চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ নই আমি , সাধারন দর্শক হিসেবেই বিভিন্ন ধাঁচের চলচ্চিত্র দেখে থাকি নিছক বিনোদনের জন্য। যতটুকু বুঝি তা নিজের সাধারণ বিচার বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞানের গরিমা দিয়ে নয়। আজ আমি যে চলচ্চিত্রটি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব সেটি নিজের সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বলার চেষ্টা করব।
বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে যেকোন কথা বলার চেষ্টা করলে একজনের নাম না এসে কোন উপায়ই নেই , তিনি হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। যখন ছোট ছিলাম তখন মুগ্ধ হয়ে ছিলাম সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, গুপি গায়েন বাঘা বায়েন, হিরক রাজার দেশের মায়ায়। আর যখন কিছুটা বড় হলাম তখন মুগ্ধ হলাম চারুলতা , জলসাঘর, পথের পাঁচালী, দেবী, অপুর সংসার আর কাঞ্চনজঙ্খার ঐন্দ্রজালিক উপস্থাপনায়।
আজ যে চলচ্চিত্রটি নিয়ে কথা বলব সেটির নাম হচ্ছে ‘চারুলতা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ এর
অবলম্বনে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি। কথাটি লিখে মন ভরল না। কেন জানি আমার মনে হয় চলচ্চিত্রটির পরিচয় ‘নষ্টনীড়’ দিয়ে নয়, বরং চারুলতাই নষ্টনীড় এর পরিচয়। গল্প উপস্থাপনার গুণে উৎরে যায়, গল্পের গুণে উপস্থাপনা নয়। এত চমৎকার ভাবে উপস্থপন করা হয়েছে যে , আমার সব সময়ই মনে হয়েছে যে আমি চারুলতা দেখছি, নষ্টনীড় এর চলচ্চিত্র রূপ নয়।
১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটির কাহিনী ১৮৭৯ সালের। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান একবারো মনে হয় নি দেখার সময়। মনে হচ্ছিল ১৮৭৯ সালে বসেই দেখছি আমি চলচ্চিত্রটি। এত চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বাস্তবচিত্র যে একবারও মনে হয়নি যে, না আমি ঐ যুগের, না পরিচালক ঐ যুগের , না অভিনেতা-অভিনেত্রী ঐ যুগের।
চারুলতার স্বামী ভূপতি , তৎকালীন সময়ের উচ্চবিত্ত এক পরিবারের কর্তা , পেশায় আইনজীবী, প্রচণ্ড খেয়ালী একজন মানুষ। এই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। এত শক্তিশালী অভিনয় খুব কমই দেখা যায় এই ধরনের চরিত্রে। প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তিটি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা প্রকাশের জন্য বাড়িতেই ‘Sentinnel’ নামে এক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং রাতদিন এই পত্রিকা নিয়ে কাজে ডুবে থাকেন। এটিই যেন তাঁর ধ্যান জ্ঞান। চারুলতা সম্পর্কে কি আসলেই উদাস ছিলেন তিনি? এটা আসলেই একটা বড় প্রশ্ন এই চলচ্চিত্রটিতে। প্রথাগত ভাবে দেখলে একদিকে মনে হয় তিনি উদাসই ছিলেন নিজের স্ত্রীর প্রতি। কিন্তু তাই যদু হত তাহলে চারুলতার ভাই উমাপতিকে কেনই বা তিনি নিয়ে আসবেন? শুধুই কি নিজের কাজের সুবিধার জন্য, চারুর একাকীত্ব দূর করার কোন প্রয়াস কি সেখানে ছিল না? উমাপতির স্ত্রী মন্দাকিনীর উপস্থিতি কি আদতে চারুর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য নয়? প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই থাকল, নিজেই খুঁজে নিবেন উত্তরটা।
তারপর অমলের চরিত্রটির কথায় আসি। সদা হাস্য, প্রাণোচ্ছল একটি ছেলে। সদ্য পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দাদার কাছে ক’দিনের জন্য এসেছে ছেলেটি। একটি ঝড়ের দৃশ্যে আগমন এই চরিত্রের, পুরো চলচ্চিত্রে ঝড়ের মতই সে পালটে দিয়েছে ঘটনাপ্রবাহ, সম্ভাব্যতা। অসাধারণ প্রতিভাধর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন এই চরিত্রে। আমার মতে উনি ছাড়া এই চরিত্রের রূপদান আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ছেলেমানুষির আবহে তিনি ফুঁটিয়ে তুলতে পেরেছেন আবেগের বিভিন্ন অবস্থা গুলো। তার বৌঠান চারুলতার প্রতি তার কোন দুর্বলতা ছিল বলে প্রথম দিকে মনে হয় না। বরং যখন ভূপতি তাকে চারুর সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচনের ভার দেয়, তাকে বেশ বিরক্তই দেখা গিয়েছে। চারুর সাথে প্রথম দিকে তার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের দিকেই বেশি যায়। হাস্য রসাত্মক, বন্ধুত্বপূর্ন , ছেলেমানুষি দেবর সুলভ চরিত্রই তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু চরিত্রটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়েছে তখনই যখন তার উপর চারুর টান সে বুঝতে পারে এবং দাদার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে বুঝতে পেরে সে রাতের বেলাই একটি চিঠি রেখে চলে যায়। পুরো সময়টুকুতে চরিত্রের ছেলেমানুষি দিকগুলো ফুঁটে উঠলেও কিছু কিছু সময় তার চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশংসা করার মত। বিয়ে করলে বিলেত নিয়ে যাবে এমন লোভনীয় সুযোগও হেলায় ছেড়ে দিয়েছিল সে।
মন্দাকিনী চরিত্রটি সবচেয়ে সহজ এবং সাবলীল চরিত্র। কোন লুকোছাপাই নেই তার মাঝে। অমলকে ভাল লাগাও যেমন সহজে প্রকাশ্য, তেমনি চারুর সাথের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটাও সহজেই বোঝা যায়। অমলের ভাষায় মন্দাকিনী প্রবীণার প্রতিনিধিত্ব করে আর চারু করে নবীনার।
এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে অসাধারণ চরিত্র হচ্ছে চারুলতা। নামের সার্থকতা এই যে লতার মতই এই চরিত্রটি ক্রমশ বেড়ে উঠেছে, এগিয়ে গিয়েছে, ছাড়িয়ে গিয়েছে নিজেকেই। তার পুরো পরিচয় কেমন যেন পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে, কখনওই প্রকাশ হয়নি। কিংবা বলা যায় হতে দেয়নি। হঠাৎ করে দমকা হওয়ায় উড়ে যাওয়া পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিশোরীর মত ক্ষণিক আবেশ হয়ত পাওয়া যায় কিন্তু পুরোটা আত্মস্থ করা হয়ে উঠে না কখনওই। অমলের প্রতি তার ভালবাসা ছিল এটা বেশ বোঝা যায়, যদিও কেন জানি মনে হয় শুরুটা বাৎসল্য দিয়েই হয়েছিল। নিজে লেখালেখি শুরু করার পেছনে ছিল আবেগ, যেটা বেগ পেয়েছিল মন্দাকিনীর প্রতি অমলের আগ্রহের কারনে। একাকীত্ব কি তার দৃঢ়তাকেই ভেঙে দিয়েছিল? নাকি সাহস জুগিয়েছিল প্রথা ভেঙে কলম ধরার জন্য। ভূপতির প্রতি তার প্রেম ছিল একথা মিথ্যা নয়, কিন্তু সেটা কি সে ধরে রাখতে পেরেছিল? না কি কাগজের নৌকার মত কিংবা ফুঁটো হয়ে যাওয়া ঘুড়ির মত সেই প্রেমের পরিনাম ছিল বিচ্ছেদ। আমি নিজে মাধবী মুখোপাধ্যায় এর ভক্ত হয়ে গেছি শুধু উনার এই চরিত্র চিত্রণের জন্য।
পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই বিচ্ছেদটাকে এত অসাধারণ ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন যে মুগ্ধতাও ছাপিয়ে উঠেছে আবেগের কলস থেকে। প্রতিটি চরিত্রকে মনে হয়েছে ঠিক এরকমই হওয়ার কথা ছিল এদের। দৃশ্যায়ন, চরিত্রচিত্রণ, গল্প বলার ধরন সবই ছিল অসাধারণ। ১১৭ মিনিট যে কিভাবে কেটে গেছে তা বুঝতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল এক মোহময় আবেশে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে বাস্তব আর আবেগের মেঘপুঞ্জের ভেতর দিয়ে।