১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের সময় কেমন ছিল ভারতের অর্থনীতি? পণ্যের দ্রব্যমূল্য আধুনিক সময়ের চেয়ে বেশি ছিল? প্রকৃতপক্ষে সে সময় ভারতের কলকাতার অর্থনীতি কৃষিব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে চলতো। আর ১৭৫২ সালে হঠাৎ করেই কলকাতার বাজারে শস্যের দাম বেড়ে যায়। তখন ব্রিটিশরা এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায় পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। তারা এদেশের এক জমিদার গোবিন্দ রামের কাছে এর কৈফিয়ৎ চান। এর উত্তরে তিনি একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতেই উঠে আসে ভারতের সমসাময়িক অর্থনীতির চিত্র।
সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৭৫১ সালে এক টাকায় এক মণ ৩২ সের চাল পাওয়া যেত। অর্থাৎ তখন এক টাকায় ৬৭ কেজি চাল পাওয়া যেত। একই দামে গমও পাওয়া যেত। ময়দা এক টাকায় এক মণ তিন সের। অর্থাৎ প্রায় ৪০ কেজি। তেল পাওয়া যেত এক টাকায় এক মণ। অর্থাৎ প্রায় ৩৭ কেজি। আর ১৭৫২ সালে কলকাতায় দ্রব্যমূল্য কিছুটা বেড়ে যায়। সে বছর এক টাকায় এক মণ ১৬ সের বা প্রায় ৫২ কেজি চাল পাওয়া যেত। বলাবাহুল্য, চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবেই ভারতের মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল দুর্ভিক্ষ।
দ্রব্যমূল্যের অবস্থা
স্বাভাবিকভাবে কোনো যুদ্ধের পর দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরেও সে রকমই ঘটেছে। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ের তুলনায় সে সময়ের দ্রব্যমূল্য বেশ সস্তাই ছিল। ১৭৬৩ সালে যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর ব্রিটিশদের ‘পুতুল’ নবাব ছিলেন, তখন একবার কোম্পানির অতিথি হিসেবে কলকাতা সফরে এলে তাকে একটি ফর্দ দেওয়া হয়। সে ফর্দ থেকে বাংলার দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সে সময় ৪০ মণ বা ১৫০০ কেজি চালের দাম ৭৫ টাকা, আট মণ ডাল ২০ টাকা দুই আনা, ৫ মণ ঘি ৭৭ টাকা, ৬ মণ তেল ৫১ টাকা, ৮ মণ ময়দা ২৭ টাকা, ৫ মণ চিনি ৩৬ টাকা, ৬ মণ মিষ্টান্ন দ্রব্য ৬০ টাকা, এক মণ মোরব্বা ১৯ টাকা, এক মণ বাদাম ও কিশমিশ ৩১ টাকা চার আনা, ৫০টি খাসি ৫০ টাকা।
চাকর-বাকরদের বেতন
দ্রব্যমূল্যের মতোই সে সময় যাদের চাকর-বাকর বলা হতো তাদের মাসিক বেতন অনেক কম ছিল। খানসামা বা পরিচায়ক, চোপদার বা লাঠিয়াল, প্রধান বাবুর্চি এবং কোচম্যান বা ঘোড়াগাড়ি চালকের বেতন ছিল পাঁচ টাকা। জমাদার, খিদমতগার বা সেবক, সরদার বেহারা বা প্রধান পালকিবাহক ও পাঁচকের প্রধান সহকারীর বেতন তিন টাকা, পেয়াদা, বেহারা বা পালকিবাহকের বেতন দুই টাকা ৫০ পয়সা। তখন পুরো পরিবারের জন্য একজন ধোপা নিতে হলে তিন টাকা দিতে হতো। মশালচীর বেতন দুই টাকা। তার কাজ ছিল কোথাও সফরে গেলে লণ্ঠন হাতে নিয়ে পথ দেখানো। সাধারণ নাপিত ও পরচুলা সাজানোর নাপিতকে দেওয়া হতো এক টাকা ৫০ পয়সা, মালীকে দেওয়া হতো দুই টাকা, পুরো পরিবারের জন্য দাসী রাখা হলে দুই টাকা দেওয়া হতো। হুকো বরদারকে এক টাকা দেওয়া হতো। হুকো বরদাররা তামাক সাজাতো। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সে সময় যারা উচ্চবিত্ত বা অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন, তারা চাকর-বাকর না রেখে চলতে পারতেন না। তবে বিলাসিতা এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে অনেকে ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী রাখতেন। সে সময় সংবাদপত্রেও ক্রীতদাস বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। শৈশবে মা-বাবাকে হারিয়ে অনেকে দাস ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যেতেন। ভারতে ক্রীতদাস কেনাবেচা নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৮৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার এক আইন প্রচলন করে। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ক্রীতদাস কেনাবেচা।
যাতায়াত খরচ
১৭৫৭ সালে যাতায়াতের খরচও ছিল বর্তমান সময়ের তুলনায় একেবারেই কম। সে সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে কোম্পানির বাহাদুরের ডাকচৌকি ছিল। এগুলোতে পালকি ও বেহারা থাকতো এবং ছিল পোস্ট অফিসের অধীনে। তখন সাধারণ মানুষ হেঁটে যাতায়াত করলেও অবস্থাসম্পন্ন মানুষেরা দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য পালকি ব্যবহার করতেন। সরকারি ডাকচৌকির পাশাপাশি মালামাল বহনকারী পালকিও পাওয়া যেত। যা ‘বাঙ্গি’ নামে পরিচিত। বেহারা, বেহারা সরদার ও মশালচীর ভাড়াও খুব কম ছিল না।
সে সময় মালামাল বহন করে নিয়ে যেতে কত টাকা গুনতে হতো সে সম্পর্কে একটি তালিকা পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে চন্দননগর ২৪ টাকা আট আনা এবং হুগলি যেতে গুনতে হতো ৪৬ টাকা চার আনা। বহরমপুর যেতে ১৫৯ টাকা আট আনা, মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার ও মুরাদবাগ যেতেও একই ভাড়া দিতে হতো। রাজমহলে যেতে ২৫৭ টাকা ১২ আনা, ভাগলপুর যেতে ৩৫৪ টাকা, পাটনা যেতে ৫৪০ টাকা ও মুঙ্গের যেতে ৪০৬ টাকা দিতে হতো।
সমসাময়িক সময়ে কলকাতার পুলিশ বাজরা বা নৌকার ব্যবস্থা করতো। পুলিশই দাঁড় ও মাঝি নির্বাচন করতো। ১৭৮১ সালের এক পুলিশি বিজ্ঞাপন থেকে নৌকা বা বাজরার ভাড়া এবং যাতায়াতের সময় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে বহরমপুর যেতে ২০ দিন সময় লাগতো। দৈনিক ভাড়া ছিল দুই টাকা। রাজমহলে পৌঁছতে সময় লাগতো ৩৭ দিন। দৈনিক ভাড়া ছিল তিন টাকা। পাটনা যেতে সময় লাগতো ৬০ দিন এবং দৈনিক ভাড়া দিতে হতো ৬ টাকা। বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসতে লাগতো ৩৭ দিন। দৈনিক ভাড়া দিতে হতো ২৯ টাকা। বর্তমান বন্দরনগরী চট্টগ্রাম যেতে ৬০ সময় ব্যয় হতো। দৈনিক ভাড়া দিতে হতো ৪০ দিন। মুর্শিদাবাদ যেতে সময় লাগতো ২৫ দিন এবং ভাড়া দিতে হতো দুই টাকা।