মুভি রিভিউ – ‘উইশ’ (Wish-2013)

1

কাজের ব্যস্ততায় বাবা-মা দুজন-ই কিছুটা অযত্মশীল ছিলেন মেয়ের প্রতি, এই উদাসীনতার দরুন সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে  ‘হোপ’ এর বাবা-মা মোটেও আঁচ করতে পারেন নি । আট বছর বয়সী মেয়েকে একা-ই পাঠিয়ে দিতেন  স্কুলে। প্রতিদিনকার মতন হোপ সেদিনও একা-ই স্কুলে যাচ্ছিলো, আট বছরের ছোট্ট হোপের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না আজকের এই একাকী স্কুল যাত্রা তার জন্য কতোটুকু ভয়ংকর হতে চলছে । বৃষ্টিস্নাত দিন হওয়ায় দ্রুত স্কুলে পৌঁছোবার জন্য হ্রস্বতর পথ ধরে হোপ । এ সময় ৫৭ বছর বয়সী এক পাঁড়মাতাল পথ আগলে ধরে হোপের । হোপকে নিয়ে জনশূন্য নির্মাণাধীন ভবনের পরিত্যক্ত স্থানে নিয়ে যেতে লোকটির মোটেও বেগ পেতে হয়নি, বর্ষণের ভারী শব্দের দেয়ালের অপর পৃষ্ঠে আটকে পড়ে হোপের আর্তনাদ । ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে হোপকে, এই ক্ষতের আঘাত শুধু দৈহিক ভাবে না মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত করে দেয় তাকে ।

গল্পের শুরু এখান থেকে-ই । আট বছরের একটি মেয়ে যৌন নির্যাতিত হওয়ার পর তার এবং তার পরিবারের মানসিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায় । এ যেনো জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত থেতলে দিচ্ছে তাদের। নিজের বাবাকে দেখে ভয় পাচ্ছে একটি মেয়ে, এই মুহূর্তে সেই বাবার অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে ? “কিচ্ছু হয়নি মা তোমার” এই বলে মেয়েকে সাহস দিতে পারছে না এক বাবা, দূর থেকে মেয়ের আহাজারি শোনা ছাড়া কিছু-ই করতে পারছে না, এর থেকে হৃদয় বিদারক দৃশ্য আর কি হতে পারে ? সিনেমার গল্পে নতুন মোড় নেয় যখন ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয় আর সে ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে কিছু-ই জানে না বলে বিবৃতি দেয় । তার মতে সে মদ্যপায়ী অবস্থায় ছিলো বিধায় সেদিনেরর ঘটনা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা-ই নেই । ধীরে ধীরে গল্পে আরো জটিলতার সৃষ্টি হয় যখন বিচারক তার ফাসির আদেশ না দিয়ে মাত্র ১২বছরের সাজা দেন ।

ড্রামা ঘরণায় নির্মিত হলেও এই সিনেমার একটি টার্ম আছে যাকে স্পষ্টবাক্য দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয় মূলত এটি একটি সারভাইভাল সিনেমা । যেখানে সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের সারভাইভালকে চিত্রায়িত করা হয়েছে, আট বছরের ছোট্ট মেয়ে লড়ছে নিজের সাথে, ফ্যামিলীর সাথে, যে কিনা সবসময় এই চিন্তায় মগ্ন যে সুস্থ হওয়ার পরে তাকে আবারো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে কি ? স্কুলের বন্ধুরা তার সম্পর্কে কিরূপ ধারণা পোষণ করছে ? এসব বিষয় তাকে যেনো আরো বেশি বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে । অপর দিকে মেয়ের বাবা, যার সাথে কিনা মেয়ে কথা বলতে-ই ভয় পাচ্ছে । নিজের ব্যস্ততাকে দোষারোপ করে করে মেয়ের মাও নিজেকে মানসিকভাবে কষ্ট দিচ্ছেন, এভাবে মূল চরিত্রের সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কোনো না কোনো ভাবে সারভাইভ করে যাচ্ছেন ।

সিনেমায় যেসব গল্প দেখে আমরা অভ্যস্ত সেই অভ্যস্ত গল্পের বৃত্ত থেকে বের হয়ে ভিন্নমাত্রার একটি গল্প তুলে ধরা হয়ে যেটি কিনা ‘নাইওং কেইস’ নামে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে । ২০০৮ সালে স্কুলগামী এক আট বছরের মেয়েকে মাঝবয়সী এক মাতাল পাবলিক টয়লেটে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও পৈশাচিক ভাবে নির্যাতন করে । এই গল্পের উপর ভিত্তি করে-ই সিনেমাটি নির্মিত ।

গল্পটিকে রিভেঞ্জ স্টোরিতে অনায়াসে রূপদান করা যেতো, মূলত কোরিয়ান রিভেঞ্জ স্টোরিগুলো এভাবে-ই বিল্ড আপ করা হয় । পরিচালক এখানে-ই নিজের মুন্সিয়ানার প্রমাণ দিয়েছেন, সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাকে পুরোদস্তুর বাস্তবিক ভাবে উপস্থাপিত করেছেন, এক্ষেত্রে কোনো প্রকারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপাদানের সহায়তা নেন নি যা দিয়ে হয়তো দর্শককে চমকে দেয়া যাবে। সিনেমার শুরু থেকে-ই শেষ পর্যন্ত গল্পের প্রবাহ ধরে রেখেছেন যদিও চিত্রনাট্য কিছুটা মন্থর গতির ছিলো কিন্তু গল্পে কোনো প্রকারের ক্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেনি ।

গল্পে তেমন কোনো টুইস্ট বা পাঞ্চ ছিলো না যা দেখে দর্শক স্তব্ধ হয়ে যাবে । এ গল্প আমরা হর হামেশা-ই শুনি বা পড়ি পত্র-পত্রিকায়, এসব গল্প এক প্রকার সয়ে এসেছে, এখন আর এসব গল্প নাড়া দেয় না, হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে, পরিচালকের কৃতিত্ব ঠিক এখানে-ই, যেখানে কোরিয়ান সিনেমাগুলোয় দেখা যায় সাধারণ একটি গল্পকে খুব সুন্দর ভাবে রসিয়ে প্রেজেন্ট করা হয়, গল্পকে ইমোশোনালী ম্যানুপুলেট করে মেলোড্রামায় রূপান্তর করা হয়, বাস্তবতা হচ্ছে এসব গল্প-ই এখন খুব বিকচ্ছে । কিন্তু এক্ষেত্রে এই সিনেমায় নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার গল্পের মূল উপাদানকে চিত্তাকর্ষক ভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে কোনো ভাবে-ই অতি আবেগের সাহায্য নেন নি, সরলরৈখিকভাবে গল্পকে উপস্থাপন করেছেন, প্রতিকূলতা, বর্বরতা, মানসিক যন্ত্রনা, আস্থা-আশাস্থল, এসব বিষয় বস্তুকে এক সুতোয় গেঁথে ।

 

যে গল্পের উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি নির্মিত সেই গল্পকে ক্রুটিহীন ভাবে ফুটিয়ে তুলতে হলে প্রথমে-ই প্রয়োজন দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী । তাদের অভিনয় বলে দিবে গল্পে প্রাণ কতোটুকু । ধরে ধরে প্রতিটি চরিত্রের বিশ্লেষণ লেখাকে প্রাণহীন করে ফেলবে, তাই দুটি চরিত্র নিয়ে লিখছি,যদিও প্রতিটি চরিত্র তাদের জায়গায় অসাধারণ ছিলেন, বিশেষ করে, স্বল্প সংলাপে অঙ্কিত ৫৭বছরের মধ্যবয়সী লোকের অভিব্যক্তি শরীরে শিহরণ জাগানোর মতন। ভিক্টিম চরিত্রে লি রি, মাত্র আট বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে, প্রশ্ন যেখানে অভিনয়ের দক্ষতা সেখানে বয়স খুব কম ক্ষেত্রবিশেষে বাধা হতে পারে , গল্প আর চরিত্রকে কতোটুকু আত্মস্থ করতে পেরেছে সে সেটা-ই মুখ্য বিষয়, লি রি-এর উপর ভর করে পুরো সিনেমা এগিয়ে গেছে, দূর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের চরিত্রকে । সিনেমার আরো একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিয়াং-গু শুল, বাবা চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন তিনিও । সিনেমার এক পর্যায়ে দেখা যায়, মেয়েকে টিভি চ্যানেলওয়ালদের হাত থেকে বাচাতে কোলে নিয়ে দৌড়ে লুকানোর চেষ্টা করেন কিয়াং, এ দৃশ্য যে কারো চোখকে সিক্ত করে দিবে ।

সিনেমার মূল কারিগর লি জুন, যার পূর্বের কাজগুলোও সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে । আর এ সিনেমা দিয়ে সমালোচক সহ দর্শক হৃদয়েও আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন । কোরিয়ান সিনেমা বললে-ই যেখানে চোখের সামনে ভেসে উঠে ভায়োলেন্স সেখানে যৌন নির্যাতনের মতন একটি বিষয়কে ভায়োলেন্সের বেড়াজালে না মুড়ে সুনিপুণ ভাবে চিত্রায়িত করেছেন, পুরো সিনেমা জুড়ে এ রকম বহু বিষয়কে ভিন্ন আঙ্গিকে রূপায়ন করেছেন । চোখ ধাধানো সিনেমাট্রোগ্রাফী না নির্মাতার প্রধান অস্ত্র ছিলো এর গল্প আর চিত্রনাট্য ।

সিনেমার বিষয়বস্তু খুব-ই স্পর্শকাতর হওয়ায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পরপর-ই বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে, শুরুর দিকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যেনো সিনেমার প্রচারকে আরো বেগবান করে দেয়, সেই পুরোনো লাইনের পুনোরাবৃত্তি আর কি “নেগেটিভিটি ইজ দ্য বেস্ট পাবলিসিটি” । কিন্তু বেশিদিন এই সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি, পরিচালক নিজে-ই যখন বিবৃতি দেন যে, চাইল্ড রেইপ নিয়ে তিনি কোনো ক্রাইম ধাচের সিনেমা নির্মান করেন নি, তিনি নির্মাণ করেছেন এমন একটি সিনেমা যার মূল উপজীব্য হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে একটি ফ্যামিলীর টিকে থাকার গল্প, একজন বাবা ও মেয়ের গল্প ।

এই সিনেমা ২০১৩সালে মুক্তি পায়, এক-ই বছরে আরো একটি অসাধারণ সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো মিরাকল ইন সেল নাম্বার সেভেন’, দুটো সিনেমার গল্পে সূক্ষ্ম এক প্রকারের মেলবন্ধন লক্ষনীয়, অথবা Wish সিনেমাটি মিরাকল ইন সেল নাম্বার সেভেনের আংশিক রিভার্স ভার্শনও বলা যেতে পারে, যদিও দুটি সিনেমা-ই একেবারে-ই ভিন্ন গল্প নিয়ে নির্মিত ।

সাদামাটা একটি গল্প কিন্তু সিনেমাটি শেষ করার পর সেই ছোট্ট মেয়ের মানসিক বিপর্যয়ের কথা অনেকদিন ভাবাবে দর্শককে ।

 

Leave A Reply
1 Comment
  1. Shafbv says

    buy lamisil 250mg generic – lamisil price grifulvin v price

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More