সমসাময়িক সময়ের ভারতীয় লেখকদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম যে প্রথম সারিতে থাকবে, তা যে কেউ-ই বলে দিতে পারে নির্দ্বিধায়। প্রথিতযশা এই লেখকের জন্ম বাংলাদেশে হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা ভারতে। তাঁর লেখা মূলত ইতিহাস আর মানুষের জীবন কেন্দ্রিক। তাঁর অনেকগুলো গল্পের বইয়ের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে “ছায়া দর্শন”।
গল্পের ভিতরেও ছন্দ থাকে। গল্প জীবনের খণ্ডিত ভাবগুলো ফুটিয়ে তোলে। আর গল্প যদি হয় জীবন-কেন্দ্রিক, তাহলে সে গল্প হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। ছায়া দর্শন বইটিতে মোট ৮টি গল্প রয়েছে। এর প্রথম দুটি গল্প ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে, বাকি ছয়টি গল্প জীবন কেন্দ্রিক।
“ছায়া দর্শন” বইটির প্রথম গল্পটি মূলত বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙের একটি ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লেখা। এ গল্পে হিয়েন সাঙ বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ জানতে বৌদ্ধ ধর্মের উৎসস্থল যাবার জন্য রওনা দেন। তিনি জানতে পারেন যে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়া হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তিনি সেখানে যেতে চান। যাবার পথে তাকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। চলার পথে তিনি শুনতে পান যে একটি দুর্গম পথের ওপাড়ে রয়েছে ছায়াগুহা, যে গুহায় বুদ্ধের ছায়া বর্তমান। তিনি সে ছায়া দেখার জন্য সে পথে পা বাড়ান। পথিমধ্যে একদল ডাকাত তাকে আক্রমণ করলে তাঁর কথা শুনে ডাকাতরাও এ অদ্ভুত জিনিস দেখার জন্য তাঁর সঙ্গ নেয়। গুহায় পৌঁছানোর সাথে সাথে ছায়া দেখা না গেলেও দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করে তারা সে ছায়ার দেখা পায়। এতে উদ্ভুদ্ব হয়ে ডাকাত দলের সর্দার তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এ গল্পটির নাম ছায়া দর্শন। এ গল্পের নামেই বইটির নাম রাখা হয়েছে ছায়া দর্শন।
বইটির দ্বিতীয় গল্পের নাম “কীর্তিনাশার এপারে ওপারে”। এটিও ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে লেখা গল্প। এ গল্পটি মূলত মধ্যযুগে এ অঞ্চলের শাসকদের দ্বন্দ্ব এবং প্রেমকাহিনী ফুটে উঠেছে। গল্পটির মূল চরিত্রে পাওয়া যায় বারো ভূঁইয়া শাসক কেদার রায় এবং ঈশা খাঁ। বিক্রমপুর ও সোনারগাঁওয়ের এই দুই শাসক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। যৌথভাবে যুদ্ধ করে তারা পরাস্ত করতো মোগল ও আরাকান সৈন্যদের। গল্পে ঈশা খাঁ প্রেমে পরে যায় কেদার রায়ের বিধবা বোন স্বর্ণময়ীর। কেদার রায় কোনভাবেই ঈশা খাঁ-র এ প্রস্তাব মেনে নিতে পারে না। কারণ তখন হিন্দুধর্মে বিধবা বিবাহ মহাপাপ, আর মুসলমানের সাথে বিয়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তখন ঈশা খাঁ স্বর্ণময়ীকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেন। সেই সাথে ভেঙে যায় দুই শাসকের বহুদিনের বন্ধুত্ব। কেদার রায় আক্রমণ করে ঈশা খাঁ-র রাজ্য। দীর্ঘ যুদ্ধের এক পর্যায়ে মারা যান ঈশা খাঁ। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো স্বর্ণময়ী সোনাই বিবি নাম নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন কেদার রায়ের বিরুদ্ধে। গল্পের শেষে দেখা যায় মোগলদের সাথে এক যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন কেদার রায়। অন্যদিকে মগদের সাথে যুদ্ধের এক পর্যায়ে আত্মাহুতি দেন সোনাই বিবি।
বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসে পাঠান-মোগলদের ঘটনাপ্রবাহ জানা গেলেও বারোভূঁইয়াদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। সে জায়গা থেকে ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, তা থেকেই গল্পটিকে সাজানোর চেষ্টা করেছেন লেখক।
তৃতীয় গল্পটি হচ্ছে “লন্ঠন সাহেবের বাংলো”। এ গল্পটি একজন ইংরেজ সাহেবকে নিয়ে যার আসল নাম হ্যামিল্টন, যদিও লন্ঠন সাহেব নামেই তিনি পরিচিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি পরগনার ম্যানেজার হয়ে তিনি আসেন ভারতে। একটি বাংলোয় তিনি থাকেন যেখানে তাঁর স্ত্রী জেনির কবর রয়েছে। কোম্পানি ব্যবসার পাট গুছিয়ে নিলেও তিনি সে বাংলোতেই থেকে যান। সে গাঁয়ের লোকদের কাছেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর কাজের জন্য। গাঁয়ের লোকজনই হয়ে উঠেছিলো তাঁর আপনজন। তাদের বিপদে তিনি সাহায্য করতেন। গাঁয়ের লোকদের চোখের রোগের জন্য ভাল ডাক্তার আনার অনুরোধ করেন জমিদারকে। বিনিময়ে তাঁর নিজস্ব বাজার তিনি তুলে দেন জমিদারের হাতে। কিন্তু দেখা যায় তাঁর মৃত্যুর পরে জমিদার তাঁর অনুরোধ রাখেনি। বরং সে লন্ডনে একটি ফাণ্ডে তিনি চাঁদা দেন, যাতে তার নাম হয়। গল্পটিতে এটাই দেখানো হয়েছে যে একজন ভিনদেশী মানুষ ঐ সাধারণ মানুষগুলোকে যতটুকু ভালবেসেছে, সে অঞ্চলের জমিদার তার সিকিভাগও ভালবাসা দেখাতে পারেনি।
চতুর্থ গল্পটির নাম “বৃষ্টি-বজ্রপাতের সেই রাতে”। এ গল্পটি একটি পরিবারের ঘটনাবলী নিয়ে লেখা। শকুন্তলার স্বামী পদ্মনাভ ঘোষাল প্রাক্তন জমিদার যিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পরে শকুন্তলা তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া শেখান, স্বামীর ব্যবসা দেখাশুনা করেন শক্ত হাতে। বিধবার বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছে গল্পটিতে। ছেলে অমরেন্দ্র বড় হলে বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করা শুরু করে। সে বিয়ে করে হৈমন্তী নামের এক মেয়েকে। বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিলো। তবু সন্তান হওয়ার পরে তাদের মনের অজান্তেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়ন। হৈমন্তী কিংবা অমরেন্দ্র সেটা বুঝতে না পারলেও শকুন্তলা সেটা বুঝতে পারেন। আর তাই এক ঝড়-বাদলের রাতে তিনি কাউকে না জানিয়ে তিনি চলে যান সবার অগোচরে।
পঞ্চম গল্প “বন্ধ দরজা, খোলা দরজা” একজন গায়ককে নিয়ে লেখা। গায়ক সত্যব্রতের সাথে ঘটনাচক্রে সম্পর্ক গড়ে ওঠে অনসূয়ার সাথে। দীর্ঘদিন তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক এবং অনেকবার শারীরিক মিলন ঘটলেও একসময় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। দীর্ঘদিন পরে অন্য পুরুষের সাথে অনসূয়াকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পরলেও নিজেকে সামলে নেয় সত্যব্রত। স্ত্রী-র দূরত্ব থাকলেও তাদের ভালবাসার কোন কমতি ছিলো না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গল্পের শেষ দিকে। এ গল্পটি একই সাথে ভালবাসা, আবেগ, বিচ্ছেদ এবং বাস্তবতার।
ষষ্ঠ গল্প “ভাঙা সেতু” একটি ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প। এ গল্পে দুটি মেয়ে একে অন্যের প্রেমে পরে। বিজয়া বিজয় নাম নিয়ে ছেলে সেজে যায় অন্নপূর্ণার বাড়িতে। প্রথমে সবাই মেনে নেয়। কিন্তু বিয়ের আসরে যখন সবাই বুঝতে পারলো যে বিজয় আসলে ছেলে নয়, মেয়ে। উপস্থিত সবার টিটকারি, কথার খোঁচা সহ্য করতে না পেরে এবং তারা খেয়ে সে ছুটতে শুরু করলো। ছুটতে ছুটতে ভাঙা ব্রিজ দিয়ে পরে গিয়ে মারা যায় সে। আমাদের দেশে সমকামী প্রেমের যে বাস্তব চিত্র, তা-ই উঠে এসেছে এই গল্পে।
“জামরুল গাছটা সাক্ষী” গল্পটি ছিল এক বিধবা মেয়ে বেলিকে নিয়ে। বেলির স্বামী মারা যাবার পরে সে বাবার সাথেই থাকে। বাবা হাটে গেলে বাড়িতে তার একা থাকতে হয়। এমনি একদিন সে যখন একা ছিলো, তখন এক অপরিচিত লোক আসে বাড়িতে। বেলি তার সাথে ভালভাবে কথা বললেও পরক্ষণে বুঝতে পারে যে লোকটির মতলব খারাপ। আত্মরক্ষার তাগিদে সে একটি বটি ছুঁড়ে মারে, আর তাতেই মারা যায় লোকটি। লাশ বনের ভিতরে লুকানোর সময় তার সঙ্গী হয় একটি কুকুর। কুকুরটিকে সে সাথে রেখে দেয়। আর মাঝে মাঝে ভাবে যে কুকুরটার মতো ঐ লোকটাও যদি তার সাথে ভাল ব্যবহার করতো, তাহলে তো আর তাকে ওভাবে খুন হতে হতো না।
বইটির শেষ গল্পের নাম “গান বন্ধ হলেই অন্ধকার”। এ গল্পটিতে কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর পুরুষ ও মহিলার একটি আড্ডার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য গল্পগুলোর মতো এ গল্পটি খুব বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়নি।
ছায়া দর্শন বইয়ের গল্পগুলোতে কাহিনীচক্র ও শব্দ-ব্যবহার যথার্থ। তাই সব মিলিয়ে বইটি যে কোন পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম বলেই আশা করি।
do wellbutrin sr side effects go away
order lamisil 250mg – forcan tablet grifulvin v over the counter
zyprexa weight gain prevention
what is zofran odt