কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের প্রবাদপুরুষ
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী মুসলিম দেশ তুরস্ক। মুসলিম দেশ শুনেই অধিকাংশ মানুষের মনে যে শব্দ গুলো ভেসে উঠে তা হল শরিয়াতের আইনে দেশ শাসন কিংবা আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত নারী ও পাঞ্জাবী পরিহিত পুরুষ মানুষ, ধর্মীয় স্কুল কিংবা আদালত ইত্যাদি। কিন্তু তুরস্কে গেলে এর কোনটাই আপনার চোখে পড়বেনা। বরং চোখে পড়বে বেশিরভাগ নারীই স্বল্প বসনা, পশ্চিমা পোশাক পরিহিত পুরুষ ও ধর্মনিরপেক্ষ সকল প্রতিষ্ঠান। মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও আজকের তুরস্ক কে একটি উন্নত, ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলার যিনি অগ্রনায়ক তিনি হলেন কামাল আতাতুর্ক।
কামাল আতাতুর্ক যার অর্থ ‘তুর্কি জাতির জনক কামাল’ সেই মহান ব্যক্তির আসল নাম হল মুস্তফা কামাল, তিনি মুস্তফা কামাল পাশা নামেও পরিচিত। একাধারে একজন সৈনিক, রাষ্ট্রনায়ক ও সংস্কারক কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। তিনি তুরস্কের আইন ও শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন সাধন করেন এবং সেখানে ইউরোপীয় জীবনধারাকে স্বাগতম জানান। এমন কি ল্যাটিন অক্ষরে তুরস্ক লেখা এবং ইউরোপিয়ান ঘরানার নামকরণের প্রথাও চালু করেন তিনি।
জন্ম ও শিক্ষাজীবনঃ
তিনি ১৮৮১ সালে তৎকালীন অটোম্যান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী একটি বন্দর সালনিকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর নাম দেয়া হয় মুস্তফা। তাঁর পিতা আলী রিজা ১৮৭৭-৭৮ সালে সংঘটিত হওয়া রুশ-তুরস্ক যুদ্ধের সময় স্থানীয় সামরিক বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তাঁর মাতা যুবাইদা হানিম পশ্চিম সালনিকার একটি কৃষক পরিবারের মেয়ে ছিলেন। মুস্তফার বয়স যখন মাত্র ৭ বছর তখন তাঁর পিতা মারা যান কিন্তু তা সত্বেও তিনি পুত্রের ব্যক্তিত্ব গঠনে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। আলী রিজা পুত্রের দোলনার উপর নিজের তলোয়ার ঝুলিয়ে রেখেছিলেন এবং সামরিক বাহিনীতে তাঁকে যোগ দেয়ার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। এমনকি মুস্তফা যেন তাঁর শিক্ষাজীবন আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কোন স্কুলে শুরু করে সে ব্যাপারটাও তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যদিও তাঁর স্ত্রী যুবাইদা চেয়েছিলেন পুত্রকে ধর্মীয় স্কুলে পড়াতে। এভাবেই শৈশবকালেই আলী রিজা পুত্র মুস্তফাকে আধুনিকায়নের পথে হাঁটা শুরু করিয়েছিলেন এবং এর জন্য মুস্তফা বরাবরই নিজের পিতার কাছে ঋণী বলে মনে করতেন।
আলী রিজার মৃত্যুর পর যুবাইদা হানিম সালনিকা থেকে দূরে তাঁর সৎ ভাইয়ের কাছে চলে যান। কিন্তু তাঁর ছেলে মূর্খ হবে এই চিন্তা থেকে তিনি মুস্তফা কে আবারও সালনিকায় পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন যেন তাঁর পুত্র আমলাতান্ত্রিক পেশায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। মুস্তফা প্রতিবেশী সামরিক শিক্ষানবিস দের পোশাকের প্রতি আসক্ত হয়ে যান এবং সিদ্ধান্ত নেন সামরিক বাহিনী তে যোগ দেয়ার। মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন মিলিটারি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য।
মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে তাঁর গণিত শিক্ষক তাঁর ডাকনাম দেন ‘কামাল’ যার অর্থ ত্রুটিহীন ব্যক্তি এবং এরপর থেকেই তিনি মুস্তফা কামাল নামে পরিচিতি পান। ১৮৯৫ সালে তিনি মনাস্তির মিলিটারি স্কুলে যোগ দেন এবং সেখানে অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয় তাঁর যার মধ্যে আলী ফেতিহ ওকিয়ার ও ছিলেন যিনি পরবর্তীতে তাঁকে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠন ও উন্নয়নে সহায়তা করেন। মনাস্তিরে পড়াশুনা শেষ করে মুস্তফা কামাল ১৮৯৯ সালে ইস্তানবুলের ওয়ার কলেজে ভর্তি হন। ইস্তানবুলের স্বাধীনতা ও বাস্তববাদিতা তাঁকে মুগ্ধ করে এবং সেখানে তিনি তাঁর আরেক বন্ধু আলী ফাউত এর সাথে পরিচিত হন। ঐ সময় ওয়ার কলেজে অনেকেই সুলতান আব্দুল হামিদ (২) এর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করছিলেন। মুস্তফা ৩য় বর্ষে উঠা পর্যন্ত এইসব থেকে দূরেই ছিলেন। কিন্তু ৩য় বর্ষে পড়া চলাকালীন তিনি একটি গোপন পত্রিকার সাথে কাজ করা শুরু করেন। তাঁর এইসব গোপন কার্যক্রম প্রকাশও পেয়ে যায় কিন্তু তাঁকে পড়াশুনা শেষ করার সুযোগ দেয়া হয়। ১৯০২ সালে তিনি তাঁর ক্লাসের ৪৫০ জনের মধ্যে দশম হয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে বের হন। এরপর তিনি জেনারেল স্টাফ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৫ সালে ৫৭ জনের মধ্য থেকে পঞ্চম হয়ে অন্যতম সেরা সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
সেনাবাহিনীতে তাঁর জীবনকালঃ
ওয়ার কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার অল্প কিছু সময় পরই সামরিক বাহিনীতে মুস্তফা কামালের অবস্থান হারানোর মত পরিস্থিতি হয়েছিল যখন তিনি ও তাঁর কিছু বন্ধুর সুলতান আব্দুল হামিদ (২) এর বিরুদ্ধে ‘যুবক তুরস্ক’ নামে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সেই ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায়। একজন সরকারি গুপ্তচর তাদের দলে বন্ধু সেজে ঢুকে এইসব তথ্য সংগ্রহ করে এবং ফাঁস করে দেয়। মুস্তফা ও তাঁর বন্ধুদের মাথার উপর সন্দেহের মেঘ জমে ছিল বেশ কয়েক বছর। তাদের সব বন্ধুদের আলাদা করে ফেলা হয় একে অন্যের থেকে এবং একেক জনকে একেকটি প্রত্যন্ত এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয় বদলি করে। মুস্তফা এবং ফাউত কে বদলি করা হয় দামাস্কাসে এবং সেখানে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা স্থানীয় লোকজনের সাথে যে রকম আচরণ করছিল সেটা মুস্তফা কে খুব ক্রুদ্ধ করে তুলে। তিনি তখন আবারও সরকার বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং স্বল্প মেয়াদি একটি গোপন দল তৈরি করেন যার নাম ছিল ‘ সোসাইটি ফর ফাদার এ্যান্ড ফ্রিডম’।
যাই হোক ১৯০৭ সালে মুস্তফার উপর থেকে সন্দেহের তীর তুলে নিয়ে তাঁকে বিশ্বস্ত ঘোষণা করা হয় এবং তাঁকে পুনরায় সালনিকায় বদলি করে পাঠানো হয়। মুস্তফা যখন সালনিকায় ফেরত আসেন তখন সেটি বিধ্বংসী কার্যকলাপে প্লাবিত একটি অঞ্চল ছিল। এইসব দেখে তিনি আরও প্রভাবশালী সরকার বিরোধী দল ‘ কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস’ এ যোগ দেন যাদের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল জাতীয়তাবাদী ও সংস্কারবাদী ‘যুবক তুরস্ক’ এর সাথেও।
১৯০৮ সালের জুলাই মাসে মেসিডোনিয়ায় বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে সুলতান আব্দুল হামিদ (২) বাধ্য হন ১৮৭৬ সালে সংবিধান পুনর্বহাল করতে যা সুলতানের ক্ষমতা কে সীমিত করে দেয় এবং পুনরায় প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা চালু করে। তবে মুস্তফা কামাল এককালে যে ‘যুবক তুরস্ক’ বিপ্লবের সাথে যুক্ত ছিলেন সেই বিপ্লবের নেতা এনভার পাশার সাথে তাঁর সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়ে যায় এবং এনভার পাশাই পরে মুস্তফার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষে পরিণত হন।
১৯০৯ সালে বিপ্লবী দল গুলো দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল চেয়েছিল বিকেন্দ্রীকরণ এবং মুসলিম ও অমুসলিম তুরস্ক নাগরিক দের মধ্যে ঐকতান ও পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখতে। কিন্তু ‘কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস’ এর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী রা চেয়েছিল কেন্দ্রীভূত তুরস্ক শাসন। ১৯০৯ সালের ১২-১৩ এপ্রিল রাতে প্রগতিবিরোধী রা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। এর ফলে ১৯০৮ সালের বিপ্লব সংবিধানের যে পুনর্বহাল হয়েছিল সেটা ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। সেনা কর্মকর্তা এবং সৈনিকরা মিছিল করতে করতে ইস্তানবুলের দিকে আগাতে এগোতে থাকে যার নেতৃত্বের পদে ছিলেন এনভার। তাঁরা ২৩ এপ্রিল সকালে রাজধানীতে পৌঁছান এবং পরের দিন সকালেই সব পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ‘কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস’ আব্দুল হামিদ কে বাধ্য করে পদত্যাগ করতে।
এইভাবে এনভার বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। মুস্তফা কামাল উপলব্ধি করেন যে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে কিন্তু তাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত। তাই তিনি আহ্বান জানান যে সকল সামরিক কর্মকর্তা রাজনীতিতে যোগ দিতে চান তাদের চাকরি থেকে পদত্যাগ করা উচিত। তাঁর এই প্রস্তাবের পর এনভার ও ‘কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস’ উভয়ই তাঁর আরও বেশি শক্তিশালী শত্রুতে পরিণত হয়। তাই তিনি রাজনীতি থেকে সরে এসে সামরিক বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। তিনি জার্মান পদাতিক বাহিনীর ম্যানুয়াল টি তুরস্ক ভাষায় অনুবাদ করেন। এমনকি তুরস্ক সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতিরও সমালোচনা করেন। যার ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করে ফেলেন। এই খ্যাতির বদৌলতে তিনি নতুন ও কম বয়সী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেও বেশ পরিচিতি পান এবং অনেক অনুজ কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর ভাল সখ্যতা গড়ে উঠে যারা পরবর্তীতে তুর্কি জাতি গড়ে তুলার সময় তাঁর সহযোগী হিসেবে যোগ দেন।
মুস্তফার উপর বিরক্ত হয়ে ‘কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস’ তাঁকে প্রথমে ফ্রান্সের পিকার্দিতে পাঠায় সেখানকার ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের কলা কৌশল পর্যবেক্ষণ করার জন্য, এরপর ১৯১১ সালে লিবিয়ায় ইতালিয়ান আক্রমণ এর খবর শুনে তিনি সেখানে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন ও তাঁর দৃষ্টিশক্তিতে কিছু সমস্যা হওয়ায় তাঁকে দ্রুত ভিয়েনায় চলে যেতে হয়। প্রথম বলকান যুদ্ধের সময় তিনি গাল্লিপলি উপদ্বীপের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু মাত্র ২ মাসের মধ্যে অটোম্যান সাম্রাজ্য ইউরোপে মনাস্তির, সালনিকা সহ তাদের বেশিরভাগ জায়গা হারিয়ে ফেলে। ফলে প্রচুর শরনার্থী এসে জমা হতে থাকে ইস্তানবুলে যার মধ্যে মুস্তফার মা,ভাই, বোন ও সৎ বাবাও ছিলেন।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সময় অটোম্যান সাম্রাজ্য আবারও তাদের হারানো জায়গা ফেরত পেতে থাকে। মুস্তফার স্কুলজীবনের বন্ধু আলী ফেতিহ কে রাষ্ট্রদূত করা হয় এবং তাঁকে তাঁর বন্ধুর সাথে সহদূত করে সোফিয়ায় পাঠানো হয়। সোফিয়ায় গিয়ে তাঁর পদোন্নতি হয়ে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন।
১৯১৬ সালে তাঁকে রাশিয়ান সম্মুখে পাঠানো হয় যেখানে গিয়ে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তাঁকে পাশা নাম টাও দেয়া হয়। কেননা তিনিই ছিলেন প্রথম তুরস্ক জেনারেল যে রাশিয়ার সাথে লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি দক্ষিন-পূর্ব আনাতোলিয়ার দখল নেন এবং সেখানে তাঁর পরিচয় হয় কর্নেল ইস্মাতের সাথে যিনি পরবর্তীতে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠনে তাঁর অনেক বড় একজন মিত্র ছিলেন।
আতাতুর্কের ক্ষমতা দখলঃ
১৯২০ সালে যুদ্ধপরবর্তী একটি শাস্তিমূলক চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তিরা অটোম্যান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে সব আরব রাজ্য গুলো ছিনিয়ে নেয়, আর্মেনিয়া কে স্বাধীন রাষ্ট্র ও কুর্দিস্তান কে স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, বর্তমান ইজমিরের আশেপাশের অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব গ্রিস কে দিয়ে দেয় এবং বাকি যতটুকু ছিল তার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়ে নেয়। যাইহোক ইতোমধ্যে মুস্তফা কামাল আঙ্কারা ভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক শক্তির দখল থেকে তুরস্ক ভাষাভাষী অঞ্চল গুলোর মুক্তি এবং এই অঞ্চল গুলোর বিভক্তি রোধ করা। সুলতানের সরকার তাঁকে এবসেনশিয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় কিন্তু এত কিছু সত্বেও তিনি সেনাবাহিনী এবং সাধারণ জনগণের মনে তাঁর জন্য সমর্থন নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে আর্থিক ও অস্ত্রের দিক থেকে সাহায্য পেয়ে তাঁর সৈন্যদল পূর্ব দিকে আর্মেনিয়ান দের চূর্ণ করে দেয় এবং দক্ষিণ থেকে ফ্রান্স ও ইতালিকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এরপর তিনি নজর দেন গ্রিসের দিকে যারা আঙ্কারার তুর্কিদের উপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে মুস্তফা কে সেনাবাহিনীর প্রধান করে তাঁর সৈন্যরা সাকারিয়ার যুদ্ধে গ্রিসকে প্রতিহত করে। এরপর মুস্তফা হুমকি দেন ইস্তানবুল আক্রমণ করার যেটা তখন বৃটিশ ও মিত্রদেশের দখলে ছিল। কিন্তু বৃটিশ রা কোন গণ্ডগোলে না জড়িয়ে ইস্তানবুলে সুলতানের সরকার এবং আঙ্কারার মুস্তফা সরকার উভয় পক্ষের কাছেই আমন্ত্রন পাঠায় শান্তিপূর্ণ সমঝোতা চুক্তির জন্য। কিন্তু শান্তি চুক্তির আলোচনা শুরুর আগেই আঙ্কারার জাতীয় সংসদ ঘোষণা দেয় যে সুলতানের সরকারের পতন হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। অটোম্যান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট নিজের প্রাণের ভয়ে একটি বৃটিশ এ্যাম্বুলেন্সে করে নিজ বাসভবন থেকে পালিয়ে যান। এরপর ১৯২৩ সালের জুলাইতে একটি নতুন শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটাতে তুরস্ক কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঐ বছরের অক্টোবরেই আঙ্কারার মহান জাতীয় সংসদ তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয় এবং মুস্তফা কামাল পাশা কে তাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রেসিডেন্ট আতাতুর্কঃ
আতাতুর্ক প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থেকেই গ্রিস প্রস্তাব করে আসছিল ৩৮০,০০০ মুসলিমদের তুরস্কে ফেরত দেয়ার তার বিনিময়ে ১ মিলিয়ন সনাতন গ্রিক ধর্মাবলম্বী দের কে ফেরত চায়। মুস্তফা কামালের শাসনামলেও আর্মেনিয়ানদের কে জোরপূর্বক দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তুরস্ক মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্বেও মুস্তফা খলিফা কে পদচ্যুত করেন, দেশে সকল প্রকার ধর্মীয় আদালত ও স্কুল, সরকারি কর্মচারীদের মাথায় হিজাব পড়া বন্ধ করে দেন এবং কামান আইন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিষয়ক মন্ত্রণালয় উঠিয়ে দেন। ইসলামিক ক্যালেন্ডারের বদলে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন, মদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন, শুক্রবারের বদলে রবিবার কে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেন, এমনকি তিনি আযান ও আরবি ভাষায় না দিয়ে তুর্কি ভাষায় দেয়ার নিয়ম করেন এবং ফেজ টুপি পড়া নিষিদ্ধ করেন। এক কথায় বলতে গেলে মুসলিম প্রধান একটি দেশের প্রেসিডেন্ট এবং নিজেও একজন মুসলিম হওয়া সত্বেও মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তাঁর সমসাময়িক অন্য শাসক দের তুলনায় একটু বেশিই আধুনিকতার পথে হেঁটে ছিলেন।
তাঁর শাসনামলে তুরস্কে ব্যাপক শিল্পায়ন সাধিত হয় এবং তিনি ইউরোপীয় আদলে আইন প্রণয়ন করেন। ১৯২৬ সালে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন ‘ সভ্য দুনিয়া থেকে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। তাই তাদের কে ধরা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই’। এর আট বছর পর তিনি তুরস্কের সবার জন্য নামের সাথে পদবী ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেন। ঐ সময় তুরস্ক সরকার লিগ অব ন্যাশনে যোগ দেয় এবং স্বাক্ষরতার হার বাড়ায় ও নারীদের ভোটাধিকার দেয়। যদিও তুরস্কে তখন একদল কেন্দ্রীক সরকারই ছিল। এছাড়াও তিনি বিরোধী সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেন, বামপন্থী সকল সংগঠন বন্ধ করে দেন এবং কুর্দিস্তানের স্বায়ত্বশাসিত করার সকল চেষ্টা মূলেই ধ্বংস করে দেন।
১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর নিঃসন্তান মুস্তফা কামাল ইস্তানবুলে তাঁর দলমাবাছে প্রাসাদের নিজ শয়নকক্ষে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আতাতুর্ক শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী ইস্মাত ক্ষমতায় আসেন। ইস্মাতও আতাতুর্কের দেখানো পথে ধর্মনিরপেক্ষ ও পাশ্চাত্য ঘরানাতেই শাসন করেছেন তুরস্ক। এমনকি এখন পর্যন্তও মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের আইকনিক ব্যক্তিত্ব, বরং তুরস্কে তাঁর অবদান অস্বীকার করা বরং অপরাধ বলে গ্রাহ্য হয়।
rybelsus 14 mg price – glucovance price desmopressin uk