মাওলানা ভাসানী: গণ মানুষের নেতা
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতের স্বনামধন্য ধর্ম গুরু এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিপীড়িতদের সাথে সংহতি এবং একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে গ্রাম ভিত্তিক রাজনিতির সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারত সময় থেকে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সময় পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মেয়াদ বিস্তৃত ছিল। কৃষক এবং শ্রমিক শ্রেণির অধিকার ও স্বার্থ নিয়ে আজীবন কাজ করে যাওয়া মহান এই নেতার জীবনের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে সাজানো আজকের আয়োজন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ছিলেন শরাফত আলী খানের পুত্র। ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাগ্রহণ করেন তিনি। ১৯০৯ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে ময়মনসিংহ জেলার কালা (হালুয়াঘাট) গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তখন থেকেই ভাসানী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হতে শুরু করেন।
রাজনীতিতে প্রবেশ
১৯১৯ সালে ভাসানী অসহযোগ আন্দোলন এবং খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাঁর বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। বাংলায় মহা দুর্যোগের সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষে যান এবং দরিদ্র নিপীড়িত চাষীদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৩০ সালে টাঙ্গাইল থেকে আসামের ঘাগমারায় যান সেখানকার বাঙ্গালিদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে নেতা হিসেবে তিনি প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। সেখানকার বাঙালি বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তিনি সেখানে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন যে বাঁধের ফলে সাধারণ কৃষকেরা প্রতিবছর বন্যার আক্রমণ থেকে সুরক্ষা লাভ করতো। পুনঃ পুনঃ ঘটে যাওয়া বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণে এর নেপথ্যে থাকা মানুষটিকে স্থানীয় লোকেরা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ “ভাসানী সাহেব” বলে ডাকা শুরু করে, যার ফলে তখন থেকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান নামের সাথে ভাসানী যুক্ত হয়।
আসাম সরকার বাঙালি বাসিন্দাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিসীমা বেঁধে দিয়ে আইন পেশ করে, যার কারণে যেসব বাঙালি আসামে অবস্থান করছিল তারা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়। এই আইনের কারণে স্থানীয়রা আসামে বসবাসরত বাঙ্গালিদের উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লাগে। ১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং আসাম ইউনিট এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্থানীয় এবং বাঙ্গালিদের মাঝের এই “পরিসীমার” বিষয়ে আসামের চীফ মিনিস্টার স্যার মুহাম্মাদ সা’দউল্লাহ্র সাথে ভাসানীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি হয়। দেশ বিভাজনের সময় নির্দিষ্ট পরিসীমার বিরুদ্ধে কৃষকদের জড় করতে ভাসানী অবস্থান করছিলেন আসামের গোয়ালপাড়া জেলায়। আসাম সরকারের নির্দেশে ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৪৭ সালের শেষে এই শর্তে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে একেবারে চলে যাবেন।
১৯৪৮ সালের শুরুতে মাওলানা ভাসানী পূর্ব বঙ্গে এসে আবিষ্কার করেন যে তাঁকে প্রাদেশিক নেতৃত্ব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এই কারণে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ভাসানি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী এবং জমিদার খুররাম খান পান্নিকে হারিয়ে প্রাদেশিক সভায় দক্ষিণ টাঙ্গাইলের আসনে জয়লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং জুনের ২৩ এবং ২৪ তারিখে নেতৃত্ব নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। জুনের ২৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দলটি ১ম বারের মত চালু করেন। এখানে তিনি ছিলেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে পুলিশের গুলিতে ছাত্রদের মৃত্যুতে ভাসানী তৎকালীন সরকারের পাশবিকতার বিপরীতে শক্ত অবস্থান করেন। ২৩ তারিখ তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামীলীগের সভাপতি হওয়ার ফলে যুক্ত ফ্রন্ট গঠনে মাওলানা ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্ট ২২৩ টি আসন লাভ করে যেখানে মুসলিম লীগ লাভ করে মাত্র ৭ টি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাসানী
মাওলানা ভাসানী আইয়ুব সরকারকে সাম্রাজ্যবাদী সরকার হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে করা আগরতলা মামলার বিপরীতে তিনি শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করেন যাতে করে পাকিস্তান সরকার মামলাটি তুলে ফেলতে বাধ্য হয়। ফলস্বরূপ, আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ১৯৭০ সালকে বিভীষিকাময় করে তোলার জন্যেই যেন ইয়াহিয়া খান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে। এলোমেলো রাজনৈতিক অবস্থা গুছিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান সংসদীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করে কিন্তু মাওলানা ভাসানী তা বয়কট করেন। এর পরিবর্তে তিনি সাইক্লোন আক্রান্ত জনগণের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাইক্লোন দুর্গতদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতার কারণে মাওলানা ভাসানী সকলের সামনে পূর্ব পাকিস্তান বিভাজনের প্রস্তাব রাখেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর দিকে ভাসানী ছিলেন ভারতে। ঢাকায় ফেরত আসার পর তাঁর প্রথম ফরমায়েশ ছিল বাংলাদেশের মাটি থেকে সকল ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়ে দেয়া। ফেব্রুয়ারী মাসের ২৫ তারিখ থেকে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা শুরু করেন যার নাম ছিল “হক কথা”। এই পত্রিকা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে আর খুব দ্রুত নিষিদ্ধও ঘোষিত হয়। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মাওলানা ভাসানী খাদ্যাভাব, প্রয়োজনীয় জিনিসের উচ্চমূল্য এবং আইন সংশোধনের দাবীতে অনশন শুরু করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মাওলানা ভাসানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে আয়োজিত ও আই সি এর ইসলামিক কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ। বঙ্গবন্ধু পল্টনে মাওলানা ভাসানীর সমর্থকদের একসাথে জড়ো করে বৈঠকের আয়োজন করেন। এর আগে সমন্বয়কারী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন সাবেক মন্ত্রী সোহরাব হোসেইন। এর পর মুজিব তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহম্মদ সালেহউদ্দিনকে দায়িত্ব দেন এই বিষয়ে মাওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগ করতে। সৈয়দ কাম্রুল ইসলাম তাঁর বন্ধু সাংবাদিক ফজলে লোহানিকে সাথে নিয়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষে যান।
আওয়ামীলীগ এবং বাকশাল পন্থীদের কঠোর পদ্ধতিকে মাওলানা ভাসানী অনেক সমালোচনা করেছিলেন। এক নায়কতান্ত্রিক দেশ গঠনের ব্যাপারে তিনি শেখ মুজিবকেও সাবধান করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী মুজিবকে স্নেহ করতেন নিজের ছেলের মত। মুজিব এবং মুজিবের পরিবারের মৃত্যুতে তিনি হতভম্ব হয়ে পরেছিলেন। যে ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু সংবাদ তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিল, তার ভাষ্যমতে, মাওলানা কেঁদেছিলেন এবং তারপর প্রাত্যাহিক নামাজে চলে যান।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান
১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানী খোদাই খিদমতগার নামের নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সন্তোষে তাঁর স্বপ্নের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) কাজ শুরু করেন। এছাড়াও তিনি সন্তোষে কারিগরি শিক্ষা কলেজ, মেয়েদের স্কুল এবং সন্তোষে একটি শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে ঢাকায় মাওলানা ভাসানী মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহ টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। এখনও প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিনে তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করে, এবং তাঁর কবর জিয়ারত করে।