মীর জুমলা গেট ও টিএসসির গ্রিক স্মৃতিচিহ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাদরে পড়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনার আদ্যোপান্ত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হতে সোজা বাংলা একাডেমীর দিকে হাটা শুরু করলে দোয়েল চত্বরের ঠিক আগে, তিন নেতার মাজারের ডান পাশে হলুদ রঙ এর জীর্ণ একটি স্থাপনার দৃষ্টিগোচর হয়। অনেক সচেতন মানুষ থেকে শুরু করে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনেক শিক্ষার্থী জানেন না এই ঐতিহাসিক স্থাপনার ইতিহাস। অনেকটা লুকোছাপার মত, লতাপাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে মুঘল আমলের এ স্মৃতিচিহ্ন। বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুযায়ী যার কেতাবি নাম মীর জুমলা গেট। লোকে আরও বলে ঢাকা গেট, ময়মনসিংহ গেট, রমনা গেট। তিনটি স্তম্ভের একটি অংশ পড়েছে রোড ডিভাইডারের মাঝে, আরেক অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি ইন্সটিটিউট এর দিকে এবং অবশিষ্ট অংশ পড়েছে তিন নেতার মাজারের পাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরবের সাথে পাল্লা দিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাও যেন হারাচ্ছে তার জৌলুশ। পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে, এর মধ্যে আবার পোস্টারের নোংরা তোপে আড়াল করে রেখেছে ঢাকার বুকে জেগে থাকা এই মুঘল স্থাপনাকে।
ইতিহাস
মীর জুমলা গেট বা ঢাকা গেটের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে বেশ শক্ত দ্বিধাবিভক্তি। প্রথম মত অনুসারে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুবাদার মীর জুমলা ঢাকার নিরাপত্তার স্বার্থে তথা উত্তর দিক হতে মগ দস্যুদের উৎপাত প্রতিহত করতে এই গেটটি নিরাপত্তার জন্য নির্মাণ করেন। মূলত এর পর থেকেই এই গেট ঢাকা শহরের প্রবেশপথ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নিরাপত্তারক্ষীর সাথে হাতিদের আনাগোনা ছিল এই গেটের সম্মুখভাগে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষ এ বলা হয় ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে সুবাদার মীর জুমলার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এই গেট। অপর এক সূত্রমতে, সুবাদার ইসলাম খাঁ’র আমলে রমনা অঞ্চলে বাগে বাদশাহী নামের এক উদ্যান ছিল। আর এই উদ্যানের প্রবেশপথ হিসেবেই তৈরি করা হয় আজকের ঢাকা গেট। তবে ইতিহাসবিদ আহমেদ দানীর মতে, বর্তমানে অবশিষ্ট স্তম্ভগুলোকে পুরোপুরিভাবে মুঘল স্থাপনা বলা চলে না। তিনি এর স্থাপত্যরীতি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানান যে, এটি কোন মুঘল স্থাপনা নয়। এর গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের। ১৮২০ সালের দিকে মূল শহরের সাথে রেসকোর্সকে সংযুক্ত করতে তখনকার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস এই গেটের পুননির্মাণ করেন। আহমেদ দানীর এ মতের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন মুনতাসির মামুন তার ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগর’ বইতে।
নামকরণ
নির্মাণকালীন সময় থেকে আজ অব্দি এই গেট মীর জুমলা গেট নামেই পরিচিত। বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় গেজেটে এই নামের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। মাঝখান দিয়ে ঢাকা গেট নামটি সুপরিচিত হয়ে যায়। আবার রমনা এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে অনেকে একে রমনা গেটও বলে অভিহিত করেন। তবে মীর জুমলা গেটকে ময়মনসিংহ গেট কেন বলা হয় তার কারণ আপাতত এই লেখায় অজানা।
গঠন
মীর জুমলা গেটের স্থাপত্যরীতির সাথে ঢাকার অন্য সব মুঘল স্থাপনার রয়েছে বেশ বড়সড় অমিল। ১০০ থেকে ১৫০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের এ স্তম্ভের উপরে রয়েছে কারুকার্যময় চারকোণা শেড। হলুদ রঙ এর স্থাপনার এ বিবর্ণ রঙ থেকে বুঝার উপায় নেই প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এটির রঙ আসলে কি ছিল। পূর্ব পাশের স্তম্ভের সাথে অতিরিক্ত কোন স্তম্ভ না থাকলেও পশ্চিম পাশের স্তম্ভের সাথে রয়েছে তুলনামূলক ছোট আরেকটি স্তম্ভ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হেলায় পড়ে আছে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলে এর দেখভালের দায়িত্ব তাঁদের না আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, তাঁরা প্রয়োজনীয় ভূমির তফসিলের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছে। এমন চিঠি চালাচালির বেড়াজালে পড়ে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা এখন অনেকটা নিষ্প্রভ, গেটের কোথাও এর নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। যার কারণে অধরাই থেকে যাচ্ছে এর গুরুত্ব। তবে আশার কথা এই যে গত বছর রাজউক রাজধানীর ৭৫ স্থাপনাকে ঐতিহ্যবাহীর কাতারে এনে এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। যার তালিকায় আছে আমাদের এই মীর জুমলা গেট।
টিএসসিতে শেষ গ্রিক স্মৃতিচিহ্ন
ব্যবসা বাণিজ্যের সুবাদে বিদেশ বিভূঁই থেকে উপমহাদেশে ঘাটি গেড়েছিলেন অনেক বৈদেশিক বণিকের দল। তাঁদের মাঝে কেউ থিতু হয়েছেন এ অঞ্চলে আর কেউবা তোপের মুখে ছেড়ে চলে গিয়েছেন নিজ গাঁয়ে। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজদের মত এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে এসেছিল গ্রিকরাও পালে হাওয়া তুলতে। উদ্দেশ্য ছিল নিজের আখের গোঁজানোর। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তল্পিতল্পাসহ মাঠ ছাড়ে। বাংলাদেশের কথা তুললে অল্প কিছু গ্রিক ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তাদের বসতি গড়ে তুলেছিল। পাট ও লবণের ব্যবসা করত তারা। ব্যবসায় প্রতিকূল অবস্থা আঁচ করতে পেরে এদেশ ছাড়ার আগে ফেলে রেখে যায় তাদের কিছু স্মৃতি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেসব গ্রিক কবর ছিল তাও আজ বিলীন। দেশের আর কোথাও গ্রিকদের স্মৃতিচিহ্নর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সবুজ চত্বরে আজো জ্বলজ্বল করছে গ্রিকদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই জানেন না, এটি আসলে কি, আদৌ কোন স্থাপনা নাকি অন্যকিছু। পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবে শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে গ্রিক স্মৃতির প্রমাণ হিসেবে ভাস্বর হয়ে আছে এই সমাধিসৌধটি। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে নির্মাণ করা হয় এ সমাধিক্ষেত্রটি। নয়টি সমাধির এ স্মৃতিসৌধের সঙ্গে রয়েছে স্মৃতিফলকও। যাতে গ্রিক ভাষায় খোদাই করা আছে “যাদের ঈশ্বর বেছে নিয়েছেন মৃত্যুর জন্য তাঁরা সত্যি ভাগ্যবান”।
নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী ডিমিট্রিয়াস নামের এক গ্রিক পরিবারের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল এ সমাধিসৌধ। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত এই সমাধি নিয়ে কেউ তেমন ঘাটাঘাটি করেনি। সেই নব্বই দশকে ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংকের গ্রিক প্রতিনিধি। মহিলার নাম হেলেন আবাদজী। তার ব্যক্তিগত আগ্রহের প্রেক্ষিতে খোঁজা হয় এই সমাধিসৌধের ইতিহাস। তার গবেষণায় কিছু তথ্য প্রথমবারের মত সামনে আসে। সৌধের ভেতরের ফলকগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেন হেলেন। প্রথম ফলকে লেখা আছে, “যার স্মৃতিতে উৎসর্গ হল এই ফলক, তার নাম সুলতানা আলেকজান্ডার”। চতুর্থ ফলকটি নিকোলাস দিমিত্রিয়াস এলিয়াস নামের এক গ্রিক ভদ্রলোকের। চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো সমাধির প্রবেশপথ রয়েছে পূর্বদিকে। সেন্ট থমাস গির্জার যাজক ম্যাকডোনাল্ডের উদ্যোগে নির্মিত হয় এ সমাধিসৌধ। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে সংস্কার করা হয় গ্রিকদের এ শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
order semaglutide 14mg generic – order rybelsus 14mg for sale buy DDAVP cheap