অপরাজেয় আততায়ী আতিলা

0

“আতিলা দ্য হান” ( রাজত্বকাল ৪৩৪-৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) হান নামক পরিচিত যাযাবর গোষ্ঠীর নেতা এবং তার নিজের প্রতিষ্ঠিত হানিক সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। আতিলার নামের অর্থ দাঁড়ায় “ছোট বাবা” এবং কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে এটি তার জন্মগত নাম নয় বরং তাকে সম্মান প্রদর্শন করে এই নামে ডাকা হতো। তার শত্রু ও যেসকল এলাকা তিনি দখল করেছিলেন সেখানকার সাধারণ মানুষের কাছে আতিলা একটি বিভীষিকার নাম ছিল।

আতিলার জার্মানি আক্রমণের ফলে সেখানকার ব্যাপক জনসাধারণ সীমানা পেরিয়ে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে এবং তারা ৫ম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভিসিগোথদের ব্যাপক পরিমাণে সীমানা অতিক্রম বিশেষ করে পরবর্তীতে রোমের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহের ঘটনাকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে মূল কারণ বলে মনে করা হয়।

৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আদ্রিয়ানো পোলের যুদ্ধে ভিসিগোথদের কাছে রোমানদের এমন পরাজয় হয়েছিল যে এরপরে রোমান সেনাবাহিনী আর কখনো সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। এ ঘটনা হান এবং ভিসিগোথ জনগোষ্ঠীকে একত্র হয়ে রোমান সাম্রাজ্য অপহরণে অনুপ্রাণিত করে। রোমানদের এই ভগ্নাবস্থার সুযোগ নিয়ে আতিলা হানদের নেতা হবার পর পরই কোনোরকম হিসাব নিকাশ ছাড়াই ৪৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমানদের সাথে করা চুক্তি (মার্গাসের চুক্তি) ভঙ্গ করে রোমানদের ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। আতিলার হাতে একের পর এক রোমান শহর, নগর ধ্বংসের ঘটনায় এটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রোমান সেনাবাহিনী আগের মত সেই জৌলুসপূর্ন পরাক্রমশীল বাহিনী ছিল না।

আতিলা দ্য হান
আতিলা দ্য হান
Source: Ancient History Encyclopedia

প্রাথমিক জীবন ও ক্ষমতায় আরোহণ

আতিলার জন্ম এবং মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে বিশদ তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার জন্ম এবং জন্মস্থান সম্বন্ধে ইতিহাসে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। যদিও এখন কোথাও কোথাও তার মায়ের নাম হাঙ্গুসাং ভ্লাদিসার্ফ বলা হয়ে থাকে কিন্তু আসলে তা অজানা এবং এমনকি আতিলার প্রকৃত নামও জানা যায়নি এখন পর্যন্ত। তার বাবার নাম ছিল মান্দযুক এবং তার চাচা রুগিলা (রুয়া বা রুগা নামেও পরিচিত) হানদের রাজা ছিলেন।

ছোটবেলাতেই আতিলা এবং তার বড় ভাই ব্লেদা (বুদা নামেও পরিচিত) খুব ভালো ভাবে যুদ্ধ বিদ্যা, তীর ধনুক চালানো এবং অশ্বারোহণের শিক্ষা লাভ করেন। ভবিষ্যতে রোমান এবং গোথদের সাথে যেন ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে সেজন্য তাদের ল্যাটিন এবং গোথিক ভাষার শিক্ষাও দেওয়া হয়। তার শৈশবের বর্ণনার বিষয়ে ঐতিহাসিক মতানৈক্য রয়েছে, অনেক ইতিহাসবেত্তাই মনে করেন তার শৈশবের কোন তথ্য ইতিহাসের কাছে নেই এমন কি জন্মস্থান, প্রকৃত নামও ।

আতিলার চাচা রুগিলার পরে সিংহাসনে আরোহণের মতো তার কোন পুত্র ছিলনা এবং যেহেতু তার ভাই মান্দযুক আগেই মারা গিয়েছিলেন তাই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে আবির্ভূত হন তার ভাত্রুষ্পুত্র আতিলা এবং তার বড়ভাই ব্লেদা। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা এবং বিভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্যই তাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে সহায়তা করে। দুই বালককেই তাই ছোটবেলা থেকেই হানদের যুদ্ধ কাউন্সিলে রেখে যুদ্ধের নানা কলাকৌশল শেখানো হয়। আতিলা শাসক হওয়ার আগেও হান সেনাবাহিনী খুব ভালো যোদ্ধা ছিল যদিও পরবর্তীতে আতিলা ক্ষমতায় এসে তাদের সক্ষমতা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলেন।

যুদ্ধের ময়দানে আতিলা
যুদ্ধের ময়দানে আতিলা
Source: Fans Share

৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের অভিযানে রুগিলার মৃত্যু হলে হান গোষ্ঠীর নেতৃত্ব আতিলা এবং ব্লেদার হাতে চলে যায়। ল্যানিং এর মতে “আতিলা বংশীয়ভাবে একজন যোদ্ধা ছিলেন যার জন্য তার প্রতিবেশীদের মূল্য দিতে হয়েছে দীর্ঘসময় ধরে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যকে দিতে হয়েছে প্রায় একশ বছর ধরে। রোমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত রুগার অভিযান এতোটাই ফলপ্রসূ ছিল যে রোমানদের নিজেদের ভূমিতে বাস করার জন্য হানদের নিয়মিত কর পরিশোধ করতে হত।”

৪৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আতিলা এবং ব্লেদা রোমানদের সাথে করা মার্গুস চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের আক্রমণ করেন। এই চুক্তি ততদিন ছিল যতদিন রোমানরা হানদের নিয়মিত কর পরিশোধ করত। এই চুক্তি অনুসারে রোমানদের আতিলা এবং ব্লেদাকে প্রতিবছর ১০০ পাউন্ড করে স্বর্ণ কর হিসেবে দিতে হত। এবং এই স্বর্ণ করের বিনিময়ে তারা (রোমানরা) হান আক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকত।

আতিলার প্রারম্ভিক শাসন ও অনোরিয়ার প্রস্তাব

যদিও ইতিহাসের বেশীরভাগ অংশ জুড়ে আতিলাকে হত্যাকারী, ঘোড়ার পিঠের বর্বর যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে কিন্তু আসলে তার অনেক গুণাবলিও ছিল। রোমান লেখক প্রিসাস যিনি আতিলার আতিথ্য গ্রহণ করে তার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করেছেন তার বর্ণনা অনুযায়ী অন্তত তেমনই জানা যায়। আতিলা প্রসঙ্গে প্রিসাসের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পরবর্তীতে ইতিহাসবেত্তা উইল ডুরান্ট জানান, আতিলা বিভিন্ন যুদ্ধে যে তরবারি ব্যবহার করতেন তা আসলে রোমান যুদ্ধ দেবতা মার্সের যিনি আতিলাকে সেটি উপহার দিয়েছিলেন।

আতিলা রোমকে দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করতেন সেজন্য ৪৪৬ অথবা ৪৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি আবার মোয়েসিয়া অঞ্চল (বলকান অঞ্চল) আক্রমণ করেন এবং প্রায় ৭০ টির মতো নগর ধ্বংস করেন ও ব্যাপক সংখ্যক যুদ্ধবন্দী করে তার বুদার (সম্ভবত বর্তমানে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট) দুর্গে নিয়ে আসেন। তিনি অপরাজেয় চরিত্রের ছিলেন এবং ডুরান্টের ভাষ্যমতে,

“পূর্বের বুকে ছুরিকাঘাত শেষ হলে আতিলা পশ্চিমের দিকে অযৌক্তিক যুদ্ধাকাংক্ষা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন।”

আতিলার সাম্রাজ্য
আতিলার সাম্রাজ্য
Source: Great Military Battles

৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টিনিয়ানের বোন অনোরিয়া পরিবারের ঠিক করা রোমান সিনেটর পাত্রের সাথে বিয়ের পিঁড়ি থেকে পালানোর ফন্দি করে নিজের হাতের আংটি দিয়ে আতিলার কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। যদিও আতিলাকে পাঠানো চিঠিতে অনোরিয়া তাকে বিয়ের কোন ইচ্ছা পোষণ করেননি কিন্তু আতিলা অনোরিয়ার আংটি এবং সাহায্য প্রার্থনা দেখে মনে করেছিলেন এটি একটি বিয়ের প্রস্তাব এজন্য তিনি চিঠির উত্তরের সাথে বিয়ের বাগদান উপহার হিসেবে অনোরিয়ার কাছে অর্ধেক রোমান সাম্রাজ্যের সম্পদ প্রেরণ করেন।

ভ্যালেন্টিনিয়ান যখন আসল ব্যাপার বুঝতে পারেন তখন তিনি আতিলার কাছে তার ভগ্নির কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি লিখে জানান যে, অনোরিয়ার চিঠিতে বিয়ের কোন প্রস্তাব ছিলনা বরং এটি একটি ভুল বুঝাবুঝি এবং তিনি আতিলাকে তার প্রেরিত সম্পদ ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান। আতিলা ভ্যালেন্টিনিয়ানের যুক্তি শুনতে অস্বীকৃতি জানান ও অনোরিয়াকে নিজের স্ত্রী হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেন এবং স্ত্রী উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে শুরু করেন।

আতিলার দরবার
আতিলার দরবার
Source: Monólogo Interativo

গাল আক্রমণ

৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে আতিলা প্রায় ২০০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে রাজ্য জয়ে বের হন। তার বাহিনী অনায়াসেই গালিয়া বেলজিকা (বর্তমানে বেলজিয়াম) দখল করে লুটপাট করে। সে সময় আতিলা শুধুমাত্র সাসানিদ বিজয় করা থেকে বিরত থাকেন এবং অপরাজেয় আততায়ী হিসেবে তার কুখ্যাতিই তাকে গালের দিকে ধাবিত করে। সেখানে গিয়ে আতিলার বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হানরা পূর্বেই অপরাজেয় জঘন্য হত্যাকারী হিসেবে তার যে পরিচিতি পেয়েছিল তার যথার্থ প্রমাণ রাখে। তারা সামনে যাকেই পেয়েছে কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই কচু কাটার মতো শুধু হত্যা করে গিয়েছে।

ইতালি আক্রমণ

জীবনের খুব কম যুদ্ধেই আতিলা হেরেছিলেন অনেক জয়ের পর তিনি আক্রমণ করায় ক্ষান্ত দিলে রোমানরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেদের ঘরে এই ভেবে ফিরতে শুরু করে যে আতিলা হয়ত আর কাউকে কিছু বলবেন না। কিন্তু ৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে আতিলা হঠাৎ আবার তার অবস্থান বদলে ফেলেন এবং তার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া স্ত্রীকে (অনোরিয়া) খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগে আবারও ইতালি আক্রমণ করেন। গালের মতো ইতালির একুইলেইয়া শহরে তার বাহিনী এতো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় যে যুদ্ধ শেষে সেই শহরের আসল অস্তিত্ব আর খুঁজেও পাওয়া যায়নি। হান বাহিনীর আক্রমণের মুখে সেই শহরের বাসিন্দারা যে যেখানে পেরেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটেছিল এবং এভাবেই একটি সাধারণ জলাভূমি থেকে আজকের বিখ্যাত ভেনিস শহরের গোড়াপত্তন হয়।

ইতালি আক্রমন
ইতালি আক্রমন
Source: YouTube

শেষ জীবন এবং মৃত্যু

আতিলা শেষ জীবন পর্যন্ত অনোরিয়ার কথা স্মরণ রেখেছিলেন এবং তিনি সারাজীবন ইতালির কাছে হয় তার স্ত্রী অথবা তার প্রেরিত উপঢৌকন ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন এবং ৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ইল্ডিকো নামের একজন নতুন, কম বয়সী, সুন্দরী স্ত্রী বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত অস্বাভাবিক খাদ্য ও মদ্যপান করেন তিনি এবং পরদিন সকালে ফুলশয্যাতেই নতুন বউয়ের পাশে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ

১. www.britannica.com/biography/Attila-king-of-the-Huns

২. www.ancient.eu/Attila_the_Hun/

৩. www.biography.com/people/attila-the-hun-9191831

৪. www.history.com/news/history-lists/8-things-you-might-not-know-about-attila-the-hun

৫. www.ancient-origins.net/history-famous-people/end-huns-death-attila-and-fall-hunnic-empire-007740

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More