ওয়াটারলু : ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল যে যুদ্ধ

4

নেপোলিয়নের জীবন ছিল এক নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। প্রথমে প্রবল শক্তি নিয়ে সমগ্র ইউরোপ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আবার নেপোলিয়ন নিজের শক্তি খুইয়ে আধিপত্য হারিয়েছেন। তাও দমে যাননি তিনি। লড়াই করার মানসিকতা রেখেছেন সর্বদা। যা ওয়াটারলু যুদ্ধ থেকেই বুঝা যায়। তার বিরোধী শত্রু দলের সেনাপতি ওয়ালিনংটন স্বয়ং বলেছিলেন যে,যুদ্ধের ময়দানে তাঁর উপস্থিতি চল্লিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে এক ব্যাপক পার্থক্য নিয়ে আসে।” জিততে জিততে নেপোলিয়ন ওয়াটারলু যুদ্ধে হেরে যান। আজকের আর্টিকেলটিতে আমরা ওয়াটারলু যুদ্ধের আদ্যপ্রান্ত দেখার চেষ্টা করব।

এলবা দ্বীপে নেপলিয়নকে নির্বাসন দেয়া হয়
এলবা দ্বীপে নেপলিয়নকে নির্বাসন দেয়া হয় ; source:pimterest.com

প্রাশিয়ার মুক্তির সংগ্রাম ও নেপোলিয়নের সিংহাসন ত্যাগ:

রাশিয়ায় নেপোলিয়নের পরাজয় ইউরোপে নব উন্মাদনা সৃষ্টি করে। নেপোলিয়নের দুর্দিনে জার্মানিরা প্রতিশোধ গ্রহণের মোক্ষম সময় মনে করে। ১৮১৩ সালের প্রাশিয়া ও রাশিয়া একত্রিত হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরমধ্যেই আবার ইংল্যান্ড রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইডেনকে নিয়ে আবার জোট তৈরি করে। দক্ষিণ দিক থেকে রাশিয়া ও প্রাশিয়া ফ্রান্সের অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। উত্তর দিক থেকে সুইডেনের সেনারা এগুতে থাকে। এই খবর পেয়েই নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়া হামলা করে জীবনের শেষ বড় বিজয় অর্জন করেন। যদিও এ বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। কেননা মিত্র শক্তি চতুর্দিক থেকে নেপোলিয়নকে ঘিরে ফেলে।

এলবা থেকে পালিয়ে এলে সবাই আবার তাকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেন
এলবা থেকে পালিয়ে এলে সবাই আবার তাকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেন ; sourcre:pinterest,com

অবশেষে নেপোলিয়ন লাইপাজিগে তিন দিন যুদ্ধ করে ব্যর্থ অবস্থায় ফ্রান্সে ফিরে যান। ফ্রান্সের বাইরের সকল ভূখণ্ডই তখন স্বাধীন হয়ে যায়।১৮১৪ সালে লাইপাজিগে যুদ্ধে জয়ী মিত্ররা নেপোলিয়নকে সন্ধি করার আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মিত্র বাহিনী একত্র হামলা করে ফ্রান্স দখল করে নেয়। এবার নেপোলিয়নকে চুক্তিতে আসতেই হয়। ৬ এপ্রিল নেপোলিয়ন ফন্টেনব্লু চুক্তির মাধ্যমে সিংহাসন ত্যাগ করে ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে চলে যান। তাকে দুই মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পেনশন দিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই নেপোলিয়নের রাজনৈতিক জীবনের যবনিকা নেমে আসে।

নেপোলিয়নের সিংহাসনে ১০০ দিবসের জন্য প্রত্যাবর্তন:

নেপোলিয়নের নির্বাসনের ফলে ফ্রান্সে চতুর্দশ লুইয়ের ভাই অষ্টাদশ লুইকে সিংহাসনে বসায় মিত্র শক্তি। কিন্তু ফরাসী জনগণ তার প্রতি রুষ্ট হন। সারাদেশে গোলযোগ লেগে যায়। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় দেশ। সেনাবাহিনীও এক প্রকার বিদ্রোহ করে বসে।  এই সংবাদ শুনে নেপোলিয়ন ভীষণ উৎসাহিত হয়ে উঠেন এবং বিস্তর পরিকল্পনা ছাড়াই এলবা দ্বীপ থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে গমন করেন। জনগণও তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেন। তাকে বাঁধা দেবার কেউই ছিলনা।

বেলজিয়ামে নেপোলিয়নের বাহিনী
বেলজিয়ামে নেপোলিয়নের বাহিনী ; source:npr.com

নেপোলিয়ন ২০ মার্চ প্যারিসে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং অষ্টাদশ লুই পালিয়ে যান। তবে এবার আর অত শক্তিশালী সরকার গঠন করতে সমর্থ হননি নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের সিংহাসনে আরোহণের কথা শুনে মিত্র বাহিনী আবার নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে এগিয়ে আসে। নেপোলিয়নও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে শেষবারের মতো লক্ষাধিক সৈন্য জোগাড় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।

বেলজিয়ামে শক্তি প্রদর্শন ও বিজয়:

নেপোলিয়ন ফিরে আসাতে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ব্রিটেন ও রাশিয়া আবার নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে,কেননা নেপোলিয়ন শেষ হয়ে গেলেও এই মানুষটি শূন্য থেকেই ফ্রান্স শক্তিকে পরিপূর্ণ করে দেবার মতো সামর্থ্য রাখেন। নেপোলিয়ন নতুন করে আবার সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং পরিকল্পনা করে চাচ্ছিলেন প্রতিটি শত্রুকে এক এক করে আক্রমণ করে ঘায়েল করতে,কেউ তাঁকে আক্রমণ করার আগেই। ১৮১৫ সালের জুনের দিকে নেপোলিয়ন বেলজিয়ামের দিকে সৈন্য নিয়ে অগ্রবর্তী হন। কিন্তু এখানেই প্রাশিয়া ও ব্রিটিশ সৈন্যরা ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিল।

লিগনির যুদ্ধে নেপলিয়নের সেনাবাহিনী
লিগনির যুদ্ধে নেপলিয়নের সেনাবাহিনী ; source: Alamy

১৬ জুন প্রাশিয়ান সৈন্যদের সাথে লিগনির যুদ্ধে প্রাশিয়ান কমান্ডার ব্লুচারের বিরুদ্ধে নেপোলিয়ন বাহিনী জয় পায়। যদিও নেপোলিয়নের বাহিনী প্রাশিয়ানদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে পারেনি। প্রায় ৩০,০০০ প্রাশিয়ান সৈন্যই পরবর্তীতে ওয়াটারলু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নেপোলিয়নকে হারাতে সহায়তা করে।

ওয়াটারলু যুদ্ধের একটি চিত্র
ওয়াটারলু যুদ্ধের একটি চিত্র; source: independent,com

ওয়াটারলু যুদ্ধ:

লিগনির যুদ্ধের ২ দিন পর,অর্থাৎ ১৮ জুন ঐতিহাসিক ওয়াটারলু যুদ্ধ সংগঠিত হয়। নেপোলিয়ন প্রায় ৭২,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ওয়াটারলু যুদ্ধের দিকে ধাবমান হয়। অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনী ৬৮,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে আর্থার ওয়েসলি,ডিউক অব ওয়ালিংটন,বেলজিয়ামের বর্তমান রাজধানী ব্রাসেলসের দক্ষিণ দিকের ওয়াটারলু গ্রামে অপেক্ষা করতে থাকেন। ব্রিটিশ বাহিনীর এক বড় অংশই ছিল স্থানীয় বেলজীয়,ডাচ ও প্রাশিয়ান পরাজিত সৈন্যদের সমন্বয়ে তৈরি। ব্রিটিশরা এই ইউরোপে ভাগ্য ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধে ওয়েসলিকে সেনাপতি করার আরেকটি কারণও আছে। কেননা এই ওয়েসলিই উপদ্বীপের যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনীকে বারবার নাকাল করেছিলেন।

ওয়াটারলু যুদ্ধের ময়দানের বর্তমান অবস্থা ; source: Wikipedia,com

যুদ্ধের শুরুতেই নেপোলিয়ন একটি ভুল করলেন। নেপোলিয়ন দ্রুত ওয়াটারলুর দিকে ধাবিত না করে কর্দমাক্ত মাঠ শুকাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ১৭ জুন রাতে প্রবল বর্ষণে মাঠঘাট খুব কাদামাখা হয়ে গেছিলো। এই সুযোগে ওয়েসলি তার সৈন্যদের ঠিকভাবে প্রস্তুত করাবার সুযোগ পান। পাশাপাশি নেপোলিয়নের কাছে প্রাশিয়ান বাহিনীর প্রায় ৩০,০০০ সৈন্য ব্লুচারের নেতৃত্বে এসে ব্রিটশ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। যুদ্ধের শুরুর দিকে নেপোলিয়ন খুব শক্ত আক্রমণ করলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। প্রাশিয়ান ক্রোধান্বিত সেনারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধে করে ফরাসিদের দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। ফরাসি অনেক সৈন্যই যুদ্ধের গোলমালের মধ্যে পিছু হটতে শুরু করে। নেপোলিয়নের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলনা। অবশেষে ডিউক অব ওয়ালিংটনের কাছে নেপোলিয়নকে পরাজয় বরণ করতেই হয়। ফরাসি বাহিনীর প্রায় ৩৩ হাজার সৈন্য আহত,নিহত ও বন্দী হয়।

সেন্ট হেলেনা দ্বীপের পথে নেপোলিয়ন
সেন্ট হেলেনা দ্বীপের পথে নেপোলিয়ন ; source: getty images

অন্যদিকে ব্রিটশ ও প্রাশিয়ান প্রায় ২২ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। নেপোলিয়নের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ও অপরিণামদর্শী কিছু ভুলচুক যুদ্ধের ফলাফল পালটে দেয়। এরমধ্য দিয়েই চিরজীবনের জন্য নেপোলিয়নের সামরিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে।অন্যদিকে আর্থার ওয়েসলি যান তারকা বনে। কিছুদিনের মধ্যেই ওয়েসলি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। ব্লুচারের জন্য অবশ্য তেমন কোন সু-সংবাদ ছিল না। ২২ জুন দক্ষিণ  আটলান্টিক সাগরে ব্রিটিশ অধিকৃত  দূরবর্তী সেন্ট হেলেন দ্বীপে তাকে দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো নির্বাসন দেয়া হয়। ১৮২১ সালে এই দ্বীপেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই মহান যোদ্ধা বীরের মৃত্যু হয়।

ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল:

প্রথমত,ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যে দীর্ঘ দিনের পরাশক্তি হবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল এই যুদ্ধের মাধ্যমে তা অবসান হয়। ব্রিটেন একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়।

দ্বিতীয়ত,এই যুদ্ধ করতে গিয়েই ইউরোপে একটি শক্তি সংঘ গড়ার প্রবণতা দেখা যায়। যা কালেক্টিভ ডিফেন্স বলেও বিবেচনা করা হয়। এর ফলে কনসার্ট অব ইউরোপ ধারণার প্রবর্তন হয় যা পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

তৃতীয়ত, এই যুদ্ধের ফলে বর্তমান জার্মানি প্রাশিয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হবার সুযোগ পায় ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

চতুর্থত,বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনই করে দিয়েছিল বলা যায় এই যুদ্ধর মাধ্যমে। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন,”ওয়াটারলু শুধু একটি যুদ্ধ নয়,এই বিশ্বের স্বরূপই বদলে দিয়েছে।

 

রেফারেন্স

১. ইউরোপের ইতিহাস, দিলিপ কুমার

২. উইকিপিডিয়া

৩. ব্রিটিনিকা

৪. বিবিসি হিস্ট্রি

৫. হিস্ট্রি ডট কম

Source Featured Image
Leave A Reply
4 Comments
  1. Xlsniu says

    rybelsus 14 mg tablet – DDAVP for sale buy generic DDAVP online

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More