আমাদের নাগরিক জীবনে আমরা প্রত্যহ নানান প্রতারণার স্বীকার হতে অভ্যস্ত। বিনা কারণেই আমাদের গুণতে হয় বাড়তি পয়সা। হোক সে মিনারেল ওয়াটার কিনতে কিংবা বাস ভাড়া পরিরোশোধের বেলায়। নানান সময়ই নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি খরিদ করতে হয় কিংবা বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে হয়; হোক সে সরকারি কিংবা বেসরকারি সেবা। প্রশ্ন চলেই আসে, রাষ্ট্রের কি এসব সমস্যা প্রতিকারে কোন দায়দায়িত্ব নেই? উত্তর হল আছে,আপনারা অনেকেই হয়ত “ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯” সমন্ধ্যে কিছুটা অবগত আছেন কিংবা যারা একদম জানেনই না তাদের জন্য আজকের এই লেখাটা। রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক এবং ক্রেতা হিসেবে আইনটি সমন্ধ্যে আমাদের জ্ঞান থাকা সকলের জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব ও এবং নিজের পয়সার যথাযথ মূল্য দিতে হলেও কর্তব্য বটে।

প্রথমেই জেনে নেয়া যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ইতিহাস। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে বহু পূর্বেই ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়িত হয়েছে। পণ্যের সেবা মান নিশ্চিতকরণ ও নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ লাঘবে ওই সকল দেশ সমূহের সরকার নির্ধারিত আইনের আওতায় নিয়ে এসেছেন পণ্য ও সেবার মান। আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯৪ সালে ইসা লিসবেক নামের এক মার্কিন নারীর শরীরে ম্যাকডোনাল্ডসের ৫০ সেন্টের কফি পড়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ছয় লাখ ডলার! শুধু স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কফি দেওয়ার অভিযোগে।(তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো,১৫ মার্চ,২০১৭)

Source: Google Play
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার আইনের উৎপত্তি সমন্ধ্যেও সাম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে জনগণের বহুল প্রতিক্ষীত জনবান্ধব আইন ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯’মহান সংসদে ২৬নং আইন হিসেবে পাশ করে। এই আইনের আওতায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সরকারের একটি প্রাধিকার কর্মসূচি । এ আইনের অধীন ২০০৯ সালে Quasi Judiciary বা আধা বিচারিক সংস্থা হিসেবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাঠ পর্যায়ে এ আইন বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একটি জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বচ্ছতা ও জবাবদাহিতা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানটি সদা সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ অধিদপ্তর ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিকার ও প্রতিরোধে নিয়মিত বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম ও অপরাধ দমনের পাশাপাশি গণসচেতনতা বৃদ্ধির্পূবক ভেজাল রোধ করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কোন পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারিত সংক্ষুদ্ধ ভোক্তা এ আইনের ধারা ৭৬(১) অধীন এ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হয়। এবং এই আইনের অধীনে সর্বনিম্ন পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।

আসুন এবার ভোক্তা অধিকার আইন সমন্ধ্যে জানা যাক এবং কিভাবে অভিযোগ করতে হবে তা আমি তুলে ধরবার চেষ্টা করব।ভোক্তা অধিকার আইনটি হুবহু বাংলাদেশ আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে বিশেষ বিশেষ দিক গুলো হুবহু তুলে ধরা হল।
প্রথমই নির্ধারণ করা যাক ভোক্তা কে।ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী “ভোক্তা” অর্থ এমন কোন ব্যক্তি,- যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূণ্য বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। যিনি ব্যবসায়ী বা সরবরাহকারী তিনিও একজন ভোক্তা।
অভিযোগের পরিসর গুলো নিন্মে তুলে ধরা হল।
“ভোক্তা–অধিকার বিরোধী কার্য“বলতে,-
(ক) কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(খ) জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(গ) মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্যপণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোন পণ্য বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(ঘ) কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা;
(ঙ) প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা;
(চ) কোন পণ্য সরবরাহ বা বিক্রয়ের সময়ে ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
(ছ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া;
(জ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
(ঝ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া;
(ঞ) কোন নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা;
(ট) মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা; বা
(ঠ) সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে পারে এমন কোন কার্য করা, যাহা কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে;
এখন তুলে ধরা যাক কিভাবে আপনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীনে মামলা করবেন।
- যেভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে:
*দায়েরকৃত অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে।
*ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েব সাইট, ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে; বাঅন্য কোন উপায়ে;
*অভিযোগের সাথে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রশিদ সংযুক্ত করতে হবে।
বিঃদ্রঃ অভিযোগকারী তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল নম্বর (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করবেন।
অভিযোগ ফর্ম ডাউনলোডের লিঙ্কটি সাথে সংযুক্ত করে দিলাম।
http://dncrp.portal.gov.bd/site/page/2e1c613d-e162-436c-b024-a0468fee2b6e/-অভিযোগ-দায়েরের-পদ্ধতি
“ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ“ এপ্টির সাধ্যমে অনলাইনে অভিযোগ প্রেরণের পদ্ধতি তুলে ধরা হলঃ

Source: Google Play


এছাড়াও খুব সহজে অনলাইনে মাত্র একটি এপ ব্যবহার করে আপনার অভিযোগটি পাঠিয়ে দিতে পারবেন। গুগল প্লে স্টোর থেকে “ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ” নামের এপটি ব্যবহার করে খুব সহজেই আপনার অভিযোগটি দাখিল করতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ ত্রিশ দিনের মধ্যে আপনার অভিযোগ সুরাহা করা হবে।প্রাথমিক তদন্ত করবে ভোক্তা অধিদপ্তর এবং তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে করা হবে মামলা। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয়। ধরুন, পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হলে অভিযোগকারী পাবেন তার ২৫ শতাংশ ; অর্থাৎ ১২৫০০ টাকা।

এই জরিমানা অর্জন করাই এই আইনের মুখ্য বিষয় নয় বরং ক্রেতা হিসেবে আমাদের প্রকৃত আধিকার আদায় করা। আমারা একটু সচেষ্ট হলেই বিক্রেতাদের বিপুল পরিমাণ জালিয়াতি আমরা রুখে দিতে পারবো।অবশ্য দিন দিন আইনটি জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাই সকলকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট হবার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
রেফারেন্সঃ
১. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট
২. আইন মন্ত্রণালয়ের আর্কাইভ
৩. বিভিন্ন পত্র পত্রিকার কলাম
buy levaquin 500mg online cheap levaquin 250mg over the counter