মুঘল আমলে সুবা বাংলার দায়িত্ব পাওয়া সুবাদারদের মধ্যে অনন্য কীর্তিতে উজ্জ্বল ছিলেন শায়েস্তা খান। তার জীবদ্দশায় তিনি দুই পর্বে বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একই সাথে সবচেয়ে বেশি সময় বাংলার সুবাদারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথম দীলির খান ও দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার রূপে বাংলাদেশ শাসন করেন। ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান সুবাদারের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন। ১৬৭৬ খৃস্টাব্দে উড়িষ্যা তার সুবেদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। টানা ১৪ বছর পর ১৬৭৮ সালে জাহাঙ্গীরের আদেশে এক বছরের জন্য তিনি দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। ১৬৭৯ সালে সেপ্টেম্বরে তিনি আবার দ্বিতীয়বারের কত বাংলায় ফিরে আসেন। যাহোক এক একবছর সময়টুকু বাদ দিলে শায়েস্তা খান প্রায় ২২ বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। শায়েস্তা খান একদিকে ছিলেন সুশাসক, অন্যদিকে একজন বিজয়ী যোদ্ধা ও নিপুণ নির্মাতা। ১৬৮৮ খৃস্টাব্দের জুন মাসে এইই শাসব দিল্লির উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় শায়েস্তা খানের সোনালি যুগ।
শায়েস্তা খানের পরিচয় ও প্রাথমিক জীবনঃ
শায়েস্তা খান ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত আসফ খানের পুত্র। আসফ খান ছিলে সম্রাট শাহজাহানের প্রধানমন্ত্রী। শায়েস্তা খানের প্রকৃত নাম ছিল আবু তালিব। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে শায়েস্তা খান পদে ভূষিত করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় তিনি বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। এত পূর্বেই তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ও যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
সুবেদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কার্যাবলীঃ
শায়েস্তা খান তার শাসনামলে নানান উল্লেখযোগ্য কার্যাবলী সম্পাদন করে যা তাকে বাংলা তথা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন দান করেন। তার কার্যাবলী সমূহ নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হল।
প্রথমত, কুচবিহারের বিদ্রোহ দমনঃ
মীরজুমলার আমলে কুচবিহার প্রথম মুঘল শাসনের অধীনে আসে। এখানে ইসফান্দিয়ার নামে একজন প্রতিনিধিকে অস্থায়ী ফৌজদার নিয়োগ করা হয়। মীর জুমলার আদেশে এখানে দিল্লির মডেলের রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করা হয়। ফলে স্থানীয় জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মীরজুমলা কর্তৃক রাজ্যচ্যুত রাজা নারায়ণ পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেড়িয়ে স্থানীয়দের নিয়ে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীরা মুঘলদের খাদ্য সরবরাহ করার পথ বন্ধ করে দিলে ইসফান্দিয়ার অসুবিধায় পড়ে সায় এবং বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে রাজধানী থেকে সটকে পড়েন। শায়েস্তা খান এসে রাজা নারায়ণকে সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করেন এবং ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে শায়েস্তা খানকে সন্তুষ্ট করেন। পরবর্তীতে অবশ্য শায়েস্তা খানকে আবার কুচবিহার আক্রমণ করতে বাধ্য হন।
দ্বিতীয়, চট্টগ্রাম জয় ও মগ বিতাড়নঃ
বাংলাদেশ থেকে মগ দস্যুদেরকে বিতাড়ন ও চট্টগ্রাম জয় শায়েস্তা খানের অনন্য কৃতিত্ব। পূর্বে চট্টগ্রাম আরাকান রাজের শাসনাধীন ছিল। ১৬১৭ খৃস্টাব্দে আরাকান রাজা পর্তুগিজদের নিকট থেকে সন্দ্বীপ কেড়ে নেন। ফলে ঢাকা অঞ্চল পর্যন্ত মগ দস্যুদের আক্রমণের আওতায় চলে আসে। মগদের সাথে পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিরা একসাথে মিলে দস্যুবৃত্তি শুরু করে। এই জলদস্যুরা নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে যেত এবং দাস হিসেবে ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রি করে দিত। এই সংকট নিরসনে শায়েস্তা খান জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শায়েস্তা খান বহু রণতরী নির্মাণ করেন এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আরও রণতরী সংগ্রহ করেন। মোটামুটি ৩০০ রণতরী সংগ্রহ করে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
এরমধ্যেই একটি ঘটনা ঘটে যায়। একজন প্রাক্তন মুঘল নৌ অধ্যক্ষ দিলিয়ার আরাকানীদের নিকট থেকে সন্দ্বীপ ছিনিয়ে নিয়ে নিজের শাসন বলবত করেন। ১৬৬৫ সালের নভেম্বরর শায়েস্তা খান ইবনে হোসেনকে সেনাপতি করে সন্দ্বীপ প্রেরণ করেন। তিনি সন্দ্বীপ আক্রমণ করে দিলিয়ার থেকে সহজেই তা ছিনিয়ে নিয়ে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। এই সময়ে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। মগ ও পর্তুগীজদের মধ্য বিবাধ বেধে যায়। ফিরিঙ্গিরা মগদের সাথে দ্বন্দ্বের পর চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালীতে অবস্থান গ্রহণ করেন। শায়েস্তা খান এই সুযোগে ফিরিঙ্গিদের সাথে আতত করেন এবং তার নৌ শক্তি বৃদ্ধি করেন।
ডিসেম্বরে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম অভিযানের জন্য বিশাল নৌ বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হন। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান এর নেতৃত্ব দেন। শায়েস্তা খানের ২৮৮ রণতরীর সাথে ফিরিঙ্গিদের আরো ৪০টি রণতরী যুক্ত হলে বিশাল বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি মুঘল বাহিনী ফেনী নদী পার হয়ে নদী-জঙ্গল কেটে অগ্রসর হতে থাকে। কুমিল্লার কাথালিয়া খালে যখন মুঘল বাহিনী পৌঁছালো তখনই মগদের থেকে প্রথম প্রতিরোধ আসে। ২৩-২৪ জানুয়ারি কাথালিয়া খালের নিকট দুই পক্ষের যুদ্ধ হয় এবং মগরা এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মগরা কোন উপায় না দেখে কর্ণফুলী নদীতে পালায়ন করেন। মুগরা পিছু হটলেও একদম হাল ছেড়ে দেয়নি। মুঘলদের প্রতিরোধের জন্য কর্ণফুলী নদীতে তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। একই সাথে আরেক মুঘল সেনাপতি ইবনে হোসেন মগদের আচমকা আক্রমণ করে বসেন। মুঘলদের গোলাগুলিতে মগদের বেশ কয়েকটি জাহাজ ডুবে যায়। মূলত এই যুদ্ধ জাহাজগুলোই ছিল মগদের প্রধান শক্তি। মগরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং তাদের ১৩৫ টি রণতরী মুঘলদের হস্তগত হয়। বিজয়ী মুঘল নৌ-সেনাপতি নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ করেন। এসময় যে মগরা বেঁচে ছিল তারা নিরুপায় হয়ে ইবনে হোসেনের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
১৬৬৬ খৃস্টাব্দে ২৭ জানুয়ারি বিজয়ী মুঘল সেনাপতি উমেদি খান চট্টগ্রাম দুর্গে প্রবেশ করেন। ২০০০ মগ মুঘলদের হাতে বন্দী হয়। মগ জলদস্যুরা কয়েক হাজার বাঙালি কৃষক বন্দী করে দাস বানিয়েছিল,মুঘলরা চট্টগ্রাম দখলের পর এরা মুক্তি পায়। চট্টগ্রাম মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং একজন ফৌজদার শাসন গ্রহণ করেন। এই চট্টগ্রামকেই শায়েস্তা খান নাম বদলে রাখেন ইসলামাবাদ।
তৃতীয়ত,ইংরেজ বণিকদের সংঘর্ষঃ
শায়েস্তা খানের শাসনামলের শেষ দিকে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বিরোধ বাঁধে। ইংরেজরা ১৬৫১ সালে সুজার সময় হুগলীতে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। মাত্র তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে তারা সমগ্র বাংলায় বাণিজ্য করত। ফলে এই সুযোগ নিয়ে কোম্পানির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠে। স্থানীয় ও অন্যান্য বহিরের বাণিজ্যিক দেশসমূহ ইংরেজদের সাথে পেরে উঠছিলনা। আর আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় এসে ইংরেজদের এই বিশেষ সুযোগ তুলে নেন এবং শতকরা ৩.২৫ টাকা ধার্য করেন। ফলে ইংরেজরা সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়। এরপরই কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের সাথে শায়েস্তা খানের সাথে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। ১৬৮৬ সালে ইংরেজরা শক্তি বৃদ্ধিকল্পে সৈন্য সহ কয়েকটি জাহাজ ভারতে আনয়ন করে। চতুর মানুষ শায়েস্তা খানও তার বিরুদ্ধে জবাব দিতে উদ্যত হন। স্থানীয় ফৌজদারও সুবেদারের জন্য সৈন্য সমাবেশ ঘটান।
যাহোক বাজারে তিনজন ইংরেজ সৈন্য আক্রান্ত হলে ইংরেজরা তার সমুচিত জবাব দিতে এগিয়ে আসে কিন্তু ফৌজদার গনি তা প্রতিরোধ করে কুঠিতে আগুন লাগিয়ে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। তাদের জাহাজেও গোলাবর্ষণ করে ডুবিয়ে দেয়া হয়। যদিও তৎক্ষণাৎ ইংরেজ বিশাল বাহিনী যুক্ত হলে গণিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইংরেজরা তখন শহরে কিছু লুটতরাজ করে পালিয়ে যায়। যদিও শায়েস্তা খানের নতুন অশ্বারোহী দল ইংরেজদের ধাওয়া করে কিন্তু এর আগেই তারা হুগলি থেকে সুতানটি সটকে পড়ে। জব চার্নক দিশেহারা হয়ে সুতানটি থেকে হিজলায় পালায়ন করে এবং সেখান থেকে বলেশ্বর আক্রমণ করে মুঘল দুর্গ হস্তগত করে। শায়েস্তা খান হিজলী থেকে ইংরেজ বিতাড়িত করতে আব্দুস সামাদকে দিয়ে ১২০০০ সৈন্য মোতায়েন করেন। মুঘল আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ইংরেজরা আশপাশ অঞ্চল লুট করে পালাতে চেষ্টা করে। এমন সময় ইংরেজদের মধ্যে ম্যালেরিয়া ও খাদ্যের অভাব দেখা দিলে অনেক ইংরেজ সৈন্য মারা যায়। মাত্র একশত সৈন্য বেঁচে ফিরেছিল। পরে অবশ্য তারা ১৬৮৮ তে আবার বলেশ্বরে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করেন। পরে ইংরেজরা চট্টগ্রাম দখলের উদ্দেশ্যে মাদ্রাজ চলে যায়। আর জুলাইতে শায়েস্তা খানও দিল্লিতে বদলি হয়ে চলে যান। এভাবেই সমাপ্ত হয় এক সুবেদারের শাসনের গল্প।
স্থাপত্য শিল্পে শায়েস্তা খানঃ
বাংলার ইতিহাসে সফল নির্মাতা হিসেবে শায়েস্তা খানের খ্যাতি রয়েছে। রাজধানী ঢাকাকে তিনি পরিকল্পনামতো সাজাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সময়ে নির্মিত মসজিদ, সমাধি ও অতিথিশালা ছোট কাটরা সুবাদারের কীর্তি প্রচার করছে। শায়েস্তা খান ছোট কাটরা নির্মাণ করেন ১৬৬৪ সালে। কাটরা এলাকায় এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি ছোট আকারের মসজিদ রয়েছে। শায়েস্তা খান নির্মিত এই মসজিদ চমৎকার কারুকার্য খচিত।
তিনি মিটফোর্ড থেকে লালবাগ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরে বাঁধ নির্মাণ করেন ও তার নামে সেখানে মসজিদ তৈরি করেন। শায়েস্তা খানের একজন পালিত কন্যা ছিলেন বিবি চম্পা। বিবি চম্পার সমাধিও রয়েছে কাটরা প্রাঙ্গণে। লালবাগ দুর্গ নির্মাণের সঙ্গেও শায়েস্তা খান যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও মোহাম্মাদপুরে অবস্থিত সাত গম্বুজ মসজিদও তার সময়ে নির্মিত হয়েছিল। যাহোক ১৬৯৪ সালে এই মহান সুবেদার মারা যান। যার কাছে বাংলাদেশ আজীবন কৃতজ্ঞ।
রেফারেন্সঃ
১. বাংলাদেশের ইতিহাস, ডাঃ আব্দুর রহিম।
২. বণিক বার্তা
৩.ধানফুল.কম
purchase semaglutide pill – order rybelsus 14 mg generic order desmopressin sale
repaglinide 1mg drug – repaglinide 2mg canada buy empagliflozin paypal