একটি যুদ্ধ এবং পরাজয়। পিছু হটতে বাধ্য হয় পরাক্রমী রোমান সামরিক শক্তি। ইউরোপের ইতিহাসের গতিপথটাই পাল্টে যায় এ পরাজয়ে। অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্যি, এই রোমান পরাজয়ের রচিয়তা-নায়ক যিনি, তিনি কিন্তু রোমানদের হাতেই তৈরি। রোমে বেড়ে ওঠা, রোমান শিক্ষায় শিক্ষিত। বিষয়টা আমাদের বাংলা প্রবাদ ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ এর মতই।
সময়টা ৯ম খ্রিস্টাব্দ। সম্রাট আউগুস্তসের শাসনকাল। তিন লিজিয়ন সৈন্য(২০ হাজার), তিন স্কোয়াডর্ন অশ্বারহী এবং অক্সিলারি বাহিনীর এক বিশাল বহর নিয়ে টেউটোবুর্গ বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন রোমান অধিকৃত জার্মানিয়ার(রোমানরা রাইন নদীর পূর্বতীরের অঞ্চলসমূহকে জার্মানিয়া বলতো) গভর্নর জেনারেল পুবলিয়াস কুইঙ্কটিলিয়াস ভ্যারাস।সাথে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা আরমিনিউস।ঘন বনের মধ্য দিয়ে রোমান বাহিনী পিপঁড়ের মত সারি ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল।এই সারি এতটাই লম্বা যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃতি প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার।
গভর্নর ভ্যারাসের অবশ্য এ মূহুর্তে এ পথে থাকারই কথা না। ওয়েসার নদীর তীরে রোমান বাহিনীর গ্রীষ্মকালীন শিবির ছেড়ে রাইন নদীর পাশে শীতকালীন সদরদপ্তরের পথে ছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ স্থানীয় গোষ্ঠীসমূহের বিদ্রোহের খবরে এদিকটায় আসা। রোম কখনোই বিদ্রোহ প্রশ্রয় দেয় না।
একপর্যায়ে ভ্যারাসের বাহিনী উত্তর-পূর্ব অসনাবুল্কে বনের অত্যন্ত সরু-কর্দমাক্ত অংশে প্রবেশ করে। এটা সেই সময় যখন রোমানরা জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে। এরকম একটা আক্রমণের জন্য রোমানবাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রোমান বাহিনীর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে তাদের ‘ব্যাটেল ফরমেশন’।সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটাও তাই। বনের এরকম সরু-কর্দমাক্ত একটা অংশে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার জুড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা রোমান সেনাবাহিনীর পক্ষে কোনোরকম ব্যাটেল ফরমেশন তৈরি করা ছিলো অসম্ভব।তিন দিন ধরে চলা এ যুদ্ধে ফলাফল যা হবার তাই হলো। প্রায় পনের হাজার জার্মানের মিলিত বাহিনীর কাছে রোমান সামরিক শক্তির শোচনীয় পরাজয়।১৫ থেকে ২০ হাজার রোমান সৈন্য নিহত হয় যার মাঝে গভর্নর ভ্যারাসও রয়েছেন। যে অল্প সংখ্যক সৈন্য বেঁচে ছিলো তাদের দাসত্ব বরণ করতে হয়।
ইতিহাসে এই যুদ্ধই ‘টেউটোবুর্গ বনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের পর রোমানরা পরবর্তী আট বছর জার্মানিয়া পুনঃদখলের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।আর কখনোই জার্মানিয়া দখলে সক্ষম হয় না। রাইন নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত নিজেদের সীমানা স্থির রেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
রোমানদের এই শোচনীয় পরাজয়,যার খরব রোমে পৌঁছাবার পর স্বয়ং সম্রাট আউগুস্তস দেয়ালে মাথা ঠুকে বলে ওঠেছিলেন,“আমার লিজিয়ন ফেরত দাও ভ্যারাস…” – এর পরিকল্পনাকারী-নেতৃত্বদানকারী কিন্তু আর কেউ নন ভ্যারাসেরই বিশ্বস্ত উপদেষ্টা রোমান সেনাবাহিনীর ইকয়েস্টিয়ান আরমিনিউস। জাতে জার্মান আরমিনিউসের বেড়ে ওঠা রোমে। শিক্ষা-দীক্ষা, সামরিক প্রশিক্ষণ সবই রোমানদের হাতে। আরমিনিউস শুধু স্বজাতি জার্মানদেরই বুঝতেন না রোমানদের ভালোভাবেই বুঝতেন। যার প্রতিফলন দেখা যায় টেউটোবুর্গ বনের যুদ্ধে। রোমানরা নিজেরাই তাদের এই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের জন্মদাতা।
আরমিনিউসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৭ম বা ১৮ম সালে। জার্মানিক চেরুস্কি গোষ্ঠীর তখনকার গোত্রপতি সেগিমিরাস তার পিতা। চেরুস্কি হচ্ছে সেই জার্মান গোত্রগুলোর একটি তারা প্রথমদিকে রোমানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেও পরবর্তীতে রোমান শাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। এসময় রোমানরা একটি নীতি চালু করে। রোমান অধিকৃত অঞ্চলগুলোর সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের রোমের কাছে হস্তান্তর করতে হতো সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের প্রতীকসরূপ। তারা রোমে রোমানদের সাথে বড়ো হতো। অধিকাংশক্ষেত্রেই আর কখনোই নিজ পরিবারের সাথে মিলিত হবার সুযোগ থাকতো না। রোমানদের উদ্দেশ্য ছিলো পরিষ্কার, এই ছেলেরা রোমানদের সাথে রোমান হিসাবে বড় হবে। পরবর্তীতে এরাই নিজ অঞ্চলে রোমানিকরণ বজায় রাখবে।
এই নীতির অধীনেই খ্রিস্টপূর্ব ১১ বা ৯ সালে আরমিনিউস এবং তার ভাইকে রোমানদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন তার বাবা। আর্মিনিউস রোমে একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে বেড়ে ওঠেন। রোমানদের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন। বার্বারিয়ানদের মাঝে সর্বোচ্চ ইকয়েস্টিয়ান পদেও পৌঁছাতে সক্ষম হন।
৭ম বা ৮ম খ্রিস্টাব্দে জার্মানিয়ার গভর্নর জেনারেল ভ্যারাসের বাহিনীতে বদলি হয়ে পিতৃভূমিতে ফিরে আসেন আরমিনিউস। তবে এই ফিরে আসাটা সুখকর হয় নি আরমিনিউসের জন্য। জার্মানদের প্রতি রোমান বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন,রোমানদের প্রতি জার্মানদের তীব্র ঘৃণা আরমিনিউসের চোখ এড়িয়ে যায় নি।ধর্মসংকটে পড়েন আরমিনিউস।একদিকে রোমান সম্রাজ্যের প্রতি তার আনুগত্য অপরদিকে স্বজাতির দুর্দশা। চোখ বুজে থাকার লোক আরমিনিউস নন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন, যে করেই হোক জার্মানিকাকে মুক্ত করতেই হবে।
ছক কষতে শুরু করেন আরমিনিউস। গোপনে নিজ গোষ্ঠী চেরুস্কির প্রধানের দায়িত্ব নেন। একদিকে গোপনে জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একত্র করার চেষ্টা অপরদিকে গভর্নর ভ্যারাসের বিশ্বাস অর্জনের কাজ।দুটোতেই ভালোই সফল তিনি।
অবশেষে ৯ম খ্রিস্টাব্দে সুযোগ চলে আসে। ভ্যারাস তার বাহিনী সমেত রাইন নদীর তীরে শীতকালীন সদরদপ্তরে ফেরার পথে। কিন্তু এইসময়টাতেই টেউটোবুর্গ বনাঞ্চলের গোষ্ঠীগুলোর বিদ্রোহের সংবাদ আসে। আসলে পুরো বিষয়টাই আরমিনিউসের যে পরিকল্পনা ছিলো ভ্যারাস তা ভাবতেও পারেন নি।
আরমিনিউসের টেউটোবুর্গ বনকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিলো এর ভৌগলিক অবস্থা। টেউটোবুর্গ এমনিতেই বন পাহাড়ি বন। তার উপর অনেক স্থানই সরু-কর্দোমাক্ত অন্ধকারচ্ছন্ন। এরকম একটা পরিবেশে রোমানদের জন্য যুদ্ধ করাটা কঠিনই নয় বরং একরকম অসম্ভব। নিজেদের ‘ব্যাটেল ফরমেশন’-এ আসার কোনো সুযোগই তাদের থাকে না, যা জার্মানদের জন্য বড় একটা সুবিধার। আরমিনিউস তা ভালো করেই জানতেন। উত্তর-পূর্ব অসনাবুল্কে বনের যে অংশটায় রোমানরা আক্রমনের মুখে পড়ে তার একপাশে রাইন নদী আর অপরপাশে ঘনবন আর জার্মানদের তৈরি কার ফাঁদ। আরমিনিউস নিজে ভ্যারাস আর তার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে এই ফাঁদের মাঝে নিয়ে আসেন। আর যখন ঘনবনের পাশ থেকে জার্মানরা ধেঁয়ে আসে ২০ কিলোমিটার জুড়ে বিক্ষিপ্ত রোমানদের ১৫ হাজার মুক্তিকামী জার্মানের সামনে তখন আসলে কিছুই করার ছিলো না। আধুনিক সমরবিদ এবং ইতিহাসবিদদের মতে এই পরাজয় মিলিটারি ইতিহাসের সবচেয়ে ‘ডিসাইসিভ’ পরাজয়গুলোর একটি।একইসাথে রোমের ‘ গ্রেটেস্ট ডিফিট’।
আরমিনিউস তার কথা রেখেছিলেন। জার্মানিকাকে রোম থেকে চিরতরে মুক্ত করেছিলেন। রোমানরা যদি না পরাজিত হতো ইউরোপের ইতিহাস হয়ত আজ অন্যরকম হতো। আধুনিক জার্মানির ধারণা তখনো বহুদূর। তবুও তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘জার্মান জাতির প্রথম মুক্তিদাতা’ হিসাবে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য ব্যক্তিগত জীবনটা মোটেও সুখের ছিলো না এই বীরের। রোমানদের বন্দি হিসাবে স্ত্রী আর সদ্য ভূমিষ্ঠ পুত্রকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের দেখা আর কখনোই তিনি পান নি। এমনকি বীরের গৌরবময় মৃত্যু বা স্বাভাবিক মৃত্যু কোনোটাই জোটে নি তার।
২১ খ্রিস্টাব্দে কিছু জার্মান গোষ্ঠীপ্রধানের ইন্দনে হত্যা করা হয় আরমিনিউসকে। তাদের ভয় ছিলো, আরমিনিউস অত্যাধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠছেন, যা তাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
এভাবেই জীবনাবসান ঘটে এই বীর নায়কের।
২১ খ্রিস্টাব্দে রোম তার জার্মানিকা অভিযান পুরোপুরিই বন্ধ করে দেয়। রাইন নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত নিজেদের সীমানা স্থায়ীভাবে নির্ধারন করে।