার্লো বেনাপোর্ট ও মাতা লেটিজিনা বোনাপোর্ট । বোনাপার্টের জন্মের কিছুদিন পূর্বে কর্সিকা দ্বীপটি ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত হয় । ফলে পরিণত বয়সে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন । প্রথম জীবনে তিনি ব্রিয়োন প্যারিসের সামরিক স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন । ইতিহাস, গণিত, যুদ্ধবিজ্ঞান ও সমকালীন দার্শনিকদের রচনা ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয় । ষোলো বছর বয়সে পিতৃহারা হন । সতেরো বছর বয়সে সামরিক বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশ বাহিনীকে Toulon বন্দর হতে বিতাড়িত করে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন । এটি তাঁর সামরিক জীবনে সর্বপ্রথম সাফল্য । ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্রীদের বিদ্রোহ দমন তিনি জাতীয় সম্মেলন বা ন্যাশনাল কনভেনশকে রক্ষা করেন । ডাইরেক্টরী শাসনকালে তিনি ইতালি অভিযানের সেনাপতি নিযুক্ত হন । ইতালি অভিযানের সাফল্য তাঁকে খ্যাতি ও গৌরবের উচ্চসীমানায় নিয়ে যায় ।

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্নীতিপরায়ণ ডাইরেক্টরীর পতন ঘটিয়ে ফ্রান্সে কনসুলেট নামে নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন । নতুন সংবিধান অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় তিন জন কনসালের উপর । সিয়াস, ডুকাস ও নেপোলিয়ানকে নিয়ে কনসুলেট গঠিত হয় । সংবিধানে নেপোলিয়ন প্রথম কনসাল হন এবং অপর দুজন তাঁর সহযোগী নিযুক্ত হন । প্রথম কনসালকে সকল ক্ষমতার অধিকারী, আইন প্রণয়ন ও সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয় । তিনি প্রথম কনসাল হিসেবে নতুন সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছিলেন সাইয়াসের উপর । সাইয়াস যে সংবিধান রচনা করেছিলেন তার মূল কথা হলো, ‘কতৃত্ব উপর তলার আর আস্থা নীচ তলার’। ফলে নতুন সংবিধান ছিলো গণতন্ত্রের আবরণে একনায়কতন্ত্র ।
প্রথম কনসাল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট । তিনি ফ্রান্সে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । অথচ বুরবোঁ রাজবংশের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিলো । এই কারণে অনেকে নেপোলিয়নকে ফরাসি বিপ্লবের মৃত্যুবাণ বলে মনে করেন । একথা সত্য যে তিনি প্রথম কনসাল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু নেপোলিয়নের আদর্শ ও লক্ষ্য ফরাসি বিপ্লবের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে ছিলো না । তাঁর মানসিকতা অতীতমুখী হলে তিনি বিপ্লবের যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ।
নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ স্বাধিকারবাদের বিরোধী ছিলেন । তিনি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন না । তিনি মনে করতেন রাজনৈতিক স্বাধিকারবাদ শক্তিশালী সরকার গঠনের পথে অন্তরায় । এই কারণে তিনি নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়ন প্রথা চালু করেছিলেন । আইনসভাকে সার্বভৌমিক ক্ষমতা হতে বঞ্চিত করেছেন । তিনি মূলত জ্যাকোবিন যুগের প্রজাতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ত্যাগ করেছিলেন । এদিক থেকে বিচার করলে তাঁকে বিপ্লবের বিনাশক বলা যেতে পারে । কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের মৈত্রী ও সাম্যবাদে তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো এবং তিনি সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই আদর্শ প্রতিফলিত করেছিলেন । তাঁর বিখ্যাত আইনবিধি (Code Nepoleon) সাম্যবাদের জ্বলন্ত নিদর্শন । তিনি বিশ্বাস করতে আইনের চোখে সকলে সমান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি । চাকুরি লাভের ক্ষেত্রে বংশগত পদমর্যাদার চেয়ে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে তিনি বড় করে দেখেছেন । পিতার সম্পত্তিতে সকল সন্তানের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি । তাঁর সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে রক্ষা করা হয় । তিনি বিপ্লবের বাণী ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছেন । এই কারণে অনেকে তাঁকে বিপ্লবের উত্তরাধিকারী বলে থাকেন ।
generic levofloxacin 500mg buy levofloxacin 500mg online cheap