পৃথিবীতে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে, যা রূপকথাকেও হার মানায়। তেমনি একটি চমকপ্রদ ঘটনা হচ্ছে “ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা” বা “ভাওয়াল কেস”। মূলতঃ আইন ও ফরেনসিকের আলোচ্য বিষয় হলেও নিঃসন্দেহে এটি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি।
কাহিনীর নায়ক ভাওয়াল রাজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। তিনি ছিলেন তৎকালীন ভাওয়াল পরগনার জমিদার রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র। এই রাজেন্দ্রনারায়ণের এক পূর্বসূরি জয়দেব রায়ের নাম অনুসারেই ভাওয়াল পরগনাকে জয়দেবপুর বলা হয়।
যা-ই হোক, ১৯০১ সালে রাজেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয় এবং রাণী বিলাসমণি জমিদারির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ১৯০৭ সালে বিলাসমণির মৃত্যু হলে তিন পুত্রের উপর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু বৈষয়িক ব্যাপারে কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের আগ্রহ ছিলো না। বেশিরভাগ সময় তিনি শিকার, মদ্যপান ও নারীসঙ্গ নিয়ে মেতে থাকতেন। বিবাহের পরেও তিনি একাধিক নারীসঙ্গ ত্যাগ করতে পারেন নি। একারণে স্ত্রী বিভাবতী দেবীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিলো না। পতিসঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে বিভাবতী দেবী পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্তের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি জানাজানি হলে ভাইদের পরামর্শে রমেন্দ্রনারায়ণ বিভাবতী দেবীকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন।
কাকতালীয়ভাবে একই সময় কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের সিফিলিস ধরা পড়ে এবং এক পর্যায়ে যৌনাঙ্গে দগদগে ঘা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশগুপ্ত উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে দার্জিলিং যাওয়ার পরামর্শ দেন। ১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে ডাক্তার আশুতোষ, স্ত্রী বিভাবতী দেবী ও শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দার্জিলিং গমন করেন। সেখানেই মে মাসের ৭ তারিখ মাত্র ২৫ বছর বয়সে কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের আকস্মিক মৃত্যু হয়। তড়িঘড়ি করে পরদিনই দার্জিলিংয়ে তাঁর শবদাহ করা হয়। মে মাসের ১১ তারিখ বিভাবতী দেবী তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও ডাক্তার আশুতোষকে নিয়ে জয়দেবপুরে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে মেজকুমারের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাক্তার আশুতোষ পিত্তথলির পাথরকে দায়ী করেন। যদিও ঐসময় গুজব রটে যে, রমেন্দ্রনারায়ণকে দাহ করা হয় নি। তিনি বেঁচে আছেন এবং সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কুমারের বোন জোতির্ময়ী ছাড়া আর কেউ বিষয়টা পাত্তা দেয় নি।
পরবর্তী ১০ বছরে রমেন্দ্রনারায়ণের অন্য দুই ভাইয়েরও মৃত্যু হয়। ফলে তিন কুমারের বিধবা স্ত্রীদের উপর জমিদারির মালিকানা অর্পিত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের আইন অনুযায়ী স্ত্রীদের পক্ষে কোর্ট অব ওয়ার্ডস জমিদারি দেখাশোনার ভার নেয়। নিঃসন্তান বিভাবতী দেবী তাঁর ভাইয়ের সাথে ঢাকায় চলে আসেন এবং জমিদারির আয় থেকে নিয়মিত ভাতা গ্রহণ করতে থাকেন।
কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের আকস্মিক মৃত্যুর এক যুগ পরে আসল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকার তৎকালীন বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে সর্বাঙ্গে ছাই মাখা এক সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে। তিনি চার মাস ধরে সেখানকার রাস্তায় বসে থাকেন। স্থানীয়রা এই অদ্ভুত সাধুর ব্যাপারে কৌতুহলী হন এবং তাঁকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। অনেকেই বলতে শুরু করেন, কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ফিরে এসেছেন। কিন্তু সন্ন্যাসী নিজের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁকে হাতির পিঠে চড়িয়ে জয়দেবপুর পাঠিয়ে দেয়। সেখানে রাজপরিবারের নিকটাত্মীয়রা তাঁকে দেখে রমেন্দ্রনারায়ণ বলে দাবী করেন। কিন্তু রমেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বিভাবতী দেবী সে দাবী নাকচ করে দেন এবং সন্ন্যাসীকে ভন্ড ও প্রতারক বলে অভিহিত করেন। ফলে ২৫ এপ্রিল সন্ন্যাসী আবার ঢাকা ফিরে যান। কিন্তু ৩০ এপ্রিল রাজপরিবারের অনুরোধে তিনি আবারো জয়দেবপুর ফিরে আসেন। এবার কুমারের বোন জোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীর সাথে দীর্ঘক্ষণ পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে রমেন্দ্রনারায়ণ বলে দাবী করেন। তখন প্রজা ও রাজপরিবারের চাপে সন্ন্যাসী জনসমক্ষে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। তিনি দাবী করেন, দার্জিলিংয়ে তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও পারিবারিক ডাক্তার ষড়যন্ত্র করে খাবারে বিষপ্রয়োগ করেছিলো (সম্ভবতঃ আর্সেনিক)। বিষক্রিয়ার কারণে তাঁর প্রচণ্ড পেটব্যথা, রক্তবমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। একসময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন (সম্ভবতঃ কোমায় চলে যান)। তখন আশুতোষবাবু তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন এবং ঐ রাতেই তড়িঘড়ি করে তাঁর দেহ দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচন্ড শিলাবৃষ্টির কারণে দাহ না করেই ডোমের দল পালিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে ঐপথ দিয়ে যাওয়ার সময় একদল নাগা সন্ন্যাসী বৃষ্টি ও কাদায় মাখামাখি অবস্থায় কুমারকে খুঁজে পায় এবং শুশ্রূষা করে চেতনা ফিরিয়ে আনে। কিন্তু বিষের প্রভাবে তাঁর স্মৃতিভ্রম ঘটে এবং আত্মপরিচয় সম্পূর্নরূপে ভুলে যান। ফলে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে নাগা সন্ন্যাসীগুরু ধর্মদাসের সাথে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এক যুগ পর স্মৃতি ফিরে পাওয়ায় গুরুর পরামর্শে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর এ বক্তব্য অন্যরা বিশ্বাস করলেও বিভাবতী দেবী ও তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ তা নাকচ করে দেন। ফলে অপারগ হয়ে সন্ন্যাসী আইনের শরণাপন্ন হন।
১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল জমিদারির এক-তৃতীয়াংশের অধিকার দাবী করে সন্ন্যাসীর পক্ষের আইনজীবীগণ বিভাবতী দেবী ও অন্য দুই কুমাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। বিচারপতি পান্নালাল বসুকে মামলার প্রধান বিচারক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৩ সালের ৩০ নভেম্বর মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা এই মামলায় সন্ন্যাসীর পক্ষে ১০৬৯ জন এবং বিপক্ষে ৪৭০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়। দুই হাজারেরও বেশি ফটোগ্রাফ, চিঠিপত্র ও প্রামাণ্য দলিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের সাথে সন্ন্যাসীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য পরীক্ষা করা হয়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে রমেন্দ্রনারায়ণের গায়ের রঙ, চুলের রঙ ও ধরণ, গোঁফ, চোখের রঙ, ঠোঁট ও কানের আকৃতি, কানের লতির ফুটো, কণ্ঠমণি, মাড়ির ভাঙা দাঁত, হাতের আকার, আঙুলের আকৃতি, চোখের আঁচিল, পায়ের ক্ষত, জুতার সাইজ, সিফিলিস ও এর ক্ষতচিনহ, কুঁচকিতে অপারেশনের দাগ, ডান বাহুতে বাঘের থাবার দাগ, হাঁটার ধরণ, কথা বলার ভঙ্গি ইত্যাদির সাথে সন্ন্যাসীর হুবহু মিল পাওয়া যায়। আঙুলের ছাপের মাধ্যমে শনাক্তকরণ পদ্ধতি তখন চালু থাকলেও কুমারের আঙুলের ছাপ সংগ্রহে ছিলো না বলে প্রমাণ হিসেবে তা ব্যবহার করা যায় নি। অবশেষে হাউজ অব ওয়ার্ডসের চাপ অগ্রাহ্য করে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণাদির ভিত্তিতে ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি পান্নালাল বসু বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এ যুগান্তকারী রায় প্রদানের পরপরই তিনি বিচারকের পদ থেকে অবসর নেন।
আদালতের রায়ে সন্ন্যাসী রমেন্দ্রনারায়ণের সম্পত্তির ভাগ থেকে টাকা তোলার অনুমতি পান। কিন্তু শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ এতোদিন ধরে মৃত কুমারের যে জীবনবীমার টাকা ও লক্ষাধিক টাকার বাৎসরিক জমিদারি ভাতা আত্মসাৎ করেছেন, সেগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সন্ন্যাসী কুমারের সম্পত্তি হতে অর্থগ্রহণ স্থগিত রাখেন। এ সময় তিনি পুনরায় বিয়ে করেন। এদিকে বিভাবতী দেবী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টে আপিল করেন। ফলে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর তিন জন বিচারকের সমন্বয়ে মামলার বিচারকার্য আবারো শুরু হয়। প্রায় দুই বছর পর ১৯৪০ সালের ২৯ আগস্ট আপিল নাকচ করে দেয়া হয় এবং আগের রায় বহাল রাখা হয়। উচ্চ আদালতে বিফল হয়ে বিভাবতী দেবী হাউজ অব ওয়ার্ডসের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে পুনরায় আপিল করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধব্বংসযজ্ঞের মধ্যেই মামলার বিচারকাজ চলতে থাকে এবং ২৮ কার্যদিবসের শুনানির পরে ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই আপিল নাকচ করে দিয়ে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখা হয়। এর ফলে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা এ চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। অবশ্য সন্ন্যাসী তাঁর সম্পত্তির অধিকার ভোগ করে যেতে পারেন নি। চূড়ান্ত রায়ের পরদিন সান্ধ্যআনহিকের সময় তাঁর স্ট্রোক হয় এবং এর ২ দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিভাবতী দেবী সন্ন্যাসীর এই আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনাকে “ঐশ্বরিক শাস্তি” বলে অভিহিত করেন। অবশ্য সন্ন্যাসীর মৃতদেহের ফরেনসিক পরীক্ষার পরে আর কোনো সন্দেহই রইলো না যে, ইনি সত্যিই কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়! পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বিভাবতী দেবীর বক্তব্য যদিও জানা যায় নি, কিন্তু তিনি পরবর্তীতে ভাওয়ালের জমিদারি থেকে ভাতা নিতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে অমোঘ মৃত্যু দীর্ঘ ২৫ বছরের বিতর্কের অবসান ঘটালো; রবীন্দ্রনাথের সেই গল্পের মতো—“কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই!
তথ্যসূত্রঃ Essentials of Forensic Medicine, by K.S.N. Reddy; A Princely Imposter?, by Partha Chatterjee; https://en.wikipedia.org/wiki/Bhawal_case